somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একদিন জাপানি আইনুদের গ্রামে (পর্ব-২)-নুরুন নাহার লিলিয়ান

১৮ ই মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৪:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একদিন জাপানি আইনুদের গ্রামে (পর্ব-২)

আইনুদের দাস দাসী করতে বাধ্য করার এই মানসিকতাকে অনেক প্রগতিশীল জাপানিরাই অনেক সমালোচনা করেছে।যা কখন ও মানবিকতা কিংবা ন্যায় নীতি কে অনুসরণ করে না ।অনেক সমালোচনার পর ও কেন জানি এই জাতিরা মানুষেরা সব দিক দিয়ে নিগৃহীত ।
সকাল প্রায় নয়টার দিকে আমরা হোক্কাইডোর শিরাওগুনের আইনুদের গ্রামে পৌঁছে যাই । গাড়ি থেকে নামার পরই সকালের মে মাসের রৌদ্রের আর শীতল হাওয়ার অন্যরকম ভাল লাগার আবহাওয়া মন কে প্রফুল্ল করে তুলেছিল ।হোক্কাইডোর সাপ্পোরো শহর থেকে শিরাওগুন আইনুদের গ্রামে যেতে এক দেড় ঘণ্টার সময় প্রয়োজন হয় । বাস , ট্রেন , শিনকানসেন বা স্পিডি ট্রেনে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না । নিজেদের গাড়ি থাকলে খুব আরামেই স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশ দেখতে দেখতে পৌঁছে যাওয়া যায়। আমরা খুব সকালে রওয়ানা করলেও মাঝ পথে জাপানি ট্রাডিশনাল পান কেক রেস্তরাঁয় সকালের ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছিলাম ।






চোখ জুড়িয়ে গেল আইনুদের নিস্তব্ধ সুন্দর পরিকল্পিত ভাবে সাজানো গ্রাম দেখে ।আমাদের জাপানী দাদী বরাবর আমাদের তাঁর নিজের মতো গাইড করতে ভালোবাসে । তিনিই প্রবেশদ্বারে দাড়িয়ে টিকেট কাটলেন ।টিকেট এর সাথে তিনি কিছু ইংরেজিতে লিফলেট এবং পর্যটকদের জন্য তৈরি গাইড বুক নিয়ে এলেন ।
খুব বেশি পর্যটকদের সমাগম না থাকলেও মুটামুটি বেশ কিছু বিদেশী পর্যটক দেখা গেল ।
প্রবেশদ্বারের সামনেই বড় একটা আইনুদের গ্রামের গাইড ম্যাপ আছে ।
আমাদের দাদী মিসেসে চিয়ো সাইতো সবার হাতে গাইড বুক এবং লিফলেট দিলেন । আমরা নিয়ম অনুযায়ী লাইন ধরে ঢুকলাম । ঢুকতেই ডান দিকে বিশাল এক স্টাচু । ধারনা করা হয় কোন এক আইনু লিডারের মুখায়বই স্টাচু করা হয়েছে । কিছুদুরেই এক ভাল্লুকের স্টাচু । সবাই ভাল্লুক দেবতার সাথে ছবি তোলা শুরু করলাম । এখন ও ভাবলে মন ভাল হয়ে যায় । কিছু সুখের ভ্রমন প্রতিটি মানুষকে দুঃসময়েও সুখের স্মৃতি হয়ে আগলে রাখে । মন কে একাগ্রতা আর শক্তি দেয় । সেই সব সুখের স্মৃতি ভেবেই অনিশ্চিত জীবন পার করে দেওয়া যায় ।









এর নিচেই আরও একটি ম্যাপ । এরপর সারিতে সারিতে ঐতিহ্যবাহী আইনুদের ঘর । এখানে প্রতিটি ঘরের আলাদা আলাদা নাম আছে । সেই ঘর গুলোতে আইনুদের নানা রকম আচার অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্য তুলে ধরার আয়োজন চলে । বিগ হাউজ , নেক্সট হাউজ , ফোর হাউজ , ফুঁড স্টোরেজ , স্মল হাউজ সহ খুব সুন্দর সব নান্দনিক ডিজাইনের ঘর । এর সাথে আছে আইনু মিউজিয়াম , বাম পাশে বয়ে গেছে শিরাও পরতকান লেক । এই লেক ঘিরে আছে শিহরণ জাগানিয়া সব লোক কথা বা মিথ । এর পাশেই ক্যাফে আর ফটো কর্নার । আমরা একটু একটু করে গ্রাম দেখতে ভেতরে ঢুকলাম ।
আনন্দে মন ভরে গেল । যখন আইনু কন্যারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে এই ঘর থেকে অন্য ঘরে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল । আমাদের দেখে কয়েকজন আইনু কন্যা হাসি মুখে খুব আন্তরিকতা নিয়ে অভ্যথনা জানাল । জাপানি ভাষায় মিসেস চিয়ো সাইতো তাদের সাথে বেশ কিছুক্ষন তাদের ভাল মন্দ জানার চেষ্টা করল । তাদের বর্তমান নানা সমস্যা নিয়ে জানতে চাইল । কারও কারও চেহারায় বিষণ্ণতার ছায়া ।





ওদের সাথে কথা বলার পর দাদী আমাদের জানাল , " পর্যটক তেমন নেই । গ্রীষ্মকালে পর্যটক এলেও শীতের সময়টা তাদের খুব খারাপ কাটে । "
আমি জিজ্ঞেস করলাম ," তাহলে ওদের অর্থনৈতিক সাপোর্টটা কে বা কারা করে ।"
মিসেস চিয়ো সাইতো জানাল ," তাদের আয়ের উৎস পর্যটক । এক সময়ে তারা শিকার আর মাছ ধরা ছিল আয়ের অন্যতম উৎস । এখন কিছু আইনু তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে । "
আমার বর জিজ্ঞেস করল , " জাপান সরকার তাদের কোন সহযোগিতা করেনা ?"
সঙ্গে সঙ্গে দাদা রিউহে সাইতো মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দিল ," নো নো । জাপানিরা তিন বার আইনুদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে । তাদের সব জমি জাপানিদের দখলে আছে । আইনুদের জাপানিরা পছন্দ করেনা । "
আমি জিজ্ঞেস করলাম ," কিন্তু কেন ?"
খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে চিয়ো সাইতো বলল ,' আইনুরা জাপানে লুকানো জাতি । তাঁরা জাপানে বসবাস করলেও তাদের জীবন এবং সুযোগ সুবিধা জাপানিদের মতো না । জাপান তাদের নাগরিক মনে করেনা ।"
আমার মনটা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হল । জাপান দেশটা কে ভাল জানতাম । এখানেও সংখ্যা লঘুদের সাথে বৈষম্যমুলক আচরন হয় । সকল মনের ভার কমিয়ে দেয় অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ,আইনু কন্যাদের গায়ের রঙ্গিন সব পোশাক , মুখের উৎফুল্ল হাসি ।
কথা বলতে বলতে আমরা বিগ হাউজের ভেতরে ঢুকলাম । সেখানে তাদের নানা রকম আচার অনুষ্ঠান , নৃত্য এবং সংস্কৃতি অতিথিদের সামনে তুলে ধরা হয় । ঘরে ঢুকেই দেখলাম ছোট একটা ষ্টেজ । দর্শকদের জন্য বসার নির্ধারিত জায়গা আছে । মাথার উপরে অসংখ্য শ্যামন মাছে শুঁটকি দিয়ে সাজানো । ঘরের দেয়ালে দেয়ালে নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ছবি, তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক আর জিনিস পত্র দিয়ে সাজানো । শুধু তা নয় তাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের বর্ণনা ও দেওয়া আছে ।





আমি পড়তে থাকলাম । এ যেন জাপানিদের এক বিস্ময়কর লুকানো ইতিহাস । অন্তরালে এই ইতিহাস পৃথিবীর সব মানুষের কানে পৌঁছায়নি ।
পুরো ঘরটার দেয়ালের সেঁটে রাখা লেখা গুলো আইনু ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে ও বর্ণনা থাকায় সুবিধা হয়েছে ।
সেই সাথে আমার হাতের গাইড বুকে থাকা আইনু ইতিহাস সংস্কৃতি নিয়ে ছোট ছোট বর্ণনা পড়ে
হত বিহ্বল হয়ে গেলাম ।
আর কিছুক্ষন পরই ষ্টেজে আইনুদের নাচ শুরু হবে । দর্শকসারির সীটে গিয়ে বসলাম । অনেকটা
ভারতীয় রাজাদের পোশাকের আদলে পোশাক পরা একজন আইনু পুরুষ এলো মাইক হাতে । সে জাপানি ভাষায় আইনুদের জীবন ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত তুলে ধরল ।
এইদিকে মিসেস চিয়ো সাইতো পাশে বসে আমাকে ফিসফিস করে বলল ,"উনার সব কথার বর্ণনা গাইড বুকে ইংরেজিতে আছে । "
আমি খুশিতে আধখানা হয়ে বললাম ," অহ! রিয়েলি ।ধন্যবাদ ।"
কিছুক্ষন পর একটা ভাল্লুক মেরে কাঁধে করে আগুনের সামনে নিয়ে এল । সবাই মুখে কি যেন বলে । যদিও আসল ভাল্লুক না । শুধু দর্শকদের তাদের সংস্কৃতি দেখানোর জন্য কৃত্রিম বানানো ভাল্লুক মেরে দুজন ব্যক্তি নিয়ে আসে । সেই ভাল্লুক কে ঘিরে এক দল আইনু কন্যা নিজেদের ভাষায় গান গেয়ে নেচে আনন্দ করল । বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠান করল ।
বিষয়টা বেশ কৌতূহল উদ্দীপক এবং উপভোগ্য ।

জাপানে আইনুরা আদি উপজাতি এবং সংখ্যা লঘু জাতি হিসেবে পরিচিত । তারা সর্বপ্রানবাদী বা অ্যানিমিস্ট । এই উপজাতির মানুষেরা বিশ্বাস করে সকল বস্তুর মধ্যে প্রান আছে । তারা প্রকৃতির সকল কিছুর মধ্যে দেবতার উপস্থিতি কিংবা দেবতা হিসেবে বিশ্বাস করে । তারা মনে করে মহাসমুদ্রের দেবতা তিমি , প্যাঁচারা গ্রামের রক্ষাকর্তা আর ভাল্লুক হল পাহাড়ের দেবতা ।
আইনুরা আরও বিশ্বাস করে ভাল্লুকেরা তাদের মাছ শিকার , জমি চাষ আর কাপড় বুনতে শিখিয়েছে । তারা দেবতার সন্তুষ্টির জন্য ভাল্লুক হত্যা বা বলি দেওয়া হয় অনেক ধরনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে । এই অনুষ্ঠানের মধ্যে "ইয়োমান্তে " একটা বিশেষ পর্ব । এই সময় নাচ গান আর ভোজ পর্ব ও হয় ।
আত্মাদের দেবতার কাছে পাঠানো হয় । শুধু ভাল্লুকই নয় শেয়াল আর প্যাঁচা সহ অন্য প্রাণীদেরও দেবতাদের দেশে পাঠানো হয় । ভাল্লুক বলি দিয়ে মাথাটা আলাদা করে বিশেষ রক্ত পুরুষেরা পান শক্তি অর্জনের জন্য । আর চামড়াটা দূরে রাখা হয় । সেটাকে এমন ভাবে খাবার আর পানীয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয় যেন সেটা জীবন্ত কিছু । সেই চামড়া পরে পারিবারিক অনুষ্ঠান গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
পুরুষেরা ভাল্লুক ধরে আর মেয়েরা তা পালে । কয়েক বছর হলে পরে তা বলি দেওয়া হয় । সব কিছুর মধ্যে ইয়োমানতে কিংবা কাল্ট অফ দ্য বিয়ার হল প্রধান ধর্মীয় উৎসব ।
ওদের আচার অনুষ্ঠান দেখছিলাম । আর মনে মনে হাসছিলাম । কতো বিচিত্র বিশ্বাসে চলে মানুষের জীবন ।
চলবে ......।
আগের পর্ব ১
নিচের লিঙ্কে
http://www.somewhereinblog.net/blog/nurunnaharlilian/30192652
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৩
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×