সাদা বরফের দ্বীপ।
২০১২ সাল । তখন অক্টোবর মাস ।ব্যাংকে চাকরি করি আর সেই সাথে বিসিএস পরিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনা শেষ করেছি । বিসিএস ক্যাডার না হলে সমাজে কেমন যেন নিজেকে বেমানান মনে হবে । তাই বেগতিক পড়াশুনো ও চলছিল। অবশ্য এই সব বাধা ধরা পেশায় যাওয়া আমার একদম ইচ্ছে নেই । সব পরিবারের ইচ্ছে । আমার ইচ্ছে নিজেকে গবেষণা পেশায় সম্পৃক্ত করা । আর ও একটা লুকানো স্বপ্ন আছে অনেক বড় লেখক হওয়া । বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে থাকতে তিনটি উপন্যাস ও প্রকাশ হয় । কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি কেমন যেন আমার চলার পথ কে কোথাও কোথাও অবরুদ্ধ করে রাখে ।সেই সাথে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রায় প্রতিদিন উত্তপ্ত হয়ে উঠে ।নানা কারনে মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকতো । গভির বিষণ্ণতা আমার মনের ভেতরটা এলোমেলো করে রাখতো ।তখন কেন জানি হাজার ব্যস্ততার মাঝেও ফেসবুকে জীবনানন্দ দাসের কবিতা পোষ্ট করতে ভুলতাম না । নিজের চোখের সামনে থাকা চেনা আটপৌরে জীবন । আর সে জীবনের একঘেয়েমি নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা প্রবাহ কেমন অস্থির করে রাখতো । মনে হতো দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। এই চেনা জীবন থেকে অনেক দূরে । বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে ।
তখন বাসা থেকে বিয়ের জন্য পাত্র ও খোঁজা হচ্ছে । দু'চারজন জুনিয়র সিনিয়র বায়বীয় প্রেমে ও হাবু ডুবু খায়। একজন সুন্দরি অবিবাহিতা মেয়ে কর্পোরেট কালচারে একটু আলোচনার পাত্রীই থাকে । আমার পাশের চেয়ারে বসা পুরুষ কলিগটি প্রায়ই কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞেস করতো এমন করে ,' মিস বিনীতা , আচ্ছা আপনি তো যথেষ্ট সুন্দরি এবং যোগ্য । তারপর ও কেন দেরি করছেন?'
আমি হেসে বলতাম ,'মন জয় করার মতো ,বিশ্বাস করার মতো কেউ আসুক ।'
সামনেই ডিসেম্বর মাস । ব্যাংকের হিসাব নিকাশের অনেক জটিল ঝামেলা আর ব্যস্ততা । সারাদিন কর্ম ব্যস্ত জীবন শেষে বাসায় ফিরে ফেসবুকটা যেন ছিল এক অজানা রহস্যময় আকর্ষণ । অনেক মেসেজ আর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অপেক্ষায় ছিল । এমনি এক নিঃসঙ্গ রাতে ফেসবুকে দেখলাম তুহেল ভূঁইয়া নামের একজনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট । কৌতূহল বশত আইডিটা দেখলাম । দুজন মিউচুয়াল ফ্রেন্ড ও আছে । তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন সহজ সরল প্রোফাইল থেকে সহজেই সংগ্রহ করে নিলাম । ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহন করার পনের দিন পর একটা মেসেজ এল ,' আপনি হয়তো আমাকে চিনবেন না । কিন্তু আমার পরিচিত একজন কে চিনবেন ।যাইহোক আপনার আপডেট গুলো সুন্দর । "
আমি ইচ্ছে করেই দুই দিন পর উত্তর দিলাম ,' কোন আপডেটের কথা বলছেন?'
তুহেল জানাল ,' ওই যে জীবনানন্দ দাসের কবিতার বই নিয়ে দূর দ্বীপে হারিয়ে যেতে চান। আমি কিন্তু এমন এক দূর দ্বীপে বসবাস করছি । হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি। '
আমি মনে মনে হাসি । তারপর উত্তর দিলাম ,' গবেষণা ছেড়ে ফেসবুকে পড়ে থাকলে তো গবেষণায় ভাল রেজাল্ট পাবেন না ।'
তুহেল হাসির ইমুজি দিয়ে লিখে ,' ঠিক বলেছেন । তবে এতো সুন্দর সুন্দর আপডেট দেন । মন বাংলাদেশে চলে যায় । '
এমন করে প্রায়ই আমাদের কথা হয় । ফেসবুক চ্যাট থেকে সরাসরি মোবাইলে কথা বলা শুরু হয় । প্রতিদিন অফিস থেকে বের হয়েই আগে রেডিও ফুর্তি শুনতাম । ওর সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাসায় ফিরি । কেমন করে যেন নিত্যদিনের রুটিন পাল্টে যেতে লাগল । ওকে ঘিরেই ছোট ছোট সুখ ভিড় করতে লাগল ।
একদিন আমাকে ও জিজ্ঞেস করে ,' আপনার এস এস সি কবে?
আমি খেয়ালের বশে উত্তর দিলাম ,' ভাইয়া আমি তো বুড়ি । সেই ১৯৯৯ সালের কাহিনি ...।
তুহেল ও যেন মজা পেল । ও সাথে সাথে বলল , ' আমি তো আর ও বুড়া ।আমার ইতিহাস ১৯৯৪ সালের। '
আমি বললাম ,' তারমানে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি । তখন আপনি বিদায় নিয়েছেন । '
তুহেল জানায় ,' অনেকটা তাই । তবে কলা ভবনে কম যাওয়া হতো । আমি ছিলাম শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র '
আমি বললাম ,' আমি ছিলাম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের । ভাল লাগল ভাইয়া আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ।'
হঠাৎ তুহেল কেমন করে যেন বলল ,' এতো ভাইয়া ভাইয়া করবেন না তো !'
আমি অবাক হলাম । তারপর বললাম ,' আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইয়া। সমস্যা তো দেখছি না ।'
একটু চুপ থেকে বলল,' নাহ! কোন সমস্যা নেই । আচ্ছা বিয়ে করবেন না ?'
আমি মজা করে বললাম,' আমার মতো গরীব মানুষকে কে বিয়ে করবে?'
তুহেল হা হা হা করে হেসে উঠে । তারপর বলে ,' একজন ব্যাংকার যদি গরীব হয় । তাহলে আপামর জনতার কি হবে !'
আমি বললাম ,' কিভাবে বুঝলেন আমি ব্যাংকে চাকরি করি ?'
তুহেল বলল ,' আপনার ফেসবুকের সব ছবি চেক করেছি ।ব্যাংকের বিভিন্ন প্রোগ্রামের ছবির সাথেই লোকেশন লেখা আছে '
আমি দুষ্টুমি করে বলি ,' বাহ! আপনি তো দেখছি আমার প্রোফাইল অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখেছেন ?'
তুহেল বলে ,' আমরা গবেষক মানুষ । আমাদের সব কিছুই খুব গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে হয় ।"
আমি বললাম ,' তো আমার কি কি বিষয় বিশ্লেষণ করলেন ?'
তুহেল বলে ,' আপনাকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পেলাম কোথায় ? তবে আপনার প্রোফাইল এবং একটিভিটি বিশ্লেষণ করেছি । তাই একটা সিদ্ধান্তে উপনিত হলাম । '
আমি জিজ্ঞেস করি ,' কি সিদ্ধান্ত নিলেন ?'
তুহেল জানায় ,' সিদ্ধান্ত যাই হোক । আমি টিকেট কেটে দেই আপনি আপনার পছন্দের সাদা বরফের দ্বীপে চলে আসেন ।'
আমি হাসতে হাসতে খুন হই । তারপর স্থির হয়ে বলি ,' কল্পনা , স্বপ্ন আর বাস্তবতা অনেক আলাদা । '
তুহেল সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে ,' সত্যি বলছি । আজকে এখানে প্রচুর তুষারপাত হচ্ছে । নভেম্বরের গভীর তুষারপাত । পুরো হোক্কাইডো দ্বীপটা সাদা বরফের পবিত্র ছোঁয়ায় বিস্ময়কর আর স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে । '
আমি অনুভব করলাম ওর কথা গুলো আমাকে কেমন হীম শীতল করে তুলেছে । তারপর স্বাভাবিক মজা করে বললাম ,' আপনি ল্যাবে গবেষণা না করে কবিতা লিখছেন নাকি ?'
ওপাশ থেকে তুহেল বলে ,' কবিতা লিখতে জানি না । তবে আপনার মতো কাব্য প্রেমিক কাউকে পাশে মিস করছি ।'
এমনি করে প্রতিদিনের গল্প গুলোর গভীরতা বাড়ে । চেনা জানার সীমা পরিসীমা অতিক্রম করে । একান্ত ভাল লাগা আর বিশ্বাস আস্থার অনুভূতি গুলো পুঞ্জিভূত হয়ে ওপাশের মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে ।ওপাশের মানুষটা ও সকল বাধা আর প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে আমাকে কে জীবনের অংশ করতে চায় । ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখটা পৃথিবীতে ভালোবাসার যাদু নিয়ে অবতরন করেছিল । মানুষের মনে ভীষণ এক কৌতূহল আর রোমাঞ্চ এঁকে দিয়েছিল । টিভি ,পত্রিকা আর লোকমুখে ম্যাজিক ডে ১২/১২/২০১২ কে স্বাগত জানাতে ভিন্ন প্রস্তুতি । নিত্যদিনের মতোই সেদিন আচমকা আমি ব্যাংকের কাজে ব্যস্ত আর ওপাশের তুহেল কনফারেন্সে নিজের গবেষণা কর্ম তুলে ধরার কাজ নিয়ে ব্যস্ত । তারপর ও আমার সাথে এক মুহূর্ত কথা কিংবা মেসেজ আদান প্রদান না হলে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় । কোন কাজে মন বসে না ।
তুহেল সকাল সকাল মেসেজ দিল,' ম্যাজিক ডের শুভেচ্ছা ।চেনা পৃথিবীর ভিন্ন ইতিহাস!কেমন উপভোগ করছেন ?'
আমি যেন মেসেজের অপেক্ষায় ছিলাম ।ঝটপট উত্তর লিখে ফেললাম ,' শুভ সকাল । এখন জাপানে কয়টা বাজে ?'
তুহেল বলল ,' তিন ঘণ্টা পার্থক্য । এখানে প্রায় ১২ টা বাজে । সেই সাথে আমার ও ১২ টা বেজে যাচ্ছে । '
আমি বললাম,' কেন বলুন তো ?'
তুহেল মেসেজ দিল,' কি আর ! একদিকে রিসার্চ নিয়ে মারাত্মক ব্যস্ততা ।অন্যদিকে এই শীতে মন পুড়ে অঙ্গার । আজ কতো কতো জুটি হবে । আমার মনের মানুষ আছে কিন্তু কিছুই করতে পারছি না ।'
আমি মজা করে বললাম,' সাহস করে বলে ফেললেই পারেন । ভীতু হলে কিছুই জুটবেনা । '
অনেকক্ষণ পর তুহেল লিখেছে ,' ফর দ্য গড সেক আমি আপনাকে কবুল বলতে চাই । কবুল কবুল কবুল ...।আমার এখন প্রেজেন্টেশন । অপেক্ষায় !'
আমি দুই ঘন্টা নিশ্চুপ কাজ করলাম । কোনভাবেই মোবাইলের দিকে তাকালাম না । তারপর লাঞ্চ টাইমে মোবাইল বের করে অদ্ভুত খেয়ালে' কবুল ' লিখে মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম ।
মানুষের জীবনটা হয়ত এমন অদ্ভুত খেয়ালেই চলে অজানা পথে । পারিবারিক ভাবেই আলোচনা এগিয়ে গেল । শ্বশুর কিছু মানুষ সহ দেখতে এসে আংটি পড়িয়ে দিল । স্কাইপি তে বিয়ে হয়ে গেল জানুয়ারিতে ।মার্চ মাসে সেই দূর দেশের সাদা বরফের দ্বীপে দেখা হল দুজনের ।তুহেল ছিতস এয়ারপোর্টে অদেখা স্বপ্নের জীবন সঙ্গী কে নিতে আসে ।
আজ পাঁচ বছর এদেশ ওদেশ দুজনে এক সাথে পাখির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি ।মনের বিশ্বাস আর আস্থাই পৃথিবীর সব অবাস্তব কে বাস্তব করে তোলে ।অসম্ভব আর অবিশ্বাসের দুহাতে ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দেয় ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:৪৬