somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ লাজহীন অন্তর্দহন

২০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবিঃ ইন্টারনেট


পাঁচ মাস আগে এমন স্নিগ্ধ হীম হীম সকালে আমার বিশ বছরের মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে । নাহ! মরে যায়নি ।সমগ্র বন্ধন ছিঁড়ে চলে গেছে । আমাদের ছেড়ে দূরে থাকবে তাই একটি ছোট্ট চিরকুটে পিতা মাতা হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা গুলো লিখে রেখে গেছে ।আমি কিংবা আমার স্বামী সাহিল কোন দিন ভাবতে পারেনি আমাদের এতো আদরের সন্তান আমাদের ছেড়ে থাকতে পারে । এমন সুন্দর সকাল এতো ভয়ংকর অভিশাপ নিয়ে আসতে পারে ! দুটো ছেলে মেয়ে নিয়ে আমাদের সাজানো গুছানো সংসার ছিল ।ছেলে মেয়ে দুটো হৈ হুল্লোড় করে সকাল রাত মাতিয়ে রাখতো । একজন মা হিসেবে একবার ও অনুভব করতে পারিনি এমন কোন পরিস্থির মুখোমুখি হতে হবে ।

আমি তখন অসুস্থতার কারনে বাসায় ছিলাম ।আমার স্বামী সাহিলের কানে তখন ও খবরটা পৌঁছায়নি । চিরকুটটা ভাগ্যিস দেখেছিলাম । কি অদ্ভুত অসহায়ত্ব আমাকে অসাড় আর নিস্তেজ করে দিল । খালি বাড়িতে ওই ছোট্ট একটা চিরকুট আমার বুকে যেন একটা ধারাল ছুড়ি বসিয়ে দিয়ে ছিল ।আমি ঠিক কতক্ষণ আমার মেয়ের বিছানায় একই জায়গায় বসেছিলাম আমি নিজে ও জানি না । বিকেলের দিকে আমার স্বামী সাহিল বাসায় আসে । তারপর আমার সম্বিৎ ফিরে আসে ।সাহিল চিরকুটটা হাতে নিয়ে বারান্দায় লাগানো মেয়ের প্রিয় লাল গোলাপ গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে একাধারে সিগারেট টেনেছে । আমার বেড রুমে গোপনে রাখা হোয়াইট ওয়াইনের বোতলের সবটুকু সারা রাত ধরে সাহিল একাই শেষ করেছে । কিছুই বলিনি । বলতে পারিনি । আমার এই লাজহীন অন্তর্দহন আমি কাকে দেখাব ।

বাইশ বছর আগে মেয়েটাকে সাথে নিয়ে অনেক অনেক যুদ্ধ করে আমরা কানাডা এসেছিলাম ।আমার আর সাহিলের প্রেমের বিয়ে । আমার বয়স তখন সতের । সাহিলের মাত্র একুশ বছর । সাহিলের বড় দুই ভাই বোন তখন ও অবিবাহিত।আমি বাসার বড় মেয়ে । আমার ছোট আরও দুই বোন এবং এক ভাই ছিল । বাসার বড় মেয়ে হিসেবে মা বাবা আমার কাছে ভাল কিছু আশা করত । কোন ভাবেই সাহিলের মতো বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দিবে না । তখন সাহিলদের পারিবারিক ভাবে কানাডা সেটেল্ড হওয়ার সকল প্রস্তুতি শেষ হয় । সাহিল গোপনে বিয়ে করার জন্য আমাকে চাপ দেয় । মধ্য বিত্ত মফস্বলের মেয়ে আমি । এতোটা সাহস ছিল না প্রচন্ড রাগী বাবার মুখোমুখি হওয়া । কিন্তু সে সময় সাহিল আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো । সাহিলের চাপাচাপিতেই এক সময় আমার ভেতরের ভয় ভেঙ্গে যায় । আমরা বিক্রমপুর থেকে পালিয়ে গেলাম নারায়নগঞ্জে।সেখানেই সাহিলের কিছু আত্মিয়ের সহযোগিতায় বিয়ে করি ।যদিও আমার প্রান প্রিয় সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার সে অন্যায় মেনে নিয়েছিলেন ।

দুমাস পর আমাদের পারিবারিক ভাবেই আবার অনেক আয়োজন করে বিয়ে হয় । বছর ঘুরতেই আমার মেয়েটার অস্তিত্ব আমার সমগ্র শরীরে পরিবর্তন আনে । কি যে ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা । আমার অনিশ্চিত জীবনের দিকে সবার অবহেলার চোখ । তখন সাহিল চলে গেল কানাডা । আর আমি কন্যা সহ বাবার ঘাড়েই বেঁচে থাকার যুদ্ধ করতে লাগলাম । যদি ও সে সময় স্বামী ভাগ্যটা আমার ভালই ছিল । কেননা সাহিল কানাডা গেলেও আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিল । কয়েক বছর পর মেয়েকে তিন বছরের কোলে নিয়ে কানাডার ক্যালগ্যারিতে আমাদের নতুন সংসার শুরু হল । বেঁচে থাকার নতুন যুদ্ধ ।সে যুদ্ধের মাঝে সহযোদ্ধা স্বামী সাহিলের অনেক গোপন কুকীর্তি আমার গোচরে আসে। মদের নেশা , ভিনদেশি নারীপ্রীতি আর আমাকে দমিয়ে রাখা স্বেচ্ছাচারিতা । নিজের সাথে অনেক অনেক বোঝাপড়া করেছিলাম ।
মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে আমি । স্বামীকে ডিভোর্স দিলে বাবা মা আবার কষ্ট পাবে । বোন গুলো শ্বশুর বাড়িতে কথা শুনবে । সাহিলকে পালিয়ে বিয়ে করে একবার সবাইকে কষ্ট দিয়েছিলাম । আর কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি । তাই সব টুকু কষ্ট নিজের কাছে রেখেছি । সাহিলের সাথে ও সেই ছোট্ট বেলার প্রেমটা আর নেই । নিতান্তই দুজনের সমাজ আর জীবনের দিকে তাকিয়ে একসাথে বেঁচে থাকা । মাঝে মাঝে সাহিল সীমা অতিক্রম করে ফেলত । আমাদের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া হতো । মেয়েটা ভেতরে ভেতরে আমাদের দুজন কে চরম অশ্রদ্ধা আর ঘৃণা করেই বড় হয়েছে।পৃথিবীর সাথে সে কবেই সমঝোতা করে নিয়েছি । স্বামীর করা সকল উৎপীড়ন আর অন্যায় আমিই মেনে নিয়ে শুধু সংসার বাঁচিয়েছি । আমার একান্ত লাজ লজ্জা রক্ষা করেছি ।বাইশ বছর পর আজ পেটের সন্তান ও বলে গেল " ইটস ইউর চয়েজ !ইটস ইউর লাইফ। তুমি কেন এই জীবন মেনে নিয়েছো । কেন সংসার রক্ষা করতে সব সহ্য করেছো । স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার সবার অধিকার আছে"।

মেয়েটা চলে যাওয়ার পর দুই সপ্তাহ আমি আর সাহিল কেউ কোন কাজ করিনি । কেউ কার ও সাথে কথা বলিনি । পুলিশ নিয়ে ওর কলেজে গিয়েছিলাম । মেয়ে আমার আঠার বছর অতিক্রম করেছে । স্বাধীন আইনের বলে পিতা মাতা হয়ে ও আমরা তাকে শাসন করার অধিকার হারিয়েছি । শেষ যখন ফিরে আসছিলাম । সাহিল ড্রাইভ করছিল । আমি মেয়েটা গাড়িতে যে সিটে বসত সেখানে হাত রেখে কান্না করছিলাম । সারাটা পথ সাহিল শুধু বলেছিল ," ডালিয়া ডোন্ট ক্রাই! সি ইজ নাও এডাল্ট এনাফ !প্লিজ ডালিয়া ডোন্ট ক্রাই!
সাহিল আমাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে লুকিয়ে নিজেও দু'ফোঁটা জল ফেলেছে ।
আমার প্রথম কন্যা সন্তানের বার বছর পর ছেলেটির জন্ম হয়েছিল । ওর বয়স আট ।ও স্কুলে যায় । বাসায় যা ঘটছে টুকটাক বুঝে । আমি আবার অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মা হতে চলেছি ।ছয় মাস হতে চলেছে । আগে জানলে হয়তো তাকে পৃথিবীতে আনতাম না । ছোট ছেলেটা জিজ্ঞেস করে ,"হোয়ার ইজ সি?
আমি উত্তর দেই ," সি হেজ গন।"
সে রেগে গিয়ে বলে ," সি ইজ লায়ার । সি ডিডন্ট গিভ মি চকোলেট এন্ড এপল জুস । সি ইজ লায়ার!"
আমি আর কোন উত্তর দিতে পারি না । শুধু বলি ," ইয়েস ,সি ইজ লায়ার!"

বড় মেয়েটাকে বলা হয়নি ।ও তো আমাদের বিলাস বহুল বাড়ি রেখে ইন্ডিপেন্ডেট হতে বান্ধবীর সাথে রুম শেয়ার করে ডাউন টাউনে একটি পুরনো বাসায় থাকে । কি অদ্ভুত কঠিন আর নির্মম জীবন আমার! মেয়েকে বললেই কি সে কেঁদে কেটে আমার কাছে চলে আসবে ! নাহ! এই আধুনিক দেশে সবার নিজের জীবন নিজেকেই ভাবতে হয় । এখন তাঁর স্বাধীনতা উপভোগের সময়! আমাদের তাকে বিরক্ত করা ঠিক না !

এই কয়মাস বড় মেয়েটা কে নিয়ে এতো গভীর হতাশায় ছিলাম যে বুঝতেই পারিনি কখন আমার ভেতরে অন্য আরেক প্রান সঞ্চার করেছে । প্রথম দিকে আমরাই ওকে ফোন দিতাম ,দেখা করতে যেতাম । এক মাস ধরে আমরা ও অভিমান করে ফোন দেই না । বড় মেয়েটা যখন পেটে এল । সাহিল বেকার ছিল কিন্তু আমাদের ভেতরে গভীর ভালোবাসা ছিল । জীবনে ছোট ছোট দুঃখ নিয়েও আনন্দ ছিল ।এই আমি আবার মা হতে যাচ্ছি ।এখন আমার কানাডা আর বাংলাদেশে অনেক সম্পদ, বাড়ি, গাড়ি আছে । ব্যাংকে জমানো টাকা আছে । কিন্তু আমাদের কারও মাঝে শান্তি নেই । ঘুম আর আনন্দ নেই । জীবনের ছন্দ নেই ।তুমুল আদরে আনন্দে বড় করা সন্তানটি ও নেই । শুধু আছে লাজহীন অন্তর্দহন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:০৫
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×