somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ কাক ডাকা ভোর -নুরুন নাহার লিলিয়ান

২০ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবি সৌজন্যেঃ মুক্তারপুর সেতু

কাক ডাকা ভোরঃ

শহরটা রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরে। তিনটি নদী ঘিরে থাকা একটা দ্বীপ শহর মুন্সিগঞ্জ।রাজধানী থেকে এই শহরে ঢুকতে রংধনুর মতো ধলেশ্বরী নদীর উপর দিয়ে যাওয়া মুক্তারপুর সেতু অতিক্রম করতে হয়। এই সেতু থেকে পনেরো মিনিট গেলে মেঘনা নদী আর পদ্মার স্পর্শে থাকা কয়েকটা ছোট ছোট পাড়া।গল্পটা এই পাড়া গুলোর মধ্যে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাকে নিয়ে। বিভিন্ন পেশার মানুষের বিচিত্র বসতি এই পাড়া গুলোতে। উচ্চ বিত্তের সমাজ নিয়ন্ত্রনে গরীবের জীবন নিয়ে খেলার এক পরিচিত দৃশ্যপট ।মধ্যবিত্ত যখন পরিশ্রম আর শিক্ষার সমন্বয়ে সমাজের সম্মুখে থাকে। তখন উচ্চ বিত্তের এক শ্রেনী তা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না। মধ্য বিত্তের এগিয়ে যাওয়ার পথকে বন্ধুর করতেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অশিক্ষিত প্রান্তিক শ্রেনীর জীবন।

তেমন এক প্রান্তিক পরিবারের ছেলে সুজন।বাবা মারা যাওয়ার পর এক বছর হল বিধবা মা কে নিয়ে সদরের সবুজ পাড়ায় কামাল সাহেবের ছোট বাসায় ভাড়া নেয় । কৃষি কাজ ছেড়ে দিয়ে সদরের কাচারি ঘাটে একটা চায়ের দোকানে অর্ধ বেলা কাজ নেয় ।দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে কাজ করলেও সকালে সে খবরের কাগজ বিলি করে ।আবার এলাকার কেউ যদি কোন কাজ করে দিতে বলে যেমন বাসা পরিবর্তন হলে জিনিস পত্র পৌঁছে দেওয়া , কার ও কারেন্ট বিল দিয়ে দেওয়া , কিংবা বাসা বাড়ির পানির লাইন বিদ্যুতের কিছু নষ্ট হলে সুজন কেই সবাই ডাকে । কারন কম মুল্যে হাতের কাছে সুজন কেই পাওয়া যায় । বাড়তি পয়সার জন্য এই টুকটাক কাজ করে কোন রকমে দিন যাপন করে । ওদিকে বাড়ি ওয়ালা কামাল সাহেব একই এলাকার একটি সরকারী দপ্তরে দীর্ঘদিন হিসাব রক্ষনের কাজ করেছেন । ভদ্রলোকের পাঁচ ছেলে মেয়ে । এই মফস্বলের নানা জটিলতা আর প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সব কয়টা ছেলে মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।

বড় ছেলে আর দুই মেয়ে দেশের বাইরে থাকে । ছোট এক ছেলে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার । সে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকে ।।আরেক মেয়ে নারায়ণগঞ্জ থাকে স্বামী সন্তান নিয়ে ।অবসর প্রাপ্ত কামাল সাহেব বৃদ্ধ স্ত্রী কে নিয়ে তার এই মফস্বলের বাড়িতেই থাকে । বছর দশেক আগে অবসরে গেলে পেনশনের টাকা দিয়ে শহরের বুকে এক খণ্ড জমি কিনে বসতি করে । নারায়নগঞ্জের পৈত্রিক বাড়িতে আর ফিরে যায়নি ।ঘরে অসুস্থ স্ত্রী জোবেদা খাতুন কে নিয়ে কামাল সাহেবের দিন গুলো ভাল মন্দে কেটে যাচ্ছিল ।সুজনের মা ও টুকটাক কাজ করে দেয় ।
হঠাৎ কোন একদিন এক কাক ডাকা ভোরে মুন্সিগঞ্জ শহরের বাতাস কেমন রক্তাক্ত আর ভারী হয়ে উঠল । বাজারের সব দোকান আর বাসা বাড়ি গুলোতে একটা বিষয় নিয়েই আলোচনা ।গতকাল রাতে কেউ বাজারের কাছেই খুন হয়েছে । রাস্তা রক্তাক্ত থাকলে ও কোন লাশ নেই ।রক্ত দেখে বুঝা যায় খুনিরা ভাল মতো জখম করে লাশ গুম করে দিয়েছে । রাস্তায় কুরবানির মতো এতো রক্ত ছিল যে মানুষের আতংকিত মনোযোগ শুধু সেখানেই ।একই সময় থেকে সুজনকেও পাওয়া যাচ্ছে না । এমন করে দুই দিন কেটে গেল । কাউকে কিছু না বলে সুজন কোথায় হারিয়ে গেল । সুজনের মা দিন রাত বিলাপ করে কাঁদে । কামাল সাহেব কে নিয়ে মুন্সিগঞ্জ থানায় জিডি ও করে ।

চায়ের দোকানের সবাই খোঁজ নিতে থাকে।দোকানের মালিক শহরের ক্ষমতাশালী ব্যক্তি গফুর মিয়া ।পাশের দোকানের মালিক হায়দার আলীর সাথে জমি সংক্রান্ত একটা মামলা অনেক দিন ধরে চলছিল ।সব জায়গায় অনেক ধরনের সন্দেহ আর গোপন আলোচনা হতে লাগল। কেউ কেউ বলছে পাশের দোকানের মালিক হায়দার আলী মারতে পারে ।আবার কেউ কেউ ভাবছে ওর নিজেরে মালিক গফুর মিয়াই মেরেছে হায়দার আলীকে বিপদে ফেলার জন্য।একটা অদ্ভুত ধোঁয়াশায় একটা সপ্তাহ চলে গেল ।

সেদিন কাক ডাকা ভোরে বালুর মাঠে অনেক অনেক কাক ঘিরে আছে । বেশ কয়েকটা কুকুর ও আছে । কি বিস্ময়কর ভাবে কুকুর গুলো ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে । কামাল সাহেবের বউ জোবেদা খাতুন সকালে হাঁটতে বের হয়েছিলেন ।মানুষজনের ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখে বালুর ভেতর থেকে কাক আর কুকুর গুলোই লাশটার মাথাটাকে টেনে বাইরে আনে । জিহ্বায় কামড় দেওয়া নিস্তেজ বিকৃত হয়ে যাওয়া মাথাটা । মানুষ যতো অপরাধ যেভাবেই লুকিয়ে রাখুক । প্রকৃতি তা নিজ নিয়মেই প্রকাশ করে দেয় । সুজনের গলায় মাজার থেকে নেওয়া একটা তাবিজ ছিল । তা দেখেই সুজনের মা নিজের ছেলেকে চিনতে পারে । মুহূর্তে এই চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে সুশীল সমাজ সচেতন হয়ে উঠে । সুজনের কোন শত্রু ছিল না । সুজনের চায়ের দোকানের মালিকের শত্রু ছিল । পরস্পরকে দোষারোপ করার মধ্য দিয়ে আরও কয়েক মাস গেল ।

সত্য লুকানোর গোপন স্থান পৃথিবীর কোথাও নেই । পুলিশ আর সাংবাদিকদের চেষ্টায় কঠিন সত্য প্রকাশ হল ভীষণ গোপনে । সুজনের মালিক গফুর মিয়াই মেরেছে । সুজন কে মেরে হায়দার আলীকে ফাঁসাতে চেয়েছিল । কারন অসহায় সুজনকে মেরে ফেললে প্রতিবাদ করার নেই ।ঘটনাটা অনেকটা এমনই ছিল । টাকা আর ক্ষমতার কাছে পুত্র শোক মায়ের চোখের কান্না ও থেমে যায় ।
গফুর মিয়ার লোকেরা রাতের আঁধারে সুজনের মায়ের চোখের পানি কিনে নেয় টাকার বিনিময়ে । মৃত ছেলের হত্যার বিচার না চেয়ে বরং কেস তুলে নিতে প্রস্তুতি নিল।
সুজনের বাড়ির মালিক কাশেম সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী কোনভাবেই সুজনের মায়ের সিদ্ধান্ত কে মেনে নিতে পারে না । এদিকে মফস্বল শহরের ক্ষমতার বিরুদ্ধে ও দাঁড়াতে পারে না । কিন্তু নিজেদের সততার মূল্য দিতে বিবেককে তুচ্ছ করে সুজনের মা কে অন্য কোথাও চলে যেতে বলে । কখনও জীবনের অসহায়ত্বের কাছে শ্বাশত মায়ের ভালোবাসা ও হেরে যায় । দৃশ্যত চোখে মিথ্যে হয়ে যায় চিরন্তন চেনা সম্পর্ক ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১২:১৮
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×