somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ পার্থিব পাপ- নুরুন নাহার লিলিয়ান

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



#পার্থিব পাপ
#নুরুন নাহার লিলিয়ান

কোলে আড়াই বছরের কন্যা। পেটে আরো একটি অনাগত সন্তান আসার অপেক্ষায়। সাজেদার পুরো চেহারায় এক ভয়াবহ আতংক।চোখের নিচে দীর্ঘ দিন না ঘুমানোর কারনে কাল ঘুমপোড়া ছাপ। জুন মাসের পোড়া রোদে মনেহয় আরও পুড়েছে। আর একদম ঘামে নেয়ে উঠা ভেজা পোয়াতি শরীর । বার বার আচল দিয়ে ঘাম মুছছে। পাশের চেয়ারে সাতাশ আঠাশ বছরের ছেলেটি তার দেবর। সাজেদা কোন কথা বলতে পারছে না। মেয়েটা কোলে নিয়ে থর থর কাঁপছে।

দেবর মতিনই আজকে সাজেদাকে পুলিশের কাছে নিয়ে আসছে। গত এক সপ্তাহ ধরে বড় ভাই মুবিনের কোন খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছিল না । আজকাল এই পৃথিবীতে চলমান পথে যে কেউ যে কোন সময়ে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে ।এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ঘটনা গুলো পত্রিকার পাতায় সয়ে গেলেও পরিবার গুলোর সহ্য ক্ষমতা এখন ও সে পর্যায়ে যায়নি ।

তাই প্রিয়জন নিখোঁজ হলে মানুষ আগে জীবিত নাকি মৃত এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে সবার আগে ।মুবিনের পরিবার ও এই উত্তর খুঁজেছে ।এই কয়দিন পুলিশ মুবিন নিখোঁজ হওয়ার পর তাকে অনেক খুঁজেছে ।কিন্তু কোন হদিস দিতে পারছিল না । গতকাল খিলগাঁও ঝিলে একটা লাশ পাওয়া যায় । সেই লাশ দেখাতেই আজকে সাজেদাকে ডাকা হয়েছে ।

কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা হেদায়েত সাজেদাকে দেখে কিছুটা দ্বন্দে পড়ে গেল । লাশটা যদি সাজেদার স্বামীর হয় আর সাজেদা যদি সহ্য করতে না পারে ! তাই বেশ কিছুটা সময় ধরে হেদায়েত সাহেব সাজেদার সাথে কথা বলেন । মুবিনের সম্পর্কে খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করেন । আসলে লাশটা মুবিনের । ঘণ্টা খানিক আগেই হেদায়েত মুবিনের কর্মস্থলের তথ্য অনুযায়ী নিশ্চিত হয়েছেন ।

মুবিন ঢাকায় একটি বেসরকারি এনজিওতে লোন বিভাগে চাকরি করতো ।সাত বছর ধরেই এই এনজিওতে খুব দায়িত্বের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন ।মুবিনকে নিয়ে কর্মকর্তাদের তেমন কোন অভিযোগ নেই । স্বল্পভাষী মুবিন সবার সাথে কথাবার্তা কম বললেও নিজের কাজটা দায়িত্ব নিয়ে করতেন । কার ও সাথে কখনও ঝগড়া হয়েছে বলে শোণা যায়নি ।তারপর ও এমন একটি মানুষ লাশ হয়ে যায় ।

সাজেদা ও মুন্সিগঞ্জের একটা এনজিওতে হিসাবরক্ষন কর্ম কর্তা হিসেবে চাকরি করে ।খুব সামান্য বেতন । তারপরও দুজনের বেতনে ভালোবাসার ছোট সংসারটা চলে যাচ্ছিল ।দুজনের প্রতি কার ও কোন ব্যক্তিগত অভিযোগ ছিল না । খুব ছোট কিছু স্বপ্ন নিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবন এগিয়ে যাচ্ছিল ।
কিন্তু তারপরও তাদের ছোট সংসারের ছোট ছোট সুখ গুলো হারিয়ে গেল অমাবস্যার গভীর অন্ধকারে ।

প্রতি বৃহস্পতিবার মুবিন ছুটিতে মুন্সিগঞ্জ বাড়িতে যেতো ।আড়াই বছরের মেয়েটি বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকতো । বাবা না ফেরা পর্যন্ত ঘুমাতো না ।এই এতো টুকু মেয়ে সপ্তাহান্তে বাবার ভালোবাসা পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করতে শিখে গিয়েছিল । এখন ও মেয়েটা ঘুমায় না ।নিরন্তর অপেক্ষা করে । কিন্তু বাবা আর ফিরে আসে না । এক সময় ক্লান্ত শরীরটা ছোট্ট শিশুটিকে ঘুমের জগতে নিয়ে যায় । মায়ের কোলে বসে ও শিখে গেছে চোখে পানি জমা মানে কষ্ট পাওয়া । সাজেদার চোখ দুটো যখন আর সইতে পারে না । যখন সব বাধা ভেঙ্গে কষ্টের জলোচ্ছ্বাস কান্নার নোনা জলে ভাষায় । তখন কোলের মেয়েটি কিছুক্ষন মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে নির্বাক । ছোট ছোট হাত দিয়ে মায়ের চোখের নোনা জল মুছে দেয় ।তারপর নিজেই চিৎকার করে উঠে ।মা -মেয়ের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে উঠে ।

ছুটিতে গেলেই মুবিন ধলেশ্বরীর নদীর পাড়ে মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত । মুক্তারপুরের চীন -মৈত্রী সেতুতে বিকেলের বাতাসে মেয়ের ছোট ছোট হাত ধরে হাটা শেখাত । ধলেশ্বরীতে নদীর বুকে নৌকাদের বয়ে চলা দেখাত । ছোট্ট মেয়েটা হয়তো বাবার সব কথা বুঝতো না । কিন্তু বাবার পরম স্নেহ , ভালোবাসা ,স্পর্শ বুঝতো । বাবার কোলে বসে তাঁর নির্ভরতা বুঝতো । বাবার বুকের পরম মমতা বুঝতো।পিতৃস্নেহের টান মেয়েটিকে ও নিস্তব্ধ করে দিয়েছে । মায়ের কোলে বসে ছোট ছোট দুটো নির্বাক চোখ বাবাকে খুঁজে ফিরে ।

মুবিন সপ্তাহ শেষে বাড়ি গেলে স্ত্রী সাজেদার প্রিয় মুরলি ভাঁজা নিতে ভুলতো না । মেয়ে জন্ম নেওয়ার আগে সাজেদার হাত ধরে ধলেশ্বরী নদীর বুকে বয়ে চলা নৌকায় বসে কতো সন্ধ্যা ফুরাতে দেখেছে । নদীর পাড়ে বসে সাজেদাকে জড়িয়ে ধরে নদী বুকে বয়ে চলা ঢেউয়ের আনন্দ দেখেছে ।আর স্ত্রী সাজেদার বাতাসে উড়ে যাওয়া চুল হাতের আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে কতো স্বপ্নের সুখ খুঁজেছে ।আজ স্বামীহীন সাজেদার বুকেই এক উথাল পাথাল নদী বয়ে যাচ্ছে ।
মুবিনের একটা কথা আজ ও সাজেদার কর্ণ কুহুরে আঘাত করে ।

আর ভালাবাসা হারানোর আগুন ঝলসে দিয়ে যায় ।
" বউ সৎ মানুষের সততাই বড় সম্পদ ।আর গরিব মানুষের মায়া মমতাই জীবন ।সততা ,মমতা না থাকলে সে আর মানুষ হয় না । "
সাজেদা তখন বলতো ," এই মায়া মমতার কথা কইয়া কইয়া বিদেশ গেলেন না । আজকে আমগো কিছু পয়সা পাতি থাকতো । মাইয়াডা বড় হইতাছে --"
মুবিন সাজেদাকে আর ও কাছে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে বলতো ," দূরে সরাইয়া দিতে চাও আমারে ?"
মানুষটা সব রেখে হারিয়ে গেছে ।স্বামী হারা সাজেদা আজ পৃথিবীর বুকে ভীষণ অসহায় । নির্মম ভাগ্যের কাছে পরাজিত ।
মৃত স্বামীর স্মৃতি বুকে নিয়ে ধূসর সময় চলতে লাগল ।

এক বছর পর । সাজেদা কে থানায় ডাকা হল । মুবিনের ঢাকার মেসে এক সাথে থাকতো দুলাল । যে সম্পর্কে সাজেদার মামাতো ভাই । অনেক দিন সৌদি থাকার পর ফেরত এসে মুবিনের সাহায্যেই ঢাকায় চাকরি নেয় ।
অন্য একটা ছোট কোম্পানিতে মার্কেটিং এর কাজ করতো ।থানার পুলিশ অফিসার সাজেদা কে জিজ্ঞেস করে," দুলাল আপনার সম্পর্কে কি হয় ?"
সাজেদা সরল উত্তর দেয় ," হেয় আমার মামাতো ভাই লাগে । হের আবার কি হইছে ?"
পুলিশ খুব কঠিন কণ্ঠে বলে ," হের কিচ্ছু হয় নাই । তবে হইব ।হেয়ই তো সব কিছুর নাটেরগুরু।"
সাজেদা অস্থির হয়ে উঠে । তারপর কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে ," হেরে তো আমার স্বামী অনেক উপকার করছে । এমন কি ঢাকায় নিজের কাছে রাখছে ।"
পুলিস কর্মকর্তা হেদায়েত একটু কঠিন কণ্ঠে বলল ," আর কাছের মানুষটাই তারে দুনিয়া থেকে সরাইয়া দিছে । ভয়াবহ নিষ্ঠুর ভাবে !
সাজেদার বিশ্বাসের জগত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় । সে চিৎকার করে কেঁদে উঠে । তারপর জানতে চায়
" আচ্ছা হেয় ক্যান আমার স্বামীরে মারল?"
হেদায়েত একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বলল," লোভ , হিংসা আর দয়াহীন মন। হেয় আপনারে বিয়া করতে চাইছিল । কিন্তু আপনি তো মুবিনরে বিয়া কইরা ফেলছেন। "
কাঁদতে কাঁদতে সাজেদা বলে ," এই কারনে আমার মাইয়ার বাপরে দুনিয়া থিকা সরাইয়া দিল !"
হেদায়েত সিরিয়াস ভাবে বলল," টাকার লোভ ও ছিল । মুবিনের অফিসের লোন থেকে তোলা টাকা সে নিয়ে যায় আর মুবিন কে মেরে নদীতে ফেলে আসে ।"
সাজেদা অঝোরে কাঁদতে থাকে । মুবিনের ভাই মতিনকে হেদায়েত বলে ," আমরা অনেক দিন ধরে একটা সিরিয়াল কিলার খুঁজতে ছিলাম । অনেকে তাকে বাবা দুলাল বলতো ।এক খুনের আসামী খুঁজতে গিয়ে অনেক খুনের এক দুর্ধর্ষ আসামীকে পাওয়া গেছে ।
মতিন জিজ্ঞেস করল ," ভাইরে ক্যান মারল ? "
হেদায়েত বলল ," ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় আপনার ভাই নিজের মৃত্যুকে নিজের কাছেই যত্নে রেখেছিল ।অন্ধবিশ্বাস না একটু সচেতনতা দরকার ছিল । তবে কি জানেন পার্থিব কোন পাপেরই প্রকৃতি রেহাই দেয় না ।এই খুনটা না হলে হয়তো বাবা দুলাল ধরা পড়তো কিনা সন্দেহ আছে ।"

পরের বার থানায় দেখা করার তারিখ জেনে মতিন সাড়ে তিন বছরের ভাতিজি আর ভাবি কে নিয়ে বের হয় । সাজেদার কোলে নবাগত ছেলে শিশু ।
কিছুক্ষন পর পর কোলের ছেলেটি কেঁদে উঠছে ।সাজেদা ছেলের চোখের কান্না মুছে আর মনে মনে পাপ পুণ্যের হিসাব কষে ।আর
সামনের অন্ধকার মায়াময় পৃথিবী রহস্যময় মুচকি হাসে ।

পার্থিব জীবনের স্বপ্ন খুঁজতে মানুষ কতো পাপ পুণ্যের হিসেব করে । অথচ পৃথিবীর সহস্র রহস্যের ভাঁজের ব্যাখ্যা কি মানুষ দিতে পারে ! তবুও অসহায় ভাগ্যের পথ ধরে মানুষ জীবন খুঁজে ফেরে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৯
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×