somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশালঃ ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বরিশাল আমার গর্ব

১০ ই জুন, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত ধান-নদী খালের অপূর্ব সমাহার বরিশাল। বরিশাল দক্ষিণ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা এবং বরিশাল বিভাগের সদর দপ্তর। দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র পলি জমে সৃষ্ট কয়েকটি দ্বীপ বরিশাল। এ অঞ্চল বা এর অংশ বিশেষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সময়ে পরিচিত ছিল। প্রাচীন নাম বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। পাঙ্গালা, সাগরদ্বীপ, চন্দ্রদ্বীপ, বঙ্গাল প্রভৃতি ছত্রিশটি নামার পরিচয় পাওয়া যায়। চন্দ্রদ্বীপ কখনো পরগণা, কখনো বা রাজ্য হিসেবে সুপরিচিত ছিলো। চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চল চন্দ্রদ্বীপ নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তারকালে দনুজমর্দন কর্তৃক চন্দ্রদ্বীপ নামে এ স্বাধীন রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই নদী ভাঙ্গন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা এ অঞ্চলের মানুষের পেশা কৃষি ও মৎস্য শিকার। গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত চন্দ্রদ্বীপে লোকবসতি কবে শুরু হয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রাচীন পুঁথি থেকে ধারণা পাওয়া যায় বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের জন্ম ৪ হাজার বছর পূর্বে। প্রাচীনকালে এই দ্বীপে ছিল অসংখ্য নদী-নালা।


এ রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে ১৭৯৬ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চল বাকলা নামে পরিচিত ছিলো। নবাব আলীবর্দী খানের সময় আগা বাকের খান চন্দ্রদ্বীপের একাংশের জমিদারী লাভ করে বাকেরগঞ্জ বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯৭ সালে ঢাকা জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০১ সালে জেলার সদর দপ্তর বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশাল (গিরদে বন্দর; গ্রেট বন্দর) স্থানান্তরিত করা হয়। কালক্রমে জেলার মূল নাম বাকেরগঞ্জের পরিবর্তেস বরিশাল নামটিই পরিচিতি লাভ করে। দেশের খাদ্যশস্য ও মৎস্য উৎপাদনের অন্যতম মূল উৎস বরিশাল। একে বাংলার ভেনিস বলা হয়।


(বরিশালের ঐতিহ্যবাহী বিবির পুকুর)
বরিশাল নামকরণ সম্পর্কেও অনেক মতভেদ রয়েছে। বড় বড় শালগাছের কারণে, (বড়+শাল)> বরিশাল, বড় বড় ঘর (শাল) থাকার কারেণে বড়ি (বড়) + শাল (ঘর) বরিশাল; পর্তুগীজ বেরী ও শেলীর প্রেম কাহিনীর জন্য বরিশাল; বড় বড় লবনের বরিশাল ইত্যাদি। গিরদে বন্দরে ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের গোলা ও চৌকি ছিলো। ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা বড় বড় লবণ চৌকিকে 'বরিসল্ট' বলতো। পরবর্তীতে শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে 'বরিশাল' হয়েছে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ও ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ছিল খুলনা বিভাগের অন্তর্গত। নদীর অববাহিকার এ জেলার বয়স দু’শ’ বছর পেরিয়ে গেছে।


সংক্ষেপে এর সীমারেখা হচ্ছে উত্তরে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ, পশ্চিমে গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি, দক্ষিণে বরগুনা ও পটুয়াখালী এবং পূর্বে ভোলা ও লক্ষ্মীপুর। সর্ব শেষ তথ্য অনুযায়ী এ জেলার আয়তন: ২৭৯০.৫১ বর্গ কিলোমিটার একং মোট ভোটার সংখ্যা (পুরুষ ও মহিলা)- ১১,৯৭,৭২২(পুরুষ) ১১,৫৮,২৪৫(মহিলা) জন ।


বরিশাল দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর। এককালের বরিশাল জেলা শহর বর্তমানে রূপ নিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় শহরে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বরিশালের রূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে নাম দিয়েছিলেন প্রাচ্যের ভেনিস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এ শহরের আত্মীয়তা ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। এখানে জন্ম নিয়েছেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত, বাংলার বাঘ বলে খ্যাত শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নির্ভীক সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কবি সুফিয়া কামাল, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, নলিনী দাস, মনোরমা মাসিমা অমৃত লাল দে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল, কৃষক কুলের নয়নমণি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অনেক ক্ষণজন্মা নারী-পুরুষ।


একুশে ফেব্রুয়ারি ও মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে বরিশালের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের রচয়িতা ও বিশিষ্ট কলামিস্ট আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী এবং গানটির সুরকার ও শিল্পী আলতাফ মাহমুদ জন্ম নিয়েছেন এ জেলায়। আলতাফ মাহমুদের নামে নগরীতে রয়েছে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়। এছাড়াও স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীরশ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল, বীরোত্তম আব্দুস সত্তার ও মেজর জলিলকে নিয়ে এখানকার মানুষ এখনও গর্ববোধ করেন। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের শৈশব-কৈশোর ও শিক্ষকতা জীবন কেটেছে বরিশাল শহরে। একইভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অপর নেতা চারণ কবি মুকুন্দ দাসের শৈশব-কৈশোর কেটেছে এই শহরে।


(বরিশাল অক্সফোর্ড মিশন)
এ অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদন হওয়ায় নদী ও খালের সঙ্গে যুক্ত করেই প্রবাদ রচিত হয় ‘ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল’। বালাম চাল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এ জেলা।


(দুর্গাসাগর)
১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ পরগনার তৎকালীন রাজা শিবনারায়ণ এলাকাবাসীর পানির সঙ্কট নিরসনে মাধবপাশায় একটি বৃহৎ দীঘি খনন করেছিলেন। তার মা দুর্গা দেবীর নামে দীঘিটির নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর। প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিবর্তে দুর্গাসাগর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে জেলা প্রশাসন। দুর্গাসাগরের তিনদিকে তিনটি ঘাটলা ও দীঘির ঠিক মাঝখানে ৬০ শতক ভূমির ওপর টিলা রয়েছে। দুর্গাসাগরের অদূরেই রয়েছে অত্যাধুনিক বায়তুল আমান জামে মসজিদ কমপ্লেক্স ও শেরেবাংলা একে ফজলুল হক জাদুঘর। এ জাদুঘরটি বানারীপাড়ার চাখারে শেরেবাংলার জন্ম ভিটায় অবস্থিত। লাকুটিয়া জমিদার বাড়িটি প্রায় তিন’শ’ বছরের পুরনো।


(বরিশাল বিমান বন্দর)
খাল-বিলে ভরা এ জেলার মানুষের এক সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল একমাত্র নৌকা। গয়নার নৌকা থেকে শুরু করে এখন যাত্রীসেবায় যুক্ত হয়েছে বিলাসবহুল দোতলা-তিনতলা লঞ্চ। যোগাযোগের মাধ্যম নৌপথের পাশাপাশি আজ সড়ক ও আকাশ পথের উন্নতি হয়েছে।


(বাইতুল আমান মসজিদ বরিশাল)
জীবনান্দদের স্মৃতিবিজড়িত রূপসী বাংলার রূপের মাধুর্য ছড়িয়ে ছিটেয়ে আছে এখানের প্রতিটি পথে প্রান্তরে । ঘর হতে শুধু দু'পা ফেলিয়া সময় করে আসুননা প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালে। নিমন্ত্রণ রইলো সবার।


(গুঠিয়া মসজিদ, উজিরপুর)

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল :-& ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০২০ দুপুর ২:১৪
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×