ভেবেছিলাম থাকবার জায়গাটি সস্তা হওয়াতে ছোট খাট কোনো মোটেল হবে, কিন্তু গিয়ে দেখি সে এক বাংলো টাইপ বাসা, সামনে সাগর, পেছনে পাহাড়। প্রাকৃতিক নৈসঃর্গিকতার অভাব নেই। ঠিক করা হল কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যাওয়া হবে পিবল বা নুড়িপাথরের সৈকতে। এর আগে সব স্যান্ডি বীচে গেলেও পিবল বীচে এই প্রথম। পায়ের দিকে খেঁয়াল না রেখে পিচ্ছিল পাথরে হোচট খেলে আঘাত পাবার সমুহ সম্ভাবনা!
পীবল বীচে ...
তবুও ভালোই লাগলো সৈকতটা, চাড়া পাথর দিয়ে ব্যাঙলাফ খেললাম সমুদ্রে, সাথেই একটা পাথুরে টিলার মতন ছিলো, সকলের আবার রক ক্লাইম্বিং করার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, কি আছে কপালে, চোখা চোখা পাথরগুলো বেয়ে টিলার ওপরে উঠে গেলাম আমরা চারজন, বাকিরা উঠলো কাঠের সিড়ি বেয়ে বেয়ে।
পাথরের গা বেয়ে বেয়ে ...
বার-বি-কিউ...সকলের লোভাতুর দৃষ্টি!
পিবল বীচ থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয় হয় অবস্থা। পাহাড়ের কোলে আলো আধাঁরীর লুকোচুড়ি, সাগরের গর্জন আর লোনা পানির গন্ধ এ তিনে মাতাল হবার যোগার। পোর্চের নিচে গাড়ি পার্ক করে পেনসনের মালিক চালিয়ে দিলেন ইউরোপিয়ান সূরের কোরিয়ান সঙ্গীতের এল পি। আর আমরা আয়োজন শুরু করলামবার-বি-কিউ পার্টির। ওহ, বলা হয়নি, বার-বি-কিউ তৈরীর সকল উপকরণ সাথে নিয়ে আসা হয়েছিলো, আর দ্বীপ থেকে কেনা হল মুরগী। খোলা প্রান্তরে বীচের পার্শ্বে বার-বি-কিউ বানানোর আপ্রাণ চেষ্টায় নিমজ্জিত আমরা আর ওদিকে এমবিএ পড়ুয়া তানিম সুতীব্র রোমান্টিক পরিবেশে মোহাচ্ছন্ন করা অনুভূতি গুলো শেয়ার করার জন্য দেশে পড়ে থাকা বান্ধবীর সাথে মুঠোফোনে আলাপে নিমগ্ন! বার-বি-কিউ খেতে কেমন হয়েছে সেটা খুব একটা মুখ্য ব্যাপার না! খাওয়া শেষ করে রাতের আধাঁরে আবার বীচে ঘুরতে যাওয়া হল, রাতের সৈকতে বালুচরে পা ভিজিয়ে রাখাটা স্বরণীয় হত যদি হাতে হাত ধরে পাশে কেউ থাকত!
অথবা এখানে বসে পার করে দেয়া যায় অনন্তকাল...
সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে ডিসিশন নেয়া হল আজ পুরো দ্বীপ চষে বেড়াব, গাড়ী না পেলে বাসে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম সবাই। ইলশে গুড়ি ধরনের বৃষ্টি পড়ছিলো, ইংরেজিতে কি যেন বলে- ড্রিজলিং। হেটে হেটে একটা খাড়ির কাছাকাছি আসলাম সবাই, সারি সারি করে ফিশিং ট্রলারগুলো সাজানো। খুব লোভ হচ্ছিলো একটা ফিশিং ট্রলার নিয়ে উধাও হয়ে যাই দূর নীল জলরাশির মাঝে।
ফিশিং ট্রলার...
ভিজে চুপসে একাকার!
কিন্তু কপাল মন্দ, বৃষ্টি আর উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ এর কারনে সব মাছ ধরার ট্রলার খাড়িতে, কাউকেই রাজী করানো গেল না। একটা মার্ট থেকে কিছু বাজার সদাই করে আবার পেনশনে ফিরে গেলাম, লাঞ্চ করে আবার বের হলাম সবাই। ততক্ষণে বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলেও বাতাসে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ চলে যায়নি। মেঘগুলো নিচে নেমে পাহাড়ের গায়ে যেন লেগে লেগে আছে।
এবার বাস ধরে সকালের ঠিক উল্টো রাস্তায় যাওয়া শুরু করলাম। দু-তিন জন বিদেশী ট্যুরিস্ট আর আমরা ছাড়া পুরো বাসটাই ফাঁকা। পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিল আঁকা-বাকা পথে চলছে আমাদের লৌহ সরিসৃপ, পাহাড়ী পথে চলতে নার্ভাস ব্রেকডাউন হওয়াটা অস্বাভাবিক না। নিচে খাঁদ, সাগরের লাগোয়া আর আঁকাবাকা সরু পিচ্ছিল পথে খাড়া ভাবে বাস উঠছে, আর চারিদিকে মেঘ! হ্যাঁ মেঘের স্তরটি খুব নিচে চলে এসেছিলো, আর আমরা ছিলাম পাহাড়ের মাঝামাঝি, এত্ত সুন্দর দৃশ্য যা কল্পনার বাইরে অনুধাবন করাটা দুঃসাধ্য।
কল্পনার ফানুষ গুলোকে ছেড়ে দিয়ে নিতান্তই এ পৃথিবীতে তুচ্ছ মনে হয়। প্রকৃতির কাছাকাছি এসে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হতে থাকে এই বিশাল জলরাশির কাছে। পাহাড়ের প্রতিটি বাঁক যেন জীবনের এক একটি মোড়, আর ওপারের সুবিশাল নীল জলরাশি যেন আমার চাওয়া পাওয়ার হিসেব। মানুষের চাওয়ার বুঝি আর শেষ নেই।
একটুখানি ভাবযযয !
যাত্রার দু ঘন্টা পর বাস আমাদের গোজে দ্বীপের ডাউনটাউনে নামিয়ে দিয়ে গেল। এ এলাকাটা আমার সামান্য পূর্ব পরিচিত ছিলো কিন্তু ঠিকমতন ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না। পেট খালি রেখে প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করাটাও ঝামেলার, ম্যাকে ঢুকলাম সবাই, বার্গার খাবার জন্য। এদিকে ওপরতলায় থিয়েটারে দেখি রেসিডেন্ট ইভল ৩-ডি চলছে। শেষ ৩-ডি ম্যুভি দেখেছিলাম স্টেপ আপ, এভাটারের পরে। সবাইকে পটিয়ে রাজি-ও করে ফেললাম কিন্তু সত্যি বলতে কি, ম্যুভিটা একটুও ভালো লাগেনি। হলিউডে এখন এ সব জম্বি টাইপের ম্যুভিতে ভরপুর, বিরক্তিকর কাহিনী, গা গুলানো সব জম্বি। থিয়েটার থেকে বের হয়ে সে এক ঝামেলা হল বাস নিয়ে, শেষ বাসটিও ছেড়ে গিয়েছে, হাটা শুরু করে দিলাম রাতের বেলা আবার, সাগর পাড় ঘেষে ফুটপাথ, টানা দু কিমি। অতঃপর এক ফিলিপিনো মেয়ে হেল্প করল ট্যাক্সি ঠিক করে দেয়ার জন্য। ট্যাক্সি ভাড়া দেখে চক্ষু চড়কগাছ, সত্তর ডলার!
ডাউনটাউনে...
রাতের গোজে ...
রুমে এসে প্ল্যান করা হল বিরিয়ানী রান্না করা হবে, কিন্তু রাইসকুকারে! আসলে রাইসকুকারে রান্না করাটা বেশ বড় একটা আর্ট, একটা শিল্পকর্মের কাছাকাছি বলা যায়। তানিম আর আমাদের দলের একমাত্র ভারতীয় বাঙ্গালী মোহরের সহযোগীতায় রান্না কমপ্লিট হল...খেতে কেমন হয়েছে...সেটা আর নাই বা বললাম! আজ রাতই গোজে দ্বীপে শেষ রাত। তাশ খেলতে বসলাম, টেরেসের নীচে। চন্দ্রালোকিত জোছনার রাতে সাগরের বালিয়ারিতে তাশ খেলার মজাটাই অন্যরকম। এদিকে মামুন ভাই তার আইফোনে আবিদা পারভীনের হীর ছেড়ে দিলেন। আসলে হীর শোনার জন্য তা ভালো করে বোঝাটা জরুরী, মোদ্দা কথা উর্দ্দুর ওপর ভালো দখল থাকতে হবে। আমি আধ্যাতিকতার আলোকে হতে শত আলোকবর্ষ দুরের এক নিস্প্রভ অনুজ্জ্বল ও অতি নিম্ন শ্রেণীর শ্রোতা, তাই হীর আমার কাছে অর্থহীন চিৎকারের মতন লাগছিলো বিধায় মামুন ভাইকে শত অনুরোধের পর বিরাস বদনে হীর বন্ধ করে আবার খেলায় মন দিলেন। কাল বেশ সকালে উঠে বাড়ি ফেরার জন্য বাস ধরতে হবে, ঘুমানোটা জরুরী, কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছেও করছিলোনা।
রাত যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল সেদিন...ক্লাইম্যাক্সের রাতগুলো খুব দ্রুতই কেটে যায়।।
ফটোক্রেডিটঃ কাজি মামুন ও আমি। পুরো কালেকশনঃ এখানে
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১০ সকাল ১০:২৬