somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ নিকোশিয়া - নুরুন নাহার লিলিয়ান

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গল্পঃ নিকোশিয়া
নুরুন নাহার লিলিয়ান

খুব একটা রহস্যঘেরা সুরে প্রায়ই ও আমাকে নিকষ ,আমার নিকষ বলে কাছে ডাকতো । আমি তখন কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো ওর বুকে লুটিয়ে পড়তাম । ওর ঐ প্রেমের সুরের অজানা রহস্য ভাঙ্গার চেষ্টা করতাম । ওর বুকের ঘ্রান নিতে নিতে জিজ্ঞেস করতাম -
'আমার নাম তো নিকোশিয়া ।তুমি আমায় নিকষ বলে ডাকো কেন?অনেকক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো আমার চোখের দিকে । আর ও একটু কাছে টেনে ধরতো ।তারপর বুকে জোরে এমন ভাবে চেপে ধরতো যে ওর ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রেমের জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিতাম ।দুটি প্রান এক হয়ে যেতাম । কোন এক রহস্যময়ী প্রেমের আকর্ষণে একাকার হয়ে নতুন পৃথিবী বানাতাম । এক সময় শান্ত হয়ে আমার ডান হাতটা নিয়ে নিজের গালে আদর করতে করতে বলতো -'সবার কাছে তুমি নিকোশিয়া ।কিন্তু আমার কাছে নিকষ । মানে আমার কষ্টিপাথর । আমার প্রেমের কষণ চিহ্ন।'
এখন ও মনে হয় গতকাল রাতের দুঃস্বপ্ন ।মিথ্যা এতো সুন্দর হয় ওর সঙ্গে পরিচয় না হলে কোনদিনই হয়তো জানা হতো না ...।
এভাবেই তূর্ণাকে কথা গুলো বলে যাচ্ছিল নিকোশিয়া ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালইয়ের মাস্টার্সের ছাত্রী নিকোশিয়া । রোকেয়া হলের সিঙ্গেল রুমে আছে অনেকদিন । মাস্টার্সের মেয়েরাই সিঙ্গেল রুমে একা একা থাকার স্বাধীনতা ভোগ করে। দিনাজপুরের তূর্ণার হলে সিট হচ্ছিল না । তাই হাউজ টিচারের অনুরোধে তূর্ণাকে নিজের রুমে রাখতে রাজি হয় । ব্যক্তিগত মানসিক বিষয় গুলো বাদ দিয়ে নিকোশিয়া খুব কেয়ারফুল তূর্ণার প্রতি । প্রথমবর্ষে তূর্ণার সঙ্গে সব বিষয়ে শেয়ার করলে ও একটি বিষয় সব সময় এড়িয়ে যেত । কিন্তু হলের বিভিন্ন ব্লকে আছে নিকোশিয়াকে নিয়ে সহস্র কৌতূহল । নিকোশিয়া নাকি বিবাহিতা , এই প্রশ্নটা অনেকেই তূর্ণা কে জিজ্ঞেস করে ।কিন্তু এতো দিন তূর্ণার সাহস হয়নি প্রশ্নটা করার । আজ আচমকাই করে ফেলল ।
' সরি আপু ,আমি আসলে বুঝতে পারিনি।'
'ঠিকই আছে ! যেহেতু প্রশ্নটা করেই ফেলেছো তাহলে পুরো সত্যটা শোন । '
কথাটা বলতে বলতে তূর্ণার মুখোমুখি চেয়ারটাতে বসল ।তূর্ণার ভেতরে ভয় এবং ও জানার অদম্য আগ্রহ এক সঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছে ।
'আপু , এখন আমার খুব খারাপ লাগছে । সত্যি আমি আমার প্রশ্নের জন্যে দুঃখিত । '
' সম্পর্কটা অনেক বছরের হলেও বিয়ের এগারো দিনের মাথায় ভেঙ্গে যায় । এর মধ্যে মাত্র চারদিন আমরা এক সঙ্গে ছিলাম । সেটা ও কক্সবাজার ।ওর বন্ধুদের সহযোগিতায় মগবাজার বিয়ে করে সোজা কক্সবাজার চলে গিয়ে ছিলাম । তোমার আচমকা প্রশ্নের মতোই আচমকাই ঘটনা গুলো ঘটে গিয়েছিল আমার জীবনে ।
প্রথম নতুন একটি জীবন কে স্বাগত জানিয়ে সমুদ্রের কাছাকাছি দাঁড়ালাম । সব কিছুই নতুন আর স্বপ্নময় রঙিন মনে হলেও খুব তুচ্ছ মনে হতে লাগল নিজেকে । চারপাশের সব কিছুই ধূসর এবং অযথা সময়নাশ মনে হতে লাগল । খুব গভীর থেকে উঠে আসা অনুভূতি গুলো নিরবেই সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে ওর হাত ধরে ঢাকায় চলে এলাম । চারটা দিনকে এক মুহূর্তের ঘটনা মনে হতে লাগল । সারাটা পথ নিজেকে বুঝে উঠতে পারছিলাম না । আমি স্বভাবগত দিক থেকে স্বল্পভাষী হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ে ও-ই কথা বলতো । খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারতো ।
আমি শুধু ওর কথাগুলো শুনতাম আর আমার সমস্ত অনুভূতিতে ছড়িয়ে দিতাম । ওকে আমার ভালবাসার কথা শোনানোর চেয়ে অনুভব করতেই ভাল লাগতো । অদ্ভুত শোনাত যখন ও মোবাইলে কথা বলতো । খুব ভরাট কণ্ঠে বলতো - নিকষ ,আমার নিকোশিয়া ...।
বলতে বলতে নিকোশিয়া উঠে দাঁড়াল। পেছনের বারান্দা থেকে কাপড় গুলো রুমে বিছানায় এনে রাখল। একটি কথা ও না বলে কাপড় গোছাতে লাগল ।আপন মনে কাপড় গুছাতে লাগল। হয়তো নিজের মধ্যেই ডুবে গেছে । তারপর তূর্ণাই ফের প্রশ্ন করল,'উনি কি আমাদের ভার্সিটির ছিলেন?'
নিস্প্রান কণ্ঠে নিকোশিয়া বলল ,' না । টেক্সটাইল বিশবিদ্যালয়ে পড়তো। '
নিজের কাপড় গুছাতে গুছাতেই হাল্কাভাবে নিজের বিছানায় তূর্ণার মুখোমুখি বসল ।একটু সময় নিয়ে বলল ,' আমি তো আর কয়টা সাধারন মেয়েদের মতো । এই সমাজে গর্ব করার মতো আমার ভেতরে তেমন কিছুই নেই । তারপর ও কেন যে আমাকে এতো ভালোবাসতো বুঝতাম না ।ভালবাসা !একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলল ,'আমাকে ঢাকায় দিয়ে ও টাঙ্গাইল চলে গেল ।আমিও সাথে যেতে চাইলাম । কিন্তু কোনভাবেই রাজি করানো গেল না ।'
তূর্ণা জিজ্ঞেস করল , ' আপনাদের দুজনের কি বাড়ি একই জায়গায় ছিল?''
'হ্যাঁ । আমাদের দুজনের একই জেলায় বাড়ি কিন্তু আধা ঘণ্টা সময় লাগে ।'
তূর্ণা আর ও কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল ,' তারপর কি হয়েছিল?'
আমাকে ঢাকায় দিয়ে যাওয়ার পর আমি দুই জীবনের পার্থক্য বুঝতে বুঝতে মানসিক দিক থেকে একটু আলাদা অনুভূতি অনুভব করতে লাগলাম । এদিকে ওর কোন খবর নেই । যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছিলাম না । এক দিন যায় । দুই দিন যায় । ওর কোন খবর নেই ।যাওয়ার আগে আমাকে খুব আদর করে বলে গিয়েছিল,'বাসা ম্যানেজ কোন ব্যাপারই না ।ছোট ছেলের পছন্দ বলে কথা ।ফাইনাল অনুষ্ঠানটা ঢাকায়ই করব।'
কত সুন্দর করে স্বপ্ন বুনতে পারতো ! আমি অপেক্ষায় বসে আছি আমার প্রেমের প্রতি বিশ্বাস আর ওর ফিরে আসার দিন গুলোর দিকে তাকিয়ে ।
এগার দিনের মাথায় ও ফিরে এলো । এই কয়দিনে কেমন যেন এলো মেলো হয়ে গেছে । দাড়িগোঁফ পরিস্কার করা হয়নি । চুল গুলো উস্কোখুসকো হয়ে আছে । হাতের একটি কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,' এই ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দাও । বেশি সময় নষ্ট করতে পারব না । সাইন না করলে বাসা থেকে আমার খরচের টাকা দেওয়া হবে না । আমার পড়াশুনা বন্ধ করে দেওয়া হবে ।উফ! আমি আর ভাবতে পারছি না । আমার ক্যারিয়ার!আমার স্বপ্ন!
আমি নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ।কোন কথা না বাড়িয়ে সাইন করে দিলাম । তারপর ...।
হাউমাউ করে করে আর্তনাদ করতে লাগল নিকোশিয়া । হাতের কাপড়টাতে মুখ গুঁজে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল । তূর্ণা বুঝে উঠতে পারল না কি বলা উচিত । চুপচাপ নিকোশিয়ার কাছে এসে বসল ।তারপর নিজের হাতটা নিকোশিয়ার মাথায় রাখল কিছুটা সান্ত্বনা দিতে ।
কান্না থামিয়ে ভাঙা গলায় বলতে লাগল,' একটা বছর শিক্ষা জীবন থেকে হারালাম । ভারসাম্যহীন জীবন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় পাঁচ মাস বিচিত্র অভিজ্ঞার মধ্য দিয়ে কাটালাম । জীবন এতো নিষ্ঠুর!সেই নিষ্ঠুরতা গুলোকেই ভালবাসতে শুরু করলাম । মানুষ হিসেবে অনেক কিছু ক্ষমা করে দিতে হয় । তাই ভালবাসার অবুঝ নিষ্ঠুরতা গুলোকেও ক্ষমা করে দিলাম । '
তূর্ণা জিজ্ঞেস করল,' আপনার সঙ্গে আর একবার ও যোগাযোগ করেনি?'
নির্লিপ্ত কণ্ঠে নিকোশিয়া বলল ,' না । দেড় বছর পর হঠাৎ একদিন নীল ক্ষেতের মোড়ে চলন্ত রিকশায় সুন্দর একটি মেয়ের সঙ্গে ওকে দেখলাম । তখন আমি অনার্স বিল্ডিংয়ে থাকি । চারপাশের সবাই বিভিন্ন রকম মন্তব্য করছিল ।
আমার চিন্তা এমন একটি জায়গায় এসে থেমে গিয়েছিল যে আশপাশ থেকে ছুঁড়ে আসা মন্তব্য গুলো আমার চিন্তাকে আর গতিশীল করতে পারেনি ।আঘাত করে চুরমার করতে পারেনি কষ্টিপাথরকে !'
তূর্ণা আবার ও ফের প্রশ্ন করল ,' তাহলে বিয়ে করেছিল কেন?'
তূর্ণার এই প্রশ্নে নিকোশিয়া উঠে দাঁড়াল । বেশ কিছুক্ষন নিরব রইল।রুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করল আর ও কিছুক্ষন। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে কাছের চেয়ারটাতে আবার এসে বসল । এবং কাছাকাছি মুখোমুখি হয়ে বলতে লাগল ,' বিচিত্র সব বিষয়ের জন্য একটা মানুষের কাছে আরেকটা মানুষ প্রিয় হয়ে উঠে ।তবে নারী সব পুরুষের কাছে একটি কারনেই প্রিয়।কারন সে নারী ,বিয়ে নামক সত্যের চোখ কে ফাঁকি দিয়ে প্রাপ্তির চেয়েও অনেক বেশি কিছু পেয়ে গিয়েছিল। কষ্টিপাথর মূল্যবান হলেও সে যে কালো ।'
একটু করে বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল । ধীর পায়ে রুমের বিশাল আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল । নিজের চোখে চোখ রেখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হাতটা নিজের গালে বুলাতে বুলাতে বলল ,' বুদ্ধি তাকে ক্ষমতা দিয়েছিল সেই ক্ষমতায় জীবন থেকে সে অনেক কিছু আদায় করে নিয়েছিল।আর ভালোবাসা আমাকে উদারতা শিখিয়েছিল তাই জীবন কে ক্ষমা করে দিয়েছি।কারন জীবন সুন্দর ।'
তূর্ণা উঠে এসে নিকোশিয়ার কাছে দাঁড়াল ।গভীর কয়েক ফোঁটা নোনাজল গাল বেয়ে পড়তে লাগল ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৫৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×