somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতিমান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের অন্যতম নেতা চে গুয়েভারার ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


‘চে’-শুধু এই একটি মাত্র শব্দেই তিনি পরিচিত বিশ্ববাসীর কাছে। তিনি কিউবান বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কর্ণধার আর্নেস্টো চে গুয়েভারা। তিনি ছিলেন একাধারে একজন মার্ক্সবাদী, বিপ্লবী, চিকিত্সক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না। তবে তিনি সারা বিশ্ব লা চে বা কেবলমাত্র চে নামেই পরিচিত। মৃত্যুর পর তাঁর শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়। ১৯৬৬ সালের অক্টোবরের আজকের দিনে তাকে হত্যা করা হয়। আজ তাঁর ৫১তম মৃত্যুদিন। লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী ইতিহাসের উজ্বল নক্ষত্র চে গুয়েভারার মৃত্যু হলেও আজো তিনি অমর। মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের অকৃত্রিম গভীর শ্রদ্ধা।

চে গুয়েভারা ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা আর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ ও মাতা সেলিয়া ডে লা সেরনা। আর্জেন্টিনার প্রথা অনুযায়ী বাবার নামানুসারে রাখা হলো তাঁর নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা। রোজারিও ডি লা ফেতে নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগে জন্ম নেওয়া নবজাতক পেল আরও দুটি নাম আর্নেস্তো এবং তেতে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য চে গুয়েভারার শিরায় একই সঙ্গে বইছিলো আইরিশ ও স্পেনিস রক্ত। তাঁর মা সেলিয়া ছিলেন স্পেনিয় এবং আমেরিকান রক্ত বইছে এমন এক অভিজাত জমিদার পরিবারের মেয়ে। পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন জৈষ্ঠতম। ছোটবেলা থেকেই তার চরিত্রে অস্থির চপলতা দেখে তার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে আইরিস বিদ্রোহের রক্ত তার এই ছেলের ধমনীতে বহমান।খুব শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্রদের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তাঁর ভিতর তৈরি হতে থাকে। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার করনে খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন।


(কিশোর বয়সে গুয়েভারা (বামে) তার পরিবারের সাথে। বাম থেকে ডানে: মা, বোন, রবার্তো, জাউন মার্টিন, বাবা এবং মারিয়া)
চে’ ঘুরে বেড়াতে দারুন ভালোবাসতেন। তিনি ল্যাটিন আমেরিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোতে গিয়ে সে দেশের জনগণের জীবনযাপনের মান, তাদের দারিদ্রতা, নিপীড়ন, বর্ণ বৈষম্য নীতি এবং পরাধীনতার গ্লানিকে নিজ চোখে দেখে বিচলিত হতেন। এসব দেখতে দেখতেই তাঁর মনে একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিলো যে, এদের এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে বিশ্বব্যাপী একটি সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাতে হবে। বিপ্লব ছাড়া তাদের মুক্তির কোন উপায় নেই। মাত্র দু বছরের গেরিলা সংগ্রামের দ্বারাই তিনি কিউবার একনায়ক ব্যাতিস্তা সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হন ।
প্রথমত চে গুয়েভারা একজন গেরিলা নেতা। শোষণহীন সমাজ গড়ার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ হিসেবেই তার বড় পরিচয়। পুরো নাম আর্নেস্তো গেবারা দে লা সেরনা। সাধারণের কাছে তিনি শুধুই চে, কিংবা চে গুয়েভার (চে গেবারা)। স্প্যানিশ ভাষায় ‘চে’ অর্থ প্রিয়। কিউবায় সফল বিপ্লবের পর সেখানকার মানুষ অনেক ভালোবেসে তার নাম দেন ‘চে গেবারা’, যার অর্থ ‘প্রিয় গুয়েভারা’। আজ শুধু কিউবায় নয়, পৃথিবীর শত কোটি মানুষের হৃদয়ে তার বসবাস।

১৯৫৯ সালে বছরের শুরুতেই অবস্থা বেগতিক দেখে দেশ ছেড়ে পালায় কিউবার প্রেসিডেন্ট বাতিস্তা। বিপ্লবী দলের কমান্ডার চে গুয়েভারার নেতৃত্বে কিউবার রাজধানী হাভানায় প্রবেশ করে বিপ্লবীরা। অভূতপূর্ব আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে তাদের বরণ করে নিলো গোটা কিউবার আমজনতা। দীর্ঘায়িত হলো নতুন বছরের উদযাপনী উৎসব। চে’র বয়স তখন ত্রিশ বছর। কিউবায় বিপ্লবের সফল সমাপ্তির পর কিছুকাল তিনি শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর কিছুদিন অন্তরালে থাকার পর প্রথমে কঙ্গো, পরে ১৯৬৬ সালের অক্টোবর মাসে বলিভিয়ায় সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেন। কিন্তু সাম্রারাজ্যবাদীরা তাকে হত্যা করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার এক পর্যায়ে সিআইএর সহায়তায় বলিভিয়ান সেনাবাহিনী এক গেরিলা ক্যাম্প থেকে চে-কে আটক করে। এর দুইদিন পর ৯ অক্টোবর বিকেলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে চে গুয়েভারা সৈনিকদের বলেছিলেন. '"আমাকে গুলি করো না, আমি চে গুয়েভারা। আমাকে মেরে ফেলার পরিবর্তে বাঁচিয়ে রাখলে তোমাদের বেশি লাভ হবে।" কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। সারারাত বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামের একটি স্কুলঘরে আটকে রেখে তাকে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকারী ছিলেন বলিভিয়া সেনাবাহিনীর মদ্যপ সার্জেন্ট মারিও তেরান। চে-কে ধরা ও হত্যা করার পেছনে কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। মৃত্যুর পরপরই তিনি বিশ্বজুড়ে বিপ্লবীদের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন। তাকে হত্যার পেছনে লাতিন আমেরিকার একনায়ক শাসক আলফ্রেদো ট্রয়েসনারের হাত ছিল বলে তথ্য দিয়েছেন প্যারাগুয়ের গবেষক মার্টিন আলমাদা। কারণ' চে' তার বিরুদ্ধেও গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারেন বলে তার ভয় ছিল।

অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সারা বিশ্বে চে এখনও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, অনেক বেশি জাগ্রত। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, প্রতিবাদে ও সংগ্রামের রক্তধারায় মিশে আছেন চে গুয়েভারা। সারাজীবন এক আদর্শে অবিচল ছিলেন তিনি। তার আদর্শই তাকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ প্রতীকে পরিণত করেছে। নিঃসন্দেহে স্বপ্নবান চে গুয়েভারা বর্তমানে পৃথিবীজোড়া প্রতিবাদের এক জ্বলন্ত বাতিঘর। মানুষের জাগরণে অনুপ্রেরণা, প্রণোদনা হয়ে প্রতিদিনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি। শুধু লাতিন আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের বিপ্লব, বিদ্রোহ ও উত্থানের আরও শক্তিশালী সহযাত্রী হয়ে ফিরে এসেছেন আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। চিকিৎসক থেকে বিপ্লবী হয়ে ওঠার জন্য তিনি যে শক্তি অর্জন করেছিলেন তার উৎস ছিল দেখা এবং পড়া। আর এর চেয়েও বড় শক্তির উৎস ছিল মানুষের জন্য ভালোবাসা। মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছিলেন বলেই তিনি আজ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে যাচ্ছেন আরও বেশি। তার বিপ্লবী দর্শনকে স্বাগত জানাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের বীরুদ্ধবাদী মুক্তিকামী মানুষ। গেরিলা অভিযানের কাহিনী নিয়ে লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য বইঃ ১। রেমিনিসেন্স অব দি কিউবান রেভ্যুলেশনারি ওয়্যার, ২। ‘ম্যান অ্যান্ড সোশালিজম ইন কিউবা’, ৩। গেরিলা ওয়্যারফেয়ার।
আজ, অর্থাৎ ৯ই অক্টোবর মহান বিপ্লবী নেতা “চে গুয়েভারা”র মৃত্যু দিবস। বিপ্লবের বরপুত্র আর্নেস্তো চে গুয়েভারার ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।

নূর মোহাম্মদ নূরু
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৪:০২
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×