জাদুবাস্তবতার তুলিতে ইউরোপীয় সাহিত্যকে যিনি উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত করেছেন তিনি গুন্টার উইলহেম গ্রাস। এই কীর্তিমান লেখক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী। তিনি তার গল্প,কবিতা, নাটক, চিত্রলেখ, চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্যে নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তার প্রথম উপন্যাস টিন ড্রাম।১৯৫৯ সালে এ উপন্যাসটি প্রকাশের মধ্যদিয়েই তিনি বিশ্বসাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। সেদিনই সাহিত্যপ্রেমীরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তার লেখক প্রতিভাকে। টিন ড্রাম উপন্যাসটি তাকে পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি এনে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাস মায়া ও বাস্তব মেশানো। এই উপন্যাসের ভাষা ঝরঝরে হলেও চরিত্রগুলো বেশ জটিল এবং মানব মনস্তত্ত্বের এক অভিনব সমীকরণ। যা পাঠককে পেঁৗছে দেয় ভিন্ন এক জগতে। দ্য টিন ড্রাম উপন্যাসটি নিয়ে একই নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে যা ১৯৭৯ সালে পাম ডি’অর এবং সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর আরো দু’টি নন্দিত উপন্যাসের নাম ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস’ ও ‘ডগ ইয়ার্স’। গুন্টার গ্রাস ছিলেন রাজনীতি ও সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব। নানা সামাজিক অসঙ্গতি ও প্রান্তিক পরিস্থিতি তার লেখায় সফলভাবে উঠে এসেছে। তার লেখা সবসময় বামপন্থী রাজনৈতিক লেখা হিসেবে ধরা হয়ে থাকে এবং তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ জার্মানির একজন সক্রিয় সমর্থনকারী। তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর তীব্র সমালোচক ছিলেন । তিনি মনে করতেন, বুশ এই যুদ্ধের নামে ধর্মকে ব্যবহার করছেন। ইসরাইলের সমালোচনা করে ২০১২ সালে ‘হোয়াট মাস্ট বি সেইড’ নামের একটি গদ্য-কবিতা লেখেন। ইসরাইলে তখন তাঁর বিরুদ্ধে অ্যান্টি-সেমিটিজমের (ইহুদিবাদ-বিদ্বেষী) অভিযোগ এনে তাঁকে ইসরাইলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিংবদন্তি সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস আর আজ ৯১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৭ সালের আজকের দিনে তিনি পোল্যান্ডের গদানস্ক শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন গ্রাস। ১৯৮৬ ও ২০০১ সালে দুবার ঢাকায় আসেন তিনি। মানবতাবাদী ও প্রগতিবাদী কন্ঠস্বর, জার্মান সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার, ভাস্কর গুন্টার উইলহেম গ্রাস এর ৯১তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
গুন্টার উইলহেম গ্রাস ১৯২৭ সালের ১৬ অক্টোবর বাল্টিক বন্দরের ডানজিশ নগরীতে (বর্তমান পোল্যান্ডের গদানস্ক) জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মস্থান ডানজিশ শহরের সঙ্গে গুন্টার গ্রাসের ছিল অস্থিমজ্জার সম্পর্ক। জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ড ও এই শহরের শৈশবের স্মৃতিচারণ করেই রচনা করেন বিশ্বখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য টিন ড্রাম’। ১৯৪৫ সালে ১৬ বছর বয়সে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। এর আগে করেছেন পাথর খোদাই শিল্পের কাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের সেনাবাহিনীতে ট্যাংকের গানার হিসাবে কাজ করেন কিশোর গ্রাস। তখন মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে এক বছর মিত্র বাহিনীর বন্দিশিবিরে আটক থাকেন। ১৯৪৬ সালে সেখান থেকে ছাড়া পান। এরপর কাজ করেন কৃষি খামারের মজুর হিসাবে। এ সময় তিনি কাজের পাশাপাশি বার্লিনের ডুসেলডর্ফ ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউটে চারুকলার ওপর পড়াশোনা করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইউরোপকে ছাপিয়ে তার সাহিত্য দ্রুত বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে ভিন্ন বিষয়বস্তু ও নতুন আঙ্গিকের কারণে। তিনি অদ্ভুত দক্ষতায় কল্পনাকে বাস্তবের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। তার সৃষ্ট সাহিত্যই একটি আলাদা দুনিয়া, এক জাদুকরি জগৎ। জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে তিনি জার্মানির নাগরিকদের ঐতিহাসিক ও অতীতচারী জীবনকে সফলভাবে সাহিত্যে তুলে এনেছেন। জার্মানির মানুষের জীবনের সফল রূপকার হলেও তিনি আমাদের সজ্জন। বাংলাদেশের কথা-সাহিত্যেও তার প্রভাব রয়েছে। তার লেখায় আমাদের মনের কথাও ধ্বনিত হয়েছে। কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভালোবাসা নয়- শৃঙ্খলিত, শোষিত, নির্যাতিত মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অপরিসীম নিখাদ। মানবমুক্তির কথাই তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন। জার্মান সাহিত্যের সঙ্গে এবং একইভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রতি জার্মানদের অনুরাগের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর জার্মান কবি গ্যেটের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ জার্মানিতে গমন করেন এবং সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনের ওপর বক্তৃতা প্রদান করেন। গড়ে ওঠে দুই ভাষা ও দুই সংস্কৃতির মাঝে সম্প্রীতির সেতু, যা আজও অটুট রয়েছে। ইউরোপীয় সাহিত্যের এই জাদুবাস্তবতার শিল্পীর বাংলাদেশকে নিয়েও ছিল আগ্রহ। তিনি ১৯৮৬ সালে সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। একই সময়ে তিনি কলকাতাও এসেছিলেন। ঢাকায় স্বল্প সময় থাকলেও কলকাতায় থেকেছিলেন ৬ মাস। ঢাকা শহরে তিনি রিকশায় ও পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছেন। গ্রাম দেখতে বের হয়েছেন ভোরবেলা। মুগ্ধ হয়েছিলেন জয়নুল আবেদিনের ছবি দেখে। কুমার, তাঁতি ও বস্তিবাসীদের জীবনকেও তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ও সজ্জন। বাংলাদেশের কথা তিনি তার দিনপঞ্জিতে লিখেছেন। তার স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে রাজধানী ঢাকা, লালবাগ কেল্লার পরী বিবির মাজার ও জাদুঘর, বাংলাদেশের গ্রাম এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
বিশ শতকের জার্মান লেখকদের মধ্যে গুন্টার গ্রাসই ছিলেন সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত; তার সাহিত্যকর্মের জন্য যেমন, তেমনি তার ব্যক্তিজীবনের বিশেষ এক পর্বের ভূমিকার জন্যও। জার্মানির অতীত ও বর্তমানের ঘাগুলোর উপর গ্রাস তার আঙুল রাখছেন বলে যেভাবে বিতর্কিত হয়েছিলেন তা আগে আর কোনো জার্মান লেখককেই হতে হয়নি। পৃথিবীর ভণ্ডামির প্রতি তিনি যে ক্রোধ ও শ্লেষ নিয়ে তাকিয়েছিলেন তাও আগে অন্য কোনো জার্মান লেখকদের মধ্যে দেখা যায়নি। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ২০১২ সালের পাঁচ এপ্রিলে তিনি লিখলেন এমন এক কবিতা- ‘যে কথা না বললেই নয়’- যা বিশ্বময় রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। গুন্টার গ্রাসের এই কবিতা নিয়ে বিতর্ক চলেছে মূলত জার্মানি ও ইসরাইলেই বেশি। অভিযোগ করা হয়েছিল এই বলে যে, ইসরাইল রাষ্ট্র ও তার জনগণের প্রতি বিদ্বেষের আগুন উসকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাসের কী করুণ পরিহাস যে-ইহুদিরা জার্মানদের নির্মমতার শিকার হয়েছিল বলে সারা দুনিয়ার সহানুভূতি অর্জন করেছিল, আজ সেই ইহুদিরাই শান্তিপ্রিয় অন্য জাতিগোষ্ঠীর জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে পারমাণবিক শক্তির বলে। এমনকি সাবেক নির্যাতকের সঙ্গেই বেঁধেছে সে শক্তির গাঁটছড়া।
২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন সব্যসাচী নোবেলবিজয়ী লেখক গুন্টার গ্রাস। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮৭ বছর। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জার্মান সাহিত্যের তথা বিশ্বসাহিত্যের একটি অধ্যায় শেষ হয়। সমকালীন বিশ্ব সাহিত্যে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল আলোক শিখা। তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন তার অমর সৃষ্টি যা যুগ যুগ ধরে সাহিত্যবিশ্বে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আজ জার্মানের নোবেল বিজয়ী কিংবদন্তি সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস এর ৯১তম জন্মবার্ষিকী। মানবতাবাদী ও প্রগতিবাদী কন্ঠস্বর, জার্মান সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার, ভাস্কর গুন্টার উইলহেম গ্রাস এর ৯১তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
নুর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৮:৫৬