ফটো ক্রেডিট ; সুনায়না ইসলাম
একজন লেখকের জীবনে পাঠকের ভালোবাসা হলো মহা মুল্যবান গুপ্ত সম্পদের মতো ।একটা বিল্ডিংয়ের শক্ত পিলার গুলোর মতো ।যে কোন দুর্যোগে লেখক কে বাঁচিয়ে রাখে । পৃথিবীতে হাজার হাজার লেখক আছেন নানা ভাষায় । প্রতিটি লেখক তার সময় এবং অভিজ্ঞতাকে নিজের অনুভূতিতে কলমে কিংবা কি বোর্ডে তুলে ধরে । কেউ কেউ হয়তো লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে লিখে ,কেউ মনের আনন্দের জন্য অথবা কেউ কেউ অজানা কারনে । যে হয়তো নিজেও এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে না ।
কবে থেকে আমি গল্প উপন্যাসের পাঠক আমার মনে নেই । তবে মনে আছে আমি বড় বোনের কাছে থাকা সমরেশ মজুমদার , শরৎ চন্দ্র , সমাসেট কিংবা টলস্টয় এর সব বই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম । অদম্য কৌতূহল যা এখনও আছে । এমন করে কৌতূহলী হতে গিয়েই একদিন ভাবলাম এই যে যেমন গল্প আমি পড়ি ঠিক তেমন অনেক কাহিনী আমার অভিজ্ঞতায় । নিজের লেখা ডায়রি থেকে কিছু কিছু নিয়ে একটা গল্প লিখে ইত্তেফাকে দিয়েছিলাম । একদিন সকালে দেখি লেখকের নামের জায়গায় আমার নাম । বার বার নামটা দেখছিলাম ।
এরপর পড়াশুনার ব্যস্ততা । কিন্তু অভ্যাস বলে কথা । ফাঁকে ফাঁকে প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখেই যাই । লেখা চলতে থাকে তিন বেলার খাবারের মতো নিয়ম করে ।
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী অবস্থায় বান্ধবিদের অনুরোধে একটা পান্ডুলিপি জমা দিয়েছিলাম আগামী প্রকাশনীতে । আহা । কোনদিন ভুলবোনা । ধ্রুব দা আমার প্রচ্ছদকারক হয়েছেন । যেমন করে আমি বলেছি ঠিক তেমন করেই করেছেন । আমি একটি সুন্দর বইয়ের মালিক হয়ে গেলাম । এরপর কয়েক মাস পর একদিন দুপুরে শিখা প্রকাশনীর থেকে কল এলো । পান্ডুলিপি জমা দিলাম । একজন নতুন এবং নামহীন লেখক কে ডেকে নিয়ে বই প্রকাশ অনেক ভাগ্যের ব্যাপার ।
পর পর আরও তিনটি বই আমার হয়ে গেল । এরপর অনেক বড় বিরতি ।প্রায় ৯ বছর । অনেক অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবন এগিয়ে যেতে লাগলো । পাখির মত উড়ে উড়ে চলা জীবনে স্থিরতা পেলাম না । কিন্তু সব কিছুর পর মানুষকে কোথাও থামতে হয় । নতুন করে পুরোনো কে ফিরে পেতে । এর মধ্যে সময়ের ইতিহাসে তথ্য প্রযুক্তি লেখার জগতকে অনেক সহজ করেছে । ফেসবুকে বাংলা চলে এল । বাংলায় নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশের শান্তি বুঝাবার নয় । আবার মনে হল একটা পান্ডুলিপি যা আমার সাথে সাথে গ্রাম শহর আর দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা কে কাগজে রূপ দেই ।
সব কিছু ঠিকঠাক । পনেরদিন পার হয়ে গেল । বই নেই শিখা প্রকাশনীর স্টলে । কারন একটা রহস্য হয়ে গেছে । মজার সব নাটকীয়তা । আমি ব্লগে সবার মতো শেয়ার করি আমার উপন্যাস অরোরা টাউন আসছে । সবাই স্টল থেকে ফিরে যায় । তারপর বাতাসের কাছে জানলাম । প্রেস থেকে ফাইনাল কপি হারিয়ে গিয়েছিল । তারপর অনেক ঘটনার পর এই বই মেলায় ২৫ তারিখে আসে ।
আমার ও এমন ধৈর্যশীল পাঠক আছে জানা ছিল না । ফেসবুকে সাহিত্য গ্রুপে পাওয়া কিছু আপু । প্রতিদিন বার বার ফিরে গিয়েও শেষে বইটি কিনে আমাকে জানায় । এর মধ্যে প্রথম পাঠক যাকে কোনদিন দেখিনি । তার নাম সুনায়না ইসলাম ।আমার ফেসবুক বন্ধু ।মেয়েটি প্রচুর পড়াশুনা করে । সে সাহিত্য প্রেমী । আমার বইটি কিনে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে ইনবক্সে আমাকে প্রথম সারপ্রাইজ দেয় । অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া । নানা রকমের মানুষ।নানা রকমের ভাবনা । ক্যান্টনমেন্ট নিবাসী সুনায়নার মতো পুরনো ঢাকার মুক্তা খাগড়া ছড়ির তানিয়া , জাপান প্রবাসী সাকিলা , আমেরিকা প্রবাসী নুসরাত যারা সবাই অপরিচিত । মানুষের আবেগ অনুভূতি গুলোর কাছে সত্যি আমার হৃদয় আপ্লুত হয় ।সব ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা । যা যা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা দিয়ে যায় । নতুন কিছু ভাবতে শেখায় ।
একজন লেখকের জীবনে পাঠকের ভালবাসা আর বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি প্রাপ্তি কিছু হতে পারে না ।যদিও আজকাল লেখা বিষয়টা আর শিল্প সাধনা নয় ।শিল্প বানিজ্যে রূপ নিয়েছে । জানি না এই ধারা অব্যাহত থাকবে কিনা । তবে অনুভব করলাম এত দীর্ঘ সময় দূরে থাকার পরও কেউ কেউ আগের মতোই আছে । আসলে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা নিজ মহিমায় টিকে থাকে । নিয়মিত নিজ উদ্যোগে যখন কেউ বইটির খোঁজ নেয় আমি সত্যি অবাক হই । মনেহয় কি হবে অন্য ক্যারিয়ারের । অন্ন আহার একভাবে হবেই । পুরোটা সময় দেই পান্ডুলিপির কাছে । যদি কোন দিন নিজেকে হারিয়ে ফেলি ।যদি কোন একদিন নিজেকে অজানা কারনে খুঁজে না পাই । হয়তো এই যে পাঠকের ভালোবাসা তা আমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবে । একশত জন পাঠক হয়তো একদিন হাজার হবে । একদিন লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে । আজকাল লেখক হওয়ার একটা ভূত আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় । যে ভূত টা কেবলই পাঠকের ভালবাসা চায় । চাওয়ার এই পথটায় লেখা এক ওষুধ যা হৃদয় কে সুস্থ রাখে । তাই আজকাল সব অসুস্থতার মাঝে আমি হয়তো সুস্থ আছি । সুস্থতা আছে বলেই বেঁচে থাকাটা আছে । নিদারুন পাঠকের ভালোবাসা আছে বলে । নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা আছে বলে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১:২৩