somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ প্রেমাশিয়া -নুরুন নাহার লিলিয়ান

২৪ শে মে, ২০১৮ রাত ১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




চট্টগ্রামের বাঁশখালির উপজেলার প্রেমাশিয়া গ্রামের ছেলে ফরহাদ । পাঁচ বছর আগে বিক্রমপুরের লৌহজংয়ে মামার বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। হঠাৎ সেখানেই মামাতো বোন শিউলির সাথে তার তুমুল প্রেম হয়ে যায়। শিউলি তখন মাত্র এইচ এস সি পরিক্ষা দিবে। ভরা বর্ষায় মামাতো ভাইকে সাথে নিয়ে পদ্মা নদীর পাড়ে বসে ঢেউ দেখে।কলেজে যেতে মন চায় না। নদীর বাতাসে এক সাথে মন ডুবিয়ে শুধু ঢেউয়ের খেলা দেখে । সীমাহীন নীরবতায় থাকা পদ্মার অভিমানী ধ্বংস দেখে ।দুকুল নিয়ে শুধু ভাঙ্গনের খেলা।তারপর ও পদ্মার ভেতরে বেঁচে থাকার কি অপার স্বপ্ন খেলে যায় । নিদারুন মায়া মমতার তীরের মানুষ জনের জীবন কে আগলে রেখেছে । এই পদ্মার সাথে তীরের লোকজনের এক ঐশ্বর্যময় ঐশ্বরিক প্রেমের সম্পর্ক । মানুষ এতো ভাঙ্গন দেখে তার পর ও নদী তীর ছেড়ে যায় না । এই নদীর স্রোত থেকে ভেসে আসা সুর ।নদীর কুল জুড়ে অনাবিল মিষ্টি হাওয়া । সব যেন মানুষ কে স্বপ্নাতুর করে রাখে ।

মানুষের জীবনে প্রেম বড় অদ্ভুত। কখন ও আলোতে জ্বলতে থাকে। কখন ও আঁধারে হাটে নিরবে।চারিদিক থৈ থৈ পানি।ভেসে যাচ্ছে নিত্যকার সুখের সাথে হাহাকার ও। আজ হতে কয়েক বছর আগে এমন ভরা বর্ষায় ফরহাদের প্রেমের সাগরও ভরে উঠেছিল।একুশ বছরের ফরহাদ কাজের খোঁজে বিক্রমপুর মামার বাড়ি এসেছিল।তখন মামার টানাপোড়েনের সংসার। পদ্মা নদীর পাড়ে ছোট একটা চা এর দোকান। বর্ষা শুরু হওয়াতে লোকজন তেমন একটা নদী পাড়ে আসে না।চা ও বিক্রি হয় না। এদিকে পদ্মা নদীর বুকে ভয়ংকর উত্তাল ঢেউ।

মাঝে মাঝই সে ঢেউ ফরহাদের বুকের ভিতরে এসেও আঘাত করে যায় । বুকের কোন একটা জায়গা চৌচির করে দিয়ে যায়।ফরহাদকে মামী কোন ভাবেই সহ্য করতে পারে না। ফরহাদ সব বুঝতে পারে। ফরহাদ কে চলে যাওয়ার জন্য দিন রাত মামাকে উৎপীড়নের মধ্যে রাখে।ফরহাদ সব সহ্য করে থেকে যায় শুধু পেটের ক্ষুধার জন্য নয় । মনের গোপন জায়াগায় শিউলির জন্য জমে উঠা গভীর ভালোবাসার জন্য । ফরহাদের সেই দুর্দশার সময়ে শিউলির মায়া ভরা চেহারাটা আর যত্নই ফরহাদকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ।

একদিন এক কাপড়ে ফরহাদ কে বিয়ে করে বাঁশখালীর প্রেমাশিয়া গ্রামে এসে নতুন জীবন গড়েছিল ।বঙ্গোপসাগর এবং সাঙ্গু নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত গ্রাম প্রেমাশিয়া । এই গ্রামে এসে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করে । কতো অভাব অনটন ,ঝড় ঝাঁপটা আর ছোট ছোট সুখ গুলো সঙ্গী করে ফরহাদের হাতটা ধরে রেখেছিল ।এক মুহূর্তও কোথাও যায়নি । অথচ বিয়ের অনেক বছর হয়ে গেলেও তাদের ঘরে সন্তান ছিল না । তা নিয়ে ফরহাদ আর শিউলির কিছু অপূর্ণতার দুঃখও ছিল । কতো ডাক্তার কবিরাজি করে একটি বাচ্চার জন্য । তারপর শত চেষ্টার পর বিয়ের চার বছর শেষে একদিন কোল জুড়ে আসে মেয়ে পদ্মমালা ।
সন্তান আসার পর সংসারে সুখের বন্যা বইতে থাকে । ফরহাদ -শিউলির কাঠখোট্টা নির্মম জীবনে কন্যা পদ্মমালা যেন এক গভীরতম ভালোবাসার পরশ । সুখের আলোতে ফারহাদ শিউলির ভাঙ্গা ঘর সুখ সাগরে পরিনত হয় ।
মেয়ের জন্মের পর ফরহাদের ভাগ্যটা ও পরিবর্তন হতে থাকে।চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সাঙ্গু নদীর ঘাঁটেই একটা নতুন টিনের দোকান হয় ।আয় রোজগার ও ভাল হতে থাকে ।নদীর ঘাটে টিনের দোকানটা ভাল করে বেঁধে নেয় ।

নিয়তি প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলার কাছে পরাজিত হয় । সেদিন সব জায়গা থেকেই মাইকিং হচ্ছিল রোয়ানু নামের ঝর আসছে । সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে যেতে বলা হচ্ছিল । তিলে তিলে গড়া এই ঘর বাড়ি দোকান পাট রেখে কোথায় যাবে ফরহাদ । এমন অনেক বার মাইকিং করলেও তো অনেক সময় ঝর অন্যদিকে চলে যায় । একটু বেশি দুঃসাহসী আশা ভরসা নিয়ে ফরহাদ নিজের ভিটেতেই ছিল। সেদিন ভোর রাতের দিকে ।কন্যা পদ্মমালা কে বুকে নিয়ে শিউলি ঘুমিয়ে ছিল । ফরহাদ সেই ঘুমন্ত স্ত্রী সন্তানের দিকে তাকিয়ে নতুন কোন স্বপ্ন সাজাচ্ছিল ।

ভাবতে ভাবতে স্বপ্নের টানে ঘুমটা একটু গভীরে চলে গিয়েছিল । ফরহাদের চোখের সামনে থাকা সেই ঘুমন্ত স্ত্রী কন্যা যে চিরদিনের জন্য ঝরের আঘাতে হারিয়ে যাবে ভাবেনি । ভোর রাতের দিকে । চারিদিকে গগনবিদারী চিৎকার । ফরহাদ অনুভব করছিল ঘরের বেরায় লাগানো হারিকেনটা দুলছিল । ঘুমন্ত চোখে মেয়েটার কান্না আর হাত ধরে স্ত্রীর ডেকে তোলার স্পর্শটুকু মনে আছে । তীব্র ঝরের বেগে ঘর মুহূর্তে ডুবে গেল । শিউলি চিৎকার করে বলছিল ," আমার মাইয়াডা কোল থাইকা গেল । আমার মাইয়াডা ডুইবা গেল ।বাঁচাও! বাঁচাও! "
কয়েক মুহূর্ত সব অন্ধকারে তলিয়ে গেল । ফরহাদের কিছু মনে নেই । দুই দিন হুঁশ ছিল না । চোখ খুলে দেখে হাসপাতালে । নিস্তেজ শরীরটা টেনে তুলতে পারছে না । কেউ একজন পাশ থেকে বলছিল ," আহা! কতো বছর পর মাইডা জন্ম নিল । সুখ দিয়া আল্লাহ্‌ সব কাইরা নিল । পুলাডা একেবারে নিঃস্ব হইয়া গেল ।"
হাসপাতালে কতো জায়গা থেকে আসা রুগী বিছানায় কাতরাচ্ছে। কতো রকমের মানুষ সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করছে । কতো ভাষায় দুঃখ দুর্যোগের আলাপ চলছে । ফরহাদের কাঠখোট্টা নিষ্ঠুর নিয়তির গল্পটা সবার মুখের আলাপের অংশ হয়ে গেল । কতো রকমের সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস , কতো রকমের সহানুভূতিশীল মানুষ পাশে ।

কিন্তু কেউ ফরহাদের সব হারানো নিঃস্ব শরীরটার ভেতরের টুকরা হয়ে যাওয়া মানুষটাকে স্পর্শ করতে পারল না ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৮ রাত ১:৩৫
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×