গল্পের মূল চরিত্র আমি হলে হয়তো আজ গল্পটা লেখা সম্ভব হতনা। আম্মার মুখে শুনলেও নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম। ভূমিকা না করে মূল ঘটনায় আসি। আমাদের পাশের বাসার এক ভাবীর ছোট ভাই এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে বোনের বাসায় থেকে কোচিং করছে। হরতালের শিডিউল দেখে হরতালের আগের দিন গ্রামে নিজের বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছে। তাদের পৈতৃক ভিটা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায়। হরতালের আগের দিনের ঝামেলা এড়াতে সে লোকাল বাসে না গিয়ে লোকাল সিএনজিতে সিলেট শহর থেকে বিয়ানীবাজার পর্যন্ত যায়। পথে একবার তার বাবার সাথে কথা হয়। বিয়ানীবাজার নামার পর কোন সিএনজি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলোনা। এমন সময় এক সিএনজি ড্রাইভার এসে তাকে বলে যে তার দুইজন প্যাসেঞ্জার রেডি আছে। সে চাইলে যেতে পারে। সরল মনে ছেলেটি সিএনজিতে উঠে পড়ে। বসার পর সে চোখের সামনে একটা হাতের নড়াচড়া টের পায়। এরপর তার আর কিছু মনে নাই। পথিমধ্যে তার জ্ঞান ফিরলে সে টের পায় তার গ্রামের বাজার পার হয়ে যাচ্ছে। তার মামার দোকানও সে দেখতে পায়। তখন সে লোকদুটিকে বলে তাকে নামিয়ে দিতে। বলার পর তাকে আবার অজ্ঞান করে ফেলা হয়। এমতাবস্থায় তাকে মৌলভীবাজারের ভানুগাছ নিয়ে যাওয়া হয়। জ্ঞান ফিরে এলে তাকে আবার অজ্ঞান করে ফেলা হয়। একসময় সে আবিষ্কার করে নিজেকে এক সুন্দর সাজানো শহরে। কারণ সে আগে কখনও ঢাকা যায়নি। তাকে খুব দামি একটা পাজেরো গাড়িতে তোলা হয়। তারপর সে আর কিছু বলতে পারেনা। আবার জ্ঞান ফেরার পর সে টের পায় তাকে কোন এক টিলার উপরে দড়িতে বেঁধে তোলা হচ্ছে। তাকে জঙ্গলের মধ্যে একটা কুটিরের মত ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢোকার সময় এক ঘরে সে অনেক ধারালো অস্ত্রপাতি, কয়েকটা পানিসুদ্ধ বোল ও একটি বড় টেবিল দেখতে পায়। তাকে মোটামুটি অন্ধকার একটা ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। আলো সয়ে আসলে সে দেখতে পায় ঘরের মধ্যে সে ছাড়াও আরেকটি মেয়ে বন্দী আছে। কথাপ্রসঙ্গে সে জানতে পারে মেয়েটিও তার মত এইচএসসি পাস করে ঢাকায় কোচিং করতে এসেছে। কোচিংয়ে যাবার পথে সিএনজিতে তাকে অপহরণ করা হয়। এমতাবস্থায় ঘরের মধ্যে মানুষজন চলে আসলে তারা নিজ নিজ জায়গায় ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। লোকগুলোর কথা থেকে তারা জানতে পারে পরদিন সকাল ১০টায় তাদের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু কি ব্যবস্থা করা হবে তা জানা যায়নি। লোকগুলো চলে গেলে আতঙ্কিত ছেলেমেয়ে দুটো পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। জেনারেটরের উপরে একটা ভেন্টিলেটর চোখে পরলে ছেলেটি ঐটার রড ভাঙতে চেষ্টা করতে থাকে। দুজন মিলে অনেক চেষ্টা করেও সম্ভব না হওয়াতে ছেলেটি জেনারেটরের হাতল ভেঙ্গে তা দিয়ে রডে বাড়ি দিতে থাকে এবং এক সময় তা ভেঙ্গে যায়। জেনারেটরের শব্দে তা চাপা পড়ে যায়। এরমধ্যে মেয়েটি বের হয়ে যায়। ছেলেটি বের হবার চেষ্টা করতেই পেছন থেকে পাহারারত লোকটি তাকে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু সে তখনও হাতলটা ছেড়ে দেয়নি। তা দিয়েই পেছনের লোকটিকে কুপোকাত করে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। পথিমধ্যে অনেকের হাতে পায়ে ধরলেও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। একসময় সে একটি মসজিদে ঢুকে পড়লে এক বৃদ্ধ নামাজী ভদ্রলোক তার ফোন থেকে তাকে ফোন করতে দেন। ছেলেটি তখন তার বাবাকে ফোন করে জানায় সে অমুক এবং সে নারায়ণগঞ্জ আছে। তারপরের ঘটনাতো আমি না বললেও আপনাদের জানা। সেই ভদ্রলোকের সহায়তায় অবশেষে ছেলেটি তার বাড়িতে ফিরে আসে। তবে সেই মেয়েটির খবর আর পাওয়া যায়নি।
এতটুকু আমার মায়ের মুখে শোনা। এতো গেল ছেলেটির কথা। এই কয়দিন আমি নিজে দেখেছি তার পরিবারের আহাজারি যা সংক্রমিত হয়েছিল আমার মায়ের মধ্যেও। গত কয়েকদিন আম্মা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে এই ছেলেটির জন্যে দোয়া করেছেন। মা হিসেবে এই অনুভূতি হয়তো সার্বজনীন। এমন ঘটনা আমাদের অজান্তেই প্রতিদিন ঘটে যাচ্ছে। কত মায়ের বুক এভাবে খালি হয়ে যাচ্ছে। আমরা যারা মধ্য আয়ের মানুষ তারা প্রতিদিন যাতায়াতের খরচ বাঁচাতে এমন অনেক লোকাল সার্ভিসের শরনাপন্ন হই। আমি বলছিনা আমাদের সব কাজ বাদ দিয়ে ঘরে বন্দী হয়ে বসে থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের সামান্য সতর্কতা এমন অনেক বিপদের হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। শুধু নিজে বেঁচে গেলেই হবেনা। বাঁচাতে হবে এমন অনেক মায়ের সন্তানদের। আমরা সবাই একটু সতর্ক হলেই এরকম অনেক চক্র হাতেনাতেও ধরা সম্ভব। তাই আজকের দুনিয়ায় বাঁচতে হলে জানতে হবে এবং লড়াই করতে হবে। কারণ নিজের বিপদ নিজেকেই প্রতিহত করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৫৭