somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুগন্ধির বিভত্স সম্মোহন এবং অত:পর! (ছোটো গল্প)

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[প্রারম্ভিক কথা: আমাদের চারপাশে প্রতিদিন বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। লক্ষ লোকের লোকালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিচিত্র সব মানুষ। রঞ্জু তাদেরই একজন। আর তাকে ঘিরে আজকের ঘটনাটিও বিচিত্র এক ঘটনা।]



এক.
বৃটেনের এয়ারপোর্টগুলো এমনই। বাইরে থেকে দেখতে কেমন কদাকার, কিন্তু ভেতরটা তকতকে সুন্দর। ঠিক বিলেতি রমনীদের উল্টো! ট্যাক্সিওয়ালাকে বিদায় করে রঞ্জু তেঁতো মুখে এয়ারপোর্টটির দিকে একবার তাকায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে নেয়। যথারীতি সে নির্ধারিত সময়ের চার ঘন্টা আগে এসে পৌঁছেছে। এটা রঞ্জুর পুরনো স্বভাব। এয়ারপোর্ট মানেই চার ঘন্টা আগে গিয়ে বসে থাকতে হবে! আগে আসাতে রঞ্জুর মনে একটা স্বস্তির বাতাস বয়ে যায়!

হেমন্তের শুরুর দিনগুলোতে ব্রিটেনে সুন্দর একটা বাতাস বয়। আজও বইছে। হঠাত খুব পরিচিত একটা পারফিউমের গন্ধ ভেসে এলো রঞ্জুর নাকে। বাঁ'দিকে তাকাতেই রঞ্জু দেখতে পায় একটা সুন্দরী মেয়ে দাড়িয়ে আছে,- ভ্যানিটি ব্যাগে কি যেন খুঁজছে সে। মেয়েটির সাথে শান্তার কোনো রকম মিলই নেই। তবুও শান্তার গায়ে যেমন সুন্দর গন্ধ ছিল ঠিক তেমন সুন্দর একটা গন্ধ আসছে মেয়েটির কাছ থেকে। রঞ্জু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি হাসি দিয়ে বলে 'হাই'। রঞ্জুর হুঁশ ফিরে আসে। সেও বলে 'হাই'- তবে হাসিটা দিতে ভুলে যায়! রঞ্জুর মত মেয়েটিও এয়ারপোর্ট টার্মিনালে না ঢুকে বাইরে দাড়িয়ে আছে। সম্ভবত মেয়েটিও হেমন্তের সুন্দর বিকেলটি উপভোগ করছে কিছু সময়ের জন্য।

রঞ্জু পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়। আঁর চোখে মেয়েটির দিকে সে আরেকবার তাকায়। আনমনে মেয়েটি চোখে মাশকারা দিচ্ছে। কাঁধ পর্যন্ত গড়িয়ে পরেছে তার রেশমী কালো চুল। হেমন্তের ঝাপটা বাতাসে মেয়েটির সৌন্দর্য ফুঁটে উঠছে শুভ্র বসনে লেপ্টে থাকা সমস্ত অবয়ব জুড়ে। দেখে মেয়েটিকে ব্রিটিশ মনে হচ্ছে না।

চেহারায় শান্তার সঙ্গে কোনো রকমের মিলই নেই। তবে এতদিন পর মেয়েটিকে দেখে রঞ্জুর কেন মনে পরে গেল শান্তার কথা?

ক্রিস্টিয়ান দিওর এর ‘হিপনোটিক পয়জন’ তো কত মেয়েই ব্যবহার করে। শান্তাও ব্যবহার করত। একই পারফিউম একেক শরীরে একেক রকম সুবাস তৈরী করে- আর এটাই পারফিউমের বিশেষত্ব। শান্তার গায়ে হিপনোটিক পয়জন যে রকম সুবাস ছড়াত, এই মেয়েটির কাছ থেকেও সেই একই রকম সুবাস ভেসে আসছে রঞ্জুর নাকে। রঞ্জু উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাস্তার ধারের হুলুদ হয়ে ওঠা সেঞ্চুরি গাছ গুলোর দিকে। হেমন্তের এলোমেলো বাতাসে বুড়িয়ে যাওয়া স্মৃতিমাখা পাতাগুলো ঝরে পরছে একে একে।

'বিকেলটি আজ খুব সুন্দর, তাই না?'- রঞ্জু মেয়েটির সাথে কথা শুরু করার চেষ্টা করে।
'সত্যিই চমত্কার একটি বিকেল!'- মাশকারাটি ভ্যানিটি ব্যাগে রাখতে রাখতে মেয়েটি উত্তর দেয়।
'হলিডেতে যাচ্ছেন?'- ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফেইস পাউডারের কৌটাটি বের করতে করতে মেয়েটি জিজ্ঞেস করে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে তার রূপচর্চায় ব্যস্ত হয়ে পরে। রঞ্জুর কাছে মেয়েটিকে বেশ চটপটে স্বভাবের বলে মনে হয়।
'না, আসলে আমি যাচ্ছি মিউনিখে একটা রিসার্চ ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে।'
'আপনি হলিডেতে যাচ্ছেন, তাই না?' কথা বাড়িয়ে নিতে রঞ্জু জিগেস করে।
'আপনি কিভাবে বুঝলেন যে আমি হলিডেতে যাচ্ছি?' -মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে মেয়েটি জানতে চায়।
কিছুটা বিব্রত হয়ে রঞ্জু বলে, 'না, এখনতো হলিডেতে যাওয়ারই সময়। তাই ভাবলাম আপনিও যাচ্ছেন!'

মেয়েটি এবার তার রূপচর্চার ক্রিয়াকর্ম বাদ দিয়ে, চুগুলো একটা ব্যান্ড দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে বলে, 'কোথায় যেন যাচ্ছেন আপনি বললেন? ট্রেনিংএ? মিউনিখে? আপনার ট্রেনিং কি লাডুইগ-ম্যাক্সিমিলান ইউনিভার্সিটি হসপিটালে হচ্ছে?'
'হ্যা। ঠিক তাই। আপনি কিভাবে জানলেন?'
'আমিও তো সেখানে যাচ্ছি!’ -মেয়েটা কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে।
'রিয়েলি?'
'হ্যা তাই! ইউকে থেকে দু'জন যাচ্ছে ট্রেনিংএ এটা আগে থেকেই জানতাম। তবে ভাবিনি যে অপরজনের সাথে বিমানবন্দরেই দেখা হয়ে যাবে। যাক একজন সঙ্গী পাওয়া গেল!' -মেয়েটি বেশ স্বস্তি নিয়ে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে।

'আমার নাম রঞ্জন চৌধুরী। আপনি আমাকে রঞ্জু ডাকতে পারেন। সবাই আমাকে এই নামেই ডাকে।' –বলেই রঞ্জু হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করার জন্য।
'ভেরি নাইস টু মিট ইউ। আই এ্যম জোয়ানা' -মেয়েটি সাচ্ছন্দেই রঞ্জুর সাথে হ্যান্ডশেক করলো।

বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে জোয়ানার হাত। রঞ্জু তার হাতে শান্তার হাতের ছোঁয়া অনুভব করে! শান্তার হাতও এমন ঠান্ডা থাকত। ভয়ে রঞ্জু দ্রুত তার হাতটি ছাড়িয়ে নেয় জোয়ানার হাত থেকে। রঞ্জু জানে শান্তা একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। তবে রঞ্জু চায়না যে শান্তা ফিরে আসুক!

'উহ! বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে। হেমন্ত তো সবে শুরু, তার ভেতরেই শীত এসে উঁকি দিচ্ছে! চলুন টার্মিনালের ভেতরে যাওয়া যাক।' -বিরক্ত মুখে জোয়ানা বলে।
'হ্যা, তাই চলুন। চেক-ইন এর সময়েও ঘনিয়ে এসেছে', -বলেই রঞ্জু এবং জোয়ানা টার্মিনালের ভেতরে ঢুকে পরে।

বাইরে বয়ে যাচ্ছে অসময়ে আসা কনকনে শীতল বাতাস। হেমন্তের অপূর্ব সোনালী বিকেলটি সন্ধ্যার কালিমায় কেমন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কে জানে, প্রকৃতি হয়ত বিভত্স কোনো কালো রাত্রির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে!

দুই.
চেক-ইন সম্পন্ন হয়েছে। রঞ্জু এবং জোয়ানা লবিতে অপেক্ষা করছে লুফথানসা ফ্লাইট নং LH2503 এর জন্য। বোর্ডিং টাইম সন্ধ্যা ৬:০৫। মিউনিখের উদ্দেশ্যে প্লেন ছাড়বে ৬:৩০ এ। ম্যানচেস্টার থেকে মিউনিখ যেতে সময় লাগে মাত্র দুই ঘন্টা। তবে জার্মানির সময় ইউকে’র সময়ের চেয়ে এক ঘন্টা এগোনো। অর্থাত, সব কিছু ঠিক থাকলে মিউনিখের মাটিতে প্লেনটি অবতরণ করবে ওখানকার সময় রাত ৯:৩০ এ। এরই মধ্যে রঞ্জু এবং জোয়ানার মাঝে একটা সুন্দর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। প্লেনে তারা পাশাপাশি সিট্ নিয়েছে।

জোয়ানা মূলত পর্তুগিজ। সে লন্ডনে এসেছে পাঁচ বছর হলো। এখন ইম্পেরিয়াল কলেজে পার্ট-টাইম পিএইচডি করছে আর হ্যামারস্মিথ হসপিটালে চেস্ট মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে রেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরি করছে। আর চার বছর পর বক্ষরোগের কনসালটেন্ট হবে। গত মাসে ২৭ তম জন্ম দিনে বয় ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক-আপ হয়েছে জোয়ানার। এতে অবশ্য তার কোনো দুঃক্ষ নেই। বরং সে কিছুটা হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। ওদের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই শীতল সম্পর্ক চলছিল। শীতল সম্পর্ক নিয়ে এক সাথে থাকা যায় না। এক সাথে বসবাসের জন্য দরকার সম্পর্কের উষ্ণতা। এসব রঞ্জুকে বলে জোয়ানা আজ নিজেকে কিছুটা হালকা অনুভব করছে।

রঞ্জুর গল্পও জোয়ানা মন দিয়ে শোনে। জোয়ানা আগে কখনো বাংলাদেশী ছেলেদের সংস্পর্শে আসেনি। তবে তার এক বাংলাদেশী মেয়ে কলিগ ছিল। মেয়েটি অবশ্য ততটা ফ্রেন্ডলি ছিল না। সম্ভবত: এ কারনেই বাংলাদেশীদের প্রতি জোয়ানার দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা ভালো ছিল না। অবশ্য রঞ্জুর সাথে কথা বলে জোয়ানার এই ধারণা আজ ভেঙ্গে গেছে। রঞ্জুকে তার কাছে খুবই ভদ্র, মার্জিত এবং ফ্রেন্ডলি মনে হয়েছে। সর্বপরি, মেয়েদের প্রতি রঞ্জুর যে একটা সন্মানবোধ আছে এটা দেখে জোয়ানা বেশ মুগ্ধ হয়েছে!

রঞ্জু সাত বছর হলো বাংলাদেশ ছেড়ে এসছে। লন্ডন থেকে মাস্টার্স করে শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি শেষ করেছে গত বছর। গত বছরই পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে চাকরি শুরু করেছে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে। আগামী নভেম্বরে ৩৪ বছরে পা দেবে সে। রঞ্জুর জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের যে গল্পটি সে জোয়ানাকে বলে তাতে শান্তা নামের কোনো চরিত্র নেই! তবে লাবনী নামের একটা মেয়ের কথা রঞ্জু জোয়ানাকে বলে। বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় তাদের প্রেম হয়, কিন্তু লাবনীর বাবা-মা জোর করে লাবনীকে বিয়ে দিয়ে দেয় এক আর্মি অফিসারের সাথে। রঞ্জু অবশ্য জোয়ানাকে বলে যে লাবনীরও ওই বিয়েতে সায় ছিল। রঞ্জু আরো বলে যে সে পরে জানতে পেরেছিল ওই আর্মি অফিসার আসলে লাবনীরই কাজিন।

লাবনীর সাথে বিয়ে না হওয়ায় রঞ্জু মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পরে। দুঃক্ষ কাটিয়ে উঠতে তার বেশ সময় লাগে। আর এ কারনেই মেডিকেলে রঞ্জুকে এক বছর ড্রপ দিতে হয়েছিল! এ সব গল্প শুনে জোয়ানা বেশ দুঃক্ষ প্রকাশ করে। কিছুটা অনুতপ্তও হয় বিচিত্র কোনো এক কারণে। জোয়ানা চেয়ার টেনে রঞ্জুর দিকে কিছুটা এগিয়ে আসে সান্তনা দিতে। কাছাকাছি আসাতে জোয়ানার পারফিউমের গন্ধ আবিষ্ট করে ফেলে রঞ্জুকে। রঞ্জু জোয়ানাকে শান্তা থেকে আর আলাদা করতে পারে না। গাড় এক শ্বাসে সে শান্তার গায়ের ‘ক্রিস্টিয়ান দিওর’ এর গন্ধ টেনে নেয় জোয়ানার কাছ থেকে!

গুমোট এক নিস্তব্ধতা কাটিয়ে হঠাত লাউড স্পিকারে ফ্লাইট সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি। LH2503 ফ্লাইটটি আধা ঘন্টা দেরী হবে। আবহাওয়া খারাপ থাকায় তাদের প্লেন ল্যান্ড করতে দেরী করেছে।

'কি আশ্চর্য! ভেতর থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই যে বাইরে কি হচ্ছে!' - জোয়ানা বিস্ময় প্রকাশ করে।
'হুম তাই।' - রঞ্জু মিনমিন করে সম্মতি জানায়।

খারাপ আবহাওয়ার কথা শুনে রঞ্জু কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। অবশ্য সে তা প্রকাশ করছে না। গত দু' মাসে দু'টো প্লেন বিধস্ত হয়েছে খারাপ আবাহাওয়ার জন্য। এমনিতেই রঞ্জু প্লেনে চড়তে ভয় পায়। তার উপর এখন তাকে এই খারাপ আবহাওয়ার ভেতরেই প্লেনে উড়তে হবে। এটা ভাবতেই রঞ্জুর গলা কেমন শুকিয়ে আসে!

'জোয়ানা, চল কিছু একটা ড্রিংক করা যাক।'
'হুম, ইট’স এ গুড আইডিয়া; সামনেই একটা বার দেখা যাচ্ছে, চল ওখানে যাই।'
'বারটি বেশ খালি খালি লাগছে! লোকজন সব গেল কই? যাক ভালই হলো, নিরিবিলি একটু বসার জায়গা পাওয়া যাবে!' - রঞ্জু বেশ স্বস্তি প্রকাশ করে।

রঞ্জু নেয় এক্সট্রা কোল্ড এক পাইন্ট কার্লিং, আর জোয়ানা নেয় আমেরিকানো কফি। বারের ভেতরে কোণার দিকে পেতে রাখা সোফায় গিয়ে ওরা দুজন বসে। কেমন একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে ওদের ভেতর। কোনো কথা নেই! রঞ্জু আয়েশ করে বিয়ারের গ্লাসে একটা চুমুক দেয়। জোয়ানা ভ্যানিটিব্যাগ থেকে তার মোবাইলটি বের করে, - ব্ল্যাক কফিতে একটা চুমুক দেয়। শান্তা কখনো ব্ল্যাক কফি লাইক করত না। শান্তার পছন্দ ছিল ফেনা ওঠা গরম ক্যাপাচিনো। জোয়ানার সাথে শান্তার এই অমিল দেখে রঞ্জু মনে মনে খুশি হয়!

'রঞ্জু, কিছু মনে করোনা, আমাকে একটা ই-মেইল রিপ্লাই করতে হবে। বসের ই-মেইল বলে কথা!' জোয়ানা টক টক করে মোবাইলে টাইপ করতে শুরু করে দেয়।
'না না, ইট’স অলরাইট। টেক ইওর টাইম।' -বলেই রঞ্জুও পকেট থেকে তার মোবাইল বের করে। ৭০৮ টি আন-রিড ই-মেইল! রঞ্জু ইদানিং ঠিক মত মেইলও চেক করে না। মেইল বক্স ওপেন করেই দেখতে পায় ড. কলিন বিঙ্গেলের একটা নতুন মেইল। যেহেতু বসের মেইল, তাই রঞ্জু তা ওপেন করে। ভদ্রলোক গুডবাই জানিয়ে মেইল করেছে! থ্যান্ক ইউ লিখে রঞ্জু মেইলটি রিপ্লাই করে। ফেইসবুকের পাতায়ও দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয়। একটা স্ট্যাটাস আপডেট করে, "Off to Munich, goodbye Manchester. Hope our plane will not be vanished in the sky!"

লাউড স্পিকারে আবারও ফ্লাইট সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি। লুফথানসা ফ্লাইট নং LH2503 বোর্ডিং গেট খুলে দেয়া হয়েছে। যাত্রীদেরকে প্লেনে ওঠার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।

জোয়ানা কফি কাপে শেষ চুমুকটি দিয়ে বলে, 'চল চল, বোর্ডিং গেটের দিকে যাই।'
'হুম, চল' - বলেই এক নিশ্বাসে বিয়ারের শেষ টুকু গো-গ্রাসে গিলে ফেলে রঞ্জু।

কোনো রকম ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই প্লেনে উঠে পরে রঞ্জু ও জোয়ানা। জোয়ানা বসে জানালার পাশের সিট্ 8A তে আর রঞ্জু বসে 8B তে। প্লেনে উঠেই জোয়ানা ভ্যানিটিব্যাগ থেকে ফেইস পাওডারের কৌটা বের করে মুখে একটু পাউডার ঘষে এবং চুলগুলো কিছুটা ঠিক করে নেয়। রঞ্জু অবশ্য ততক্ষণে একটি বই বের করে পড়া শুরু করে দিয়েছে! প্লেনে এবং ট্রেনে বই পড়া রঞ্জুর স্বভাব। আজ সে সঙ্গে করে এনেছে রিচার্ড ডকিন্সের পুরনো তবে সাড়া জাগানো একটি বই 'দি সেলফিশ জিন'। অভ্যাসের বশে বইটি বেড় করলেও রঞ্জু তা পড়তে পারছে না। পাশে একজনকে রেখে একা একা বই পড়তে তার নিজেকেই কেমন 'সেলফিশ' মনে হচ্ছে!

'কি পড়ছো?'
'না, আসলে পড়ছিনা। জাস্ট বইটা বের করেছি মাত্র। পড়তে ইচ্ছে করছে না যদিও!' - রঞ্জু বিব্রত হয়ে জবাব দেয়।
'হুম! "দি সেলফিশ জিন", আমার অবশ্য এ ধরনের বইতে খুব একটা আগ্রহ নেই।' -বলেই জোয়ানা বইটি হাতে নিয়ে একবার দেখে।
'তুমি কোন ধরনের বই পছন্দ কর?' -রঞ্জু জানতে চায়।
'ফ্যান্টাসি-থ্রিলার জাতীয় বই'- জোয়ানা জবাব দেয়। 'তবে এবার সঙ্গে করে কোনো বই আনিনি। মাত্র দু' ঘন্টার ফ্লাইট তো তাই।'

কোন ফাঁকে প্লেন মাঝ আকাশে উঠে গেছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই রঞ্জু এবং জোয়ানার। তারা গল্প করেই চলেছে। বইয়ের গল্প, শৈশবের গল্প, দেশের গল্প। সুন্দরী এয়ারহোস্টেজ ড্রিঙ্কস এবং খাবার দিয়ে গেছে। জোয়ানা নিয়েছে চিজ পিজা এবং সাথে এক গ্লাস রেড ওয়াইন। রঞ্জু নিয়েছে পিজা এবং এক গ্লাস এপেল জুস। গল্প খাওয়া-দাওয়া ফ্রি ড্রিঙ্কস, নির্ঝঞ্জাট ফ্লাইট সবই এনজয় করছে রঞ্জু ও জোয়ানা।

এরই মধ্যে হঠাত প্লেনের ক্যাপ্টেনের ঘোষণা: 'সামনে টারবুলেন্সের আভাস পাওয়া গেছে। যাত্রীগণ বাম্পি রাইড অনুভব করতে পারেন। তবে ভিত হওয়ার কিছু নেই। সবাই সিট্ বেল্ট বাঁধুন।'

বলতে বলতেই পুরো প্লেন বাম্প করতে শুরু করে দেয়। বাতাসের উপড় এমন জোরে প্লেনটি আছড়ে পরছে যেন এক্ষুনি প্লেনটি ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয়ে যাবে! হঠাত প্লেনটি দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে। এমন দ্রুত নামতে থাকে, যেন রঞ্জুর কাছে মনে হয় প্লেনটি এক্ষুনি মাটিতে আছড়ে পরবে। প্লেনের ইঞ্জিন থেকে এক ধরনের অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ শব্দ বের হতে থাকে। রঞ্জু বুঝে যায় যে আজই তার জীবনের ইতি হতে যাচ্ছে। প্লেনে সবাই চিত্কার করতে থাকে, কিন্তু রঞ্জু কোনো শব্দই শুনতে পায় না। রঞ্জুর কানে শুধু তীক্ষ্ণ বিভত্স ইঞ্জিনের শব্দ। রঞ্জু তার নিজের ভর অনুভব করতে পারে না। সে শুধু অনুভব করে, কে যেন তার বাম হাত এবং বাহু শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে! রঞ্জু কিছুই দেখতে পায় না। সে তার চোখ দুটো বন্ধ করে আছে। তার কাছে সময় যেন স্থির হয়ে গেছে!

'কি খুব ভয় পেয়েছ?'
জোয়ানার ডাকে রঞ্জুর হুঁশ ফিরে আসে।
'না, খুব না তবে কিছুটা ভয় পেয়েছি তা বলতেই হবে' - রঞ্জু জবাব দেয়।
'তুমি ভয় পাওনি?' -রঞ্জু জানতে চায়।
'নাহ! একদমই না! আমি তো এনজয় করেছি!' -জোয়ানার জবাব।
'তাহলে এগুলো কি?' রঞ্জু তার হাতে জোয়ানার নখের গাড় হয়ে বসে যাওয়া দাগগুলো দেখিয়ে বলে।
'হুম! সরি' -জোয়ানা কিছুটা লজ্জিত হয়।
রঞ্জু নিচে পরে যাওয়া বইটি তুলতে তুলতে বলে, 'ইট'স ওকে, জোয়ানা।'

টার্বুলেনসের সময় জোয়ানা কিভাবে রঞ্জুকে আঁকড়ে ধরেছিল, রঞ্জু তা জানে না। তবে সে পরিষ্কার বুঝতে পারে যে তার বা' বাহু এবং কাঁধে জোয়ানার পারফিউমের গন্ধ লেগে গেছে। তার কাছে মনে হয় শান্তা যেন তাকে জড়িয়ে ধরে আছে! শান্তার শরীর সরীসৃপের মত কেমন ঠান্ডা! রঞ্জুর গা' শিহরিত হয়ে উঠে। তবে জোয়ানাকে রঞ্জু আপন ভাবতে শুরু করে! অনেক আপন!

তিন.
স্থানীয় সময় রাত ঠিক দশটায় প্লেনটি মিউনিখ এয়ারপোর্টে অবতরন করে। তারাতারিই ইমিগ্রেশন চেক-আপ সম্পন্ন হয়। জোয়ানা এবং রঞ্জু দু' জনই মিউনিখ শহরে নতুন। এবং কেউই জার্মান ভাষা জানে না! কিছুক্ষণের ভেতরেই ওরা দু' জন এয়ারপোর্টের বাইরে বের হয়ে আসে। বাইরে বেড়িয়েই রঞ্জু হতভম্ব! বাইরে থেকে মিউনিখ এয়ারপোর্ট দেখতে আরো সুন্দর এবং জীবন্ত! তখন রাত এগারোটা। তবুও চারদিকে সোডিয়াম লাইটের আলোতে ঝক ঝক করছে সব কিছু। লোক সমাগমও আছে। ইউকে’তে রঞ্জু এমন কখনো দেখেনি। লন্ডনের হিথ্রো, ম্যানচেস্টার এবং লিভারপুল এয়ারপোর্টে রঞ্জু গেছে অনেকবার- ইউকে’র সব এয়ারপোর্টই একই রকম- নির্জীব মৃত! আর মিউনিখের এয়ারপোর্ট জীবন্ত। রঞ্জুর মন চট করেই ভালো হয়ে যায়!

জোয়ানা ব্যাগ থেকে জার্নি প্ল্যান এবং ম্যাপ বের করে। রিসার্চ ট্রেনিংএ যারা অংশগ্রহণ করছে তাদের সবার জন্য হোটেল ঠিক করা হয়েছে গ্রোসাডার্নে। এয়ারপোর্ট থেকে যেতে সময় লাগবে ৪০ মিনিট। তাদেরকে ‘এস-বান’ মেট্রো ট্রেনে প্রথম যেতে হবে মারিয়েনপ্লাট্জ। সেখান থেকে ট্রেন চেঞ্জ করে উঠতে হবে ‘ইউ-বান ৬’ এ, এবং যেতে হবে গ্রোসাডার্ন। গ্রোসাডার্ন স্টেশন থেকে হোটেল মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটা পথ।

'হোটেল খুঁজে পেতে মনে হয় তেমন একটা সমস্যা হবে না!' - জোয়ানা রঞ্জুকে উদ্দেশ্য করে বলে।
'হুম, তাই তো মনে হচ্ছে' -রঞ্জু সায় দেয়।
'চল সামনে এগোনো যাক, সম্ভবত সামনে থেকেই ট্রেনের টিকেট কিনতে হবে।' – জোয়ানা ব্যাগ হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
'খিদেয় পেট চো চো করছে। কিছু একটা খাওয়া দরকার। সম্ভবত: এত রাতে হোটেলে পৌঁছে কোনো খাবার পাওয়া যাবে না।' -রঞ্জু বলে।
'আমারও বেশ খিদে পেয়েছে। চল ডিনার করা যাক।' - জোয়ানা এদিক ওদিক রেস্টুরেন্ট খুঁজতে থাকে।

কিছুটা এগোতেই ওরা একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে পায়। সম্পূর্ণ ওপেনএয়ার রেস্টুরেন্ট। লাউড স্পিকারে গান বাজছে। গানের সাথে কেও কেও আবার নাচছেও। জোয়ানা অর্ডার দেয় চিকেন এন্ড চিজ সালাদ এবং এক গ্লাস রেড ওয়াইন। রঞ্জু নেয় 'বেভারিয়ান ডিশ'- বিফ এবং চিজ দিয়ে তৈরী এক ধরনের জার্মানি ট্রেডিশনাল খাবার সাথে এক গ্লাস রেড ওয়াইন। হঠাত শুরু হয় টেক নাইন এর 'পার্টি দ্যা পেইন এওয়ে' গানটি। গানটি এমন যে এর তাল যে কাওকে নাচতে উত্সাহ যোগায়। চারদিকে এরই মধ্যেই অনেকেই নাচতে শুরু করেছে।

জোয়ানা-রঞ্জুও বাদ যায় না। নাচের সুবাদে জোয়ানা রঞ্জুর আরো কাছাকাছি চলে আসে। হিপনোটিক পয়্জনের তীব্রতা আর শারীরিক কোমলতার আলতো স্পর্শ জোয়ানাকে পরিনত করে জীবন্ত এক শান্তায়, - রঞ্জুর কাছে অন্তত তাই মনে হয়। জোয়ানার স্ফীত বক্ষযুগলের উষ্ণতা রঞ্জুর টগবগে আকাঙ্খাগুলোকে করে তুলে আরো জৈবিক। ওরা নেচে চলে হিপ হপ মিউজিকের তালে তালে।

রঞ্জুর হঠাত হুঁশ হয় যে তাদের রাত বারোটার শেষ ট্রেনটি ধরতে হবে। তখন বারোটা বাজতে আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি। কোনো রকমে খাবারের বিল পরিশোদ করে দৌড়ে গিয়ে ওরা শহরমুখী এস-বান মেট্রো ট্রেনে উঠে পরে। গ্রোসাডার্ন ট্রেন স্টেশনে যখন ওরা পৌঁছায় তখন ১ টা বাজতে ১৫ মিনিট বাকি। গভীর রাত। কোনো কাক-পক্ষিও নেই রাস্তায়! তবে চারদিক সোডিয়াম বাতির আলোয় ঝকঝক করছে। জোয়ানাকে রঞ্জুর কাছে হলুদ পরীর মত মনে হয়। ওরা দুজনেই পশ্চিম দিক বরাবর হোটেলের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে। এলকোহলে আবিষ্ট জোয়ানার বেসামাল হাঁটা দেখতে রঞ্জুর কাছে বেশ ভালই লাগে! তবে রঞ্জু লক্ষ্য করে যে আকাশটা কেন যেন আজ অস্বাভাবিক রকম কালো!

চার.
ওরা যখন হোটেলে গিয়ে পৌঁছে তখন ঠিক রাত ১ টা। রিসিপসন ডেস্কে কেউ নেই। ডাকাডাকি করতেই অর্ধ ঘুমন্ত অবস্থায় একজন বের হয়ে আসে ভেতর থেকে।

'হাউ ক্যান আই হেল্প?'

রঞ্জু ও জোয়ানা ওদের পরিচয় দেয়াতে লোকটির ঘুম সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে যায়! হাসি মুখে এবার সে বলে, 'তোমারাই লাস্ট। কুড়ি জনের ভেতরে বাকি আঠারো জন সবাই আজ সন্ধ্যায়ই এসে গেছে।' - বলেই দু' জনকে দুটো চাবি ধরিয়ে দেয়, আর বলে, ব্রেকফাস্ট সকাল ৬ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত। রাতের খাবার পরিবেশন করা হয় সন্ধ্যা ৭ টা থকে ৯:৩০ এর মধ্যে। রঞ্জুর রুম তিন তলায় এবং জোয়ানার দো'তলায়।

'আমাকে একটু রুমে পৌঁছে দিবে রঞ্জু, প্লিজ। আমি রুম খুঁজে নাও পেতে পারি। এলকোহল কাইন্ড অফ গট মি, আই থিঙ্ক!'
'শিওর। নো ওরিস।' -বলেই ওরা দু' জন লিফটের দিকে এগোলো।

২৪ নাম্বার রুম জোয়ানার। খুব সহজেই ওরা রুমটি খুঁজে পায়। অবশ্য রুম খুঁজে না পাওয়ার মত বড় নয় হোটেলটি। রুমের দরজা খুলতে খুলতে জোয়ানা বলে, 'কাম ইনটু মাই রুম। আই উইল মেক ইউ সাম কফি!'

এত রাতে সুন্দরী একটা মেয়ে নিজ হাতে কফি বানিয়ে খাওয়াতে চাচ্ছে- রঞ্জুর "না" বলার কোনো প্রশ্নই আসে না। ওরা রুমে ঢুকে পরে। রুমে ঢুকেই রঞ্জুর কাছে মনে হয় সে যেন খুব ঠান্ডা পানি ভর্তি একটা রুমে ঢুকেছে! তার সারা শরীর ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে! সে গলা উঁচু করে স্বাস নেয়ার চেষ্টা করে। রঞ্জুর কাছে মনে হয়, সে এক্ষুনি অতল কোনো গভীরে তলিয়ে যাবে। রঞ্জু চিত্কার দিয়ে উঠে, কিন্তু তার গলা থেকে কোনো শব্দই বের হয় না!

ইলেকট্রিক কেতলিটা অন করে জোয়ানা বলে, 'আরাম করে বস রঞ্জু। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।'

জোয়ানার কথায় হুঁশ ফিরে আসে রঞ্জুর। সে আবার নিজেকে খুঁজে পায়। সে বুঝতে পারে যে সে মারা যাচ্ছে না। তার কাছে কোনো ঠান্ডাও অনুভূত হচ্ছে না! বরং তার কিছুটা গরমই লাগছে এখন। রঞ্জু গা’ থেকে জ্যাকেটটি খুলে বিছানার উপর রাখে। আয়নায় নিজেকে একটু দেখে নেয়। হঠাত রঞ্জু অনুভভ করে রুমটি 'হিপনোটিক পয়্জনের' গন্ধে ভরে উঠেছে! গন্ধের তীব্রতা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পেছনে তাকাতেই সে দেখতে পায় জোয়ানার এক অন্যরকম রূপ! প্রকৃতি যতটুকু সোন্দর্য একটা মেয়ের অবয়ব জুড়ে লেপ্টে দিতে পারে তার সবটুকুই যেন জোয়ানার অনাবৃত নগ্ন দেহে ফুটে উঠেছে! স্বপ্নের স্বপ্নপরী হয়ে মেয়েটি এসে দাড়িয়েছে রঞ্জুর সামনে। রঞ্জু চিনতে পারছেনা মেয়েটিকে! ও কি জোয়ানা, নাকি শান্তা, নাকি পরী? রঞ্জু টের পায় তার অজান্তেই তার প্রতিটি স্নায়ুকলা জেগে উঠছে বেহায়ার মত। সে টের পায় তার ভেতর থেকে নিকৃষ্ট কালো পশুটি বের হয়ে আসছে সর্বশক্তি নিয়ে - ঠিক যেভাবে বের হয়ে এসেছিল দু’ বছর আগে। সে অনুভব করে দুটি সিক্ত ঠোঁট তার ঠোঁট দুটোতে লেপে দিচ্ছে লালা গ্রন্থির উজ্জীবনী নির্যাস। রঞ্জু পাগলের মত শুঁকে শুঁকে খুঁজে চলে শান্তা নামের মেয়েটির অস্তিত্ব উন্মুক্ত জোয়ানার প্রতিটি শারীরিক ভাঁজে।

'আহ! রঞ্জু, ছাড় ছাড় আমি স্বাস নিতে পারছি না! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।' - জোয়ানার আকুতি রুমের প্রতিটি দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

রাতের কুত্সিত কালো আকাশে একটি উজ্জল তারা খসে পরে। জোয়ানার কন্ঠ থেকে বের হওয়া শব্দগুলো মিলিয়ে যায় সময়ের অসীম ঘনত্বে। রঞ্জুর দানবীয় কালো পশুটি ক্লান্ত হয়ে ফিরে যায় তার পুরনো খোলসে!

*****
চার্চের ঘন্টা ধ্বনিতে রঞ্জুর ঘুম ভাঙ্গে সকাল ৬ টায়। সে তার নিজের রুমেই ঘুমিয়েছে রাতে। ঘুম থেকে উঠেই রঞ্জু গত রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পুন্খানুপুন্খ ভাবে মনে করার চেষ্টা করে। 'হুম', রঞ্জু মাথা নাড়ে। জোয়ানার রুমে সবকিছু ঠিকঠাক মতোই রাখা আছে। রঞ্জু টের পায় যে তার নিজের গা' থেকে বিভত্স একটা গন্ধ বের হচ্ছে। লাফ দিয়ে সে বিছনা থেকে উঠে সোজা ঢুকে পরে বাথরুমে। শ্যাম্পু এবং শাওয়ার জেল দিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে। মাথা মুছতে মুছতে নিজেকে আয়ানাতে দেখে একবার। খুব সাবধানে সে তার কালো পশুটাকে খুঁজে। না, সে এখন মুক্ত। তার দেহে অথবা মনে কোথাও কালো পশুটার কোনো চিহ্নই নেই! স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে রঞ্জু।

তরিঘরি নাস্তা করে সে রওনা দেয় তার ট্রেনিং সেন্টারের দিকে। হোটেল থেকে ট্রেনিং ভেন্যু ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। বিশাল হাসপাতাল। ম্যাপ দেখে সে খুঁজে বের করে ট্রেনিং এর জন্য নির্ধারিত রুমটি। ট্রেনিং প্রোগ্রামের ডিরেক্টর উদ্বোধনী বক্তৃতায় ট্রেনিং প্রোগ্রামের উপর একটা সম্যক ধারণা দেয়। এর পর শুরু হয় পরিচয় পর্ব। সবাই এসেছে, শুধু আসেনি ডক্টর জোয়ানা এক্লিডা!

একটা হালকা নাস্তা পর্বের পর ট্রেনিংএ অংশগ্রণকারী ১৯ জনকে দুইটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। এক গ্রুপে ১০ জন এবং রঞ্জু যে গ্রুপে সে গ্রুপে ৯ জন। রঞ্জুর গ্রুপে জোয়ানার থাকার কথা ছিল। গ্রুপ বিভক্তির পর পুরোদমে ট্রেনিং কর্মকান্ড শুরু হয়ে যায়। যে দু' দিন ট্রেনিং চলে সে দু' দিন জোয়ানার খোজ আর কেও নেয় না। রঞ্জু মনোযোগ দিয়ে ট্রেনিং এর প্রতিটি মডিউল সম্পন্ন করে। দু' দিনের ট্রেনিং শেষ করে সে ম্যানচেস্টার ফিরে আসে এবং স্বাভাবিক ভাবেই কাজে যোগ দেয়।

একটি সপ্তাহ পার হয়ে যায়। এক সন্ধ্যায় বিবিসি নিউজে দেখাচ্ছে যে ডক্টর জোয়ানা এক্লিডা নামের একজন ব্রিটিশ চিকিত্সক এবং গবেষকের মৃত দেহ পাওয়া গেছে মিউনিখের গ্রোসাডার্ন এলাকার একটা হোটেলে। লাশটি লুকানো ছিল বিছানার বক্সের ভিতরে। লাশটি এক বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক ব্যগে আটকানো ছিল যাতে করে তা দ্রুত পঁচে না যায়। ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলছে মেয়েটিকে গলা টিপে স্বাস রুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। যৌনক্রিয়া বা ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। কে বা কারা মেয়েটিকে হত্যা করেছে পুলিশ আপাতত কিছু বলতে পারছে না। তবে জার্মানির গোয়েন্দা বিভাগ অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। রঞ্জু নির্বাক দৃষ্টিতে খবরটি দেখছে আর একটু একটু করে তার কফি কাপে চুমুক দিচ্ছে। একটু পরেই তার ট্রেন। আজ সন্ধ্যা ৬:৩০ এ সে যাচ্ছে এডিনবরা। ওখানে তিন দিন থাকবে সে। নিসঙ্গ ছুটি কাটাবে।

ভার্জিনের স্কটল্যান্ডগামী ট্রেনের জানালার পাশের সিটে বসে পেপার পড়ছে রঞ্জু। একটু পরেই ট্রেন ছাড়বে। হঠাত একটা অতি পরিচিত পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসে রঞ্জুর নাকে। রঞ্জু অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। একটা সুন্দরী পাকিস্থানি মেয়ে এসে বসে রঞ্জুর পাশের সিটে। রঞ্জুর বুঝতে বাকি থাকেনা যে পারফিউমের বিশেষ সুবাসটি আসছে এই মেয়েটির গা' থেকেই। মেয়েটি রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, 'হাই'! রঞ্জুও বলে, 'হাই' - তবে হাসিটি দিতে ভুলে যায়। রঞ্জুর শুধু শান্তার কথা মনে হতে থাকে! বাইরে রাতের অন্ধকার গাড় থেকে গাড়তর হয়।

[শেষ সংস্করণ: ২৩ জানুয়ারী ২০১৫]

--------------------------------------
খোনদকার মেহেদী আকরাম,
শেফিল্ড
১৮ ডিসেম্বর ২০১৪

[রচনা কাল: ২৫ নভেম্বর ২০১৪ থেকে ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪। গল্পের চরিত্র গুলো কাল্পনিক। গল্পটি লেখা হয়েছে গুগল ট্রান্সলেটে। অসংখ্য বানান ভুল রয়েছে! © All rights reserved by the author]
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৮:৩৫
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×