somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রতিবাদ ও প্রেম, দ্রোহ আর বিরহের কবি হেলাল হাফিজের ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৯:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলা কবিতায় হেলাল হাফিজ একটি প্রবাদতুল্য নাম। একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ লিখে এই কবি যে পরিমাণ খ্যাতি পেয়েছেন তার তুল্য অন্য কেউ নেই। “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” এ দুটি লাইন শোনেনি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে চিকামারা হয়েছে কবিতার এ দুটি লাইন। কবিতার নাম ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। কবির নাম হেলাল হাফিজ। একটি মাত্র কবিতার বই দিয়ে বাংলা সাহিত্যে হয়েছেন অমর। নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। তার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির কবিতাগুলো যেন একেকটি প্রেম আর দ্রোহের খনি। ভাষার এমন সুন্দর ব্যবহার, শব্দের এমন চমৎকার চয়ন, বিমোহিত করে তাবৎ কাব্যপ্রেমীকে। হেলাল হাফিজ আজকের মৌলিক কবি, নন্দিত কবি। কবি হেলাল হাফিজ উদাসীন ছিলেন, কবিতাই তার প্রেম, তার সংসার। এই কবি কবিতাকে স্লোগান করেননি, তবে তার কবিতা স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কবির কবিতায় যেমন আছে ব্যক্তির আবেগ অনুভূতি, প্রেম-বিরহ তেমনি আছে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা এবং আশাভঙ্গের কথাও। ষাটের দশকের শেষে আবির্ভূত হওয়া একজন প্রকৃত কবি হেলাল হাফিজ। একমাত্র কবি যিনি বই প্রকাশের প্রতি অনাগ্রহ ধরে রাখতে দেখা যায়। উনার একটা বই-ই প্রতিবছর বের হয় একই নামে। দীর্ঘাকৃতিতে নয় এবং ছোট ও মাঝারি আকৃতিতে হেলাল হাফিজের কবিসত্ত্ব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। হেলাল হাফিজের কবিতার এক বড় এলাকা জুড়ে মর্মগ্রাহী দুঃখও বেদনার বিস্তার। কবি জীবনবাদী। শিল্পকে জীবনের অভিমুখে তার মোহনায় নিয়ে যাওয়ার অভিসারী তিনি। তাই আশাবাদের স্বপ্ন দেখেন। অল্প লিখেও গল্প হয়েছেন কবি হেলাল হাফিজ । কবির রচিত মমতা মাখানো মর্মস্পর্শী পঙ্‌ক্তিমালা, রূপকথার এই মানুষটিকে সত্যিই আজ এক জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত করেছে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রিত এই কাব্যগ্রন্থ হেলাল হাফিজকে এনে দেয় তুঙ্গস্পর্শী কবিখ্যাতি আর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। জীবন্ত এই কিংবদন্তি কবির আজ ৭০তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা কবিতার এই রাজকুমার কবি হেলাল হাফিজের জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।


কবি হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনা জেলায় আটপাড়া থানার বড়তলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম খুরশেদ আলী তালুকদার এবং মাতার নাম কোকিলা খাতুন। হেলাল হাফিজের পিতা ছিলেন খ্যাতিমান শিক্ষক এবং কবি এবং মাতা কোকিলা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তার একমাত্র সহোদর অগ্রজের নাম দুলাল আবদুল হাফিজ। মাত্র ৩ বছর বয়সে কবি মাকে হারান। খুব শৈশবেই কবি মাতৃহীন হলে তার পিতা আবার বিয়ে করেন। তার ভাষায়, মাতৃহীনতার বেদনাই তাকে কবি করে তুলেছে।নেত্রকোনা শহরেই কবি হেলাল হাফিজ শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের দিনগুলো অতিবাহিত করেন। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের হল ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী পরিণতি ঘটেছে তা জানবার জন্য সে দিন আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন কবি গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দুজনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন।


দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন । সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন। পিতার কবিতার খাতাগুলো কবিকে প্রথম যৌবনের কবি হয়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রাণিত করে। কলেজ জীবনে এসেই হেলাল হাফিজ কাব্যকর্মে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। প্রায় দেড়যুগ কাব্যচর্চার পর ১৯৮৬ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বের হয়। সারাদেশে হৈ-চৈ পড়ে যায়। মাতৃহীন ছিলেন বলেই বোধ হয় বেদনাবোধ এবং শূন্যতা হেলাল হাফিজকে কবি হওয়ার প্রণোদনা যুগিয়েছে। এই বেদনা ভুলে থাকার জন্য প্রথমে খেলাধুলায় সময় দিতেন। প্রথম থেকেই অল্প স্বল্প লিখতেন। এরপর কলেজে পড়াকালীন অবস্থায় খেলাধুলায় আর দুঃখটা যাচ্ছিল না, তখন কবিতার দিকেই মনোনিবেশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কবিতার প্রতি একাগ্রতা বাড়ে। কবি নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসান ছিলেন উনার কাছের মানুষ। ষাটের দশক থেকে কবিতার চর্চা করেন এবং ৬৯ থেকে ৮৫ দীর্ঘ ষোলো বছরের কবিতা নিয়ে তার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটি। এই ৫৪টি কবিতায় কবির কাব্যব্যক্তিত্ব ও নিজস্ব চরিত্র লক্ষণ স্পষ্টতর।


কবির সাহিত্য কর্ম ও পুরস্কারঃ
কবিতার জন্য হেলাল হাফিজ পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদযাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা (১৯৮৫), যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেদদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা প্রভৃতি। কবিতার জন্য তিনি ২০১৪ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। কবি হেলাল হাফিজ শুধু সমাজের কাছেই দায়বদ্ধ নন তার কবিতায় তিনি এদেশের মাটি ও মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, যাবতীয় সুখ-দুঃখ একাকার করে নিয়েছেন। কবি হেলাল হাফিজ অত্যন্ত বিনয়ী, নিরহংকারী এবং নিভৃতচারী এক কুমার। জাতীয় জীবনে মুক্তি ও দ্রোহের আগুন ছড়ালেও ব্যক্তিজীবনে প্রচণ্ড অভিমানী এ মানুষটি জন্মাবধি নিজের সঙ্গেই কষ্ট ফেরি করে চলেছেন। আমৃত্যু একাকীত্বকে ব্রত করেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন।চিরকুমার হেলাল হাফিজ এক গভীর ঔদাস্য থেকেই যেন আর কিছুর সঙ্গেই জড়ালেন না নিজের জীবনকে। যদিও নিজের ব্যাপারে এক ধরনের নির্লিপ্ততা, নিরাসক্তি ও উদাসীনতা তার রয়েছে তবু মানুষ নিয়ে কবির কৌতূহলের অন্ত নেই। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিত্যসঙ্গী, কবিতা আর নিঃসঙ্গতা প্রিয় বান্ধব এই নগর বাউলের। অথচ চিকিৎসার অভাবে নিজের দুই চোখ হারাতে বসেছেন পাঠকনন্দিত কবি হেলাল হাফিজ। গ্লুকোমা আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাঁ চোখটি নষ্ট হয়ে গেছে। ডান চোখের দৃষ্টিশক্তিও ধীরে ধীরে নষ্ট হওয়ার পথে। ঝাপসা দেখেন। শুধু তাই নয়, তাঁর শারীরিক অন্যান্য সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিনি ডায়াবেটিস, অ্যাজমাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। চিকিৎসকদের একটি সূত্র জানায়, গ্লুকোমা আক্রান্ত হয়ে কবির একটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। অন্য চোখটির অবস্থাও সংকটাপন্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্লুকোমা একটি ‘অনিবারণযোগ্য’ রোগ। এতে চোখের উপর চাপ বেড়ে গিয়ে চোখের পিছনের স্নায়ু অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টিক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।


এই কবির আজ ৭০জন্মদিন বার্ষিকী। জন্মদিনে কবিকে জানাই শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

নূর মোহাম্মদ নুরু
গণমাধ্যমকর্মী
nuru,[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৯:০৮
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×