পাঠকগণ ব্লগে সাধারণত মজার বিষয়গুলো পড়তে আসেন। তত্ত্বীয় আলাপ আলোচনা দেখে সময় নষ্ট করার জন্য কেউ আগ্রহী থাকেন না। বুক রিভিউ জিনিসটাও একঘেয়ে ব্যপার। বুক রিভিউতে পাঠক থাকেন কম। লাইক তো থাকেই না, আর যে কয়েকটি মন্তব্য আসে সেগুলো হয় দায়সারা গোছের। ব্লগে অন্যদের বুক রিভিউগুলো দেখে এরকমই মনে হয়েছে। তবুও প্রিয় উপন্যাসের উপর একটি রিভিউ দেবার ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে পারিনি।
ব্লগের জন্য এটা আমার প্রথম বুক রিভিউ। হয়ত এটি সবার ভালো লাগার মত নাও হতে পারে। আগেই তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সি একটি উপন্যাসের নাম, লিখেছেন আমেরিকান সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। আমাদের চেনা উপন্যাসগুলোর মত এই গ্রন্থের নায়ক বিশিষ্ট কোন ব্যক্তি নন, খুবই সাধারণ একজন জেলে। এই উপন্যাসে কোন প্রেম-ভালোবাসা নেই, যৌনতা নেই, এমনকি কোন নারী চরিত্রও নেই! আপনি হয়তো ভাবছেন, ওমা; এটা আবার কেমন উপন্যাস, একদম নিরামিষ। এরকম যদি ভেবে থাকেন তাহলে ভুল ভাবছেন। কারণ এটি বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম সারির একটি উপন্যাস। বলা যায়, এই উপন্যাসের কারণেই ১৯৫৪ সালে লেখক নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
গল্প সংক্ষেপঃ
সান্টিয়াগো একজন পোড়খাওয়া বৃদ্ধ কিউবান জেলে। তার সহকারী হল ম্যানোলিন নামক একটি ছেলে, বারো তেরো বছর বয়সী। বৃদ্ধ এবং বালক দুজনে মিলে সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত ।
বৃদ্ধ জেলেটি সমুদ্রে মাছ ধরায় ওস্তাদ। কিন্তু ভাগ্য তো সবসময় এক রকম হয় না। ভাগ্যটা খারাপ হবার কারণে বৃদ্ধ জেলে মাছ ধরতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এলো, এভাবে একদিন দুইদিন করতে করতে টানা প্রায় তিনমাস সে কোন মাছ ধরতে পারেনি। দীর্ঘ দিন যাবত মাছ না পেয়ে খালি হাতে ফেরার কারণে লোকটাকে সবাই ‘অপয়া’ হিসেবে গণ্য করতে থাকে। অপয়া হবার কারণে বৃদ্ধের সহকারী বালক ম্যানোলিনকে তার মা-বাবা বৃদ্ধের সাথে মাছ ধরতে যেতে নিষেধ করে দেয়। ম্যানোলিন বৃদ্ধ জেলের সাথে সাগরে না গেলেও সবসময় বৃদ্ধের খোঁজ খবর রাখে। প্রতিদিন বৃদ্ধ জেলে মাছের আশায় যখন সাগরে নৌকা ভাসায়, তখন ম্যানোলিন বৃদ্ধকে যথাসম্ভব সহায়তা করে এবং বৃদ্ধের ভাগ্য ফেরার আশায় সে প্রার্থনা করতে থাকে।
মাছ না পাবার পঁচাশিতম দিনে বৃদ্ধ তার হার্পুন দিয়ে বড় একটি মার্লিন (সোর্ডফিশ) আটকায়। এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, কিউবান মৎস্য শিকারিরা যে পদ্ধতিতে মাছ ধরে থাকে তা আমরা অনেকেই জানি না। আমাদের মনে হতে পারে পুকুরে বড়শি ফেলে মাছ ধরার মত সাগরের মাছ ধরাও খুব সহজ। আসলে মোটেই তা নয়। এই মাছগুলো ধরে নৌকাতে তুলে উপকূলে নিয়ে আসতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। বৃদ্ধ জেলের হার্পুনে ধরা পড়া মাছটা এতো বড় সাইজের ছিল, ওটাকে নৌকাতে তোলাই সম্ভব হয়নি। নৌকার চেয়ে বড় মাছ!
এই মাছ উপকূলে নিতে পারলে জেলের উপর আরোপিত অপয়ার অপবাদ ঘুচবে। মাছটা বেচে অনেক টাকাকড়ি পাওয়া যাবে। এসব কথা ভেবে বৃদ্ধ সিদ্ধান্ত নিল মাছটাকে নৌকাতে না তুলে নৌকার সাথে বেঁধে উপকূলে টেনে নিয়ে যাবে। মাছটাকে মারতে অনেক বেগ পেতে হয়। এই মাছ কিভাবে টেনে নিবে? উল্টো মাছটাই নৌকাসমেত বৃদ্ধকে টেনে মাঝ সাগরে নিয়ে যেতে থাকে। তিনদিন তিনরাত যুদ্ধ করে অবশেষে মাছটাকে বৃদ্ধ বাগে আনতে পারে। এই তিনদিনে বৃদ্ধ কি কি কাজ করল সবকিছুর চমৎকার ধারাবিবরণী রয়েছে উপন্যাসে। মাছটার জন্যে বৃদ্ধের মায়া, নৌকায় বসে তার একা কথোপকথন, সহকারী বালক ম্যনোলিনকে মাঝসাগরে স্মরণ করা কিংবা সামান্য খাবার লবণের জন্য বৃদ্ধের হাহাকার সবই লেখক আশ্চর্য দক্ষতা নিয়ে বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু মাছ নিয়ে বৃদ্ধ লোক নির্বিঘ্নে উপকূলে ফিরতে পারলো না। মাঝপথে হামলা করল ক্ষুধার্ত হাঙরের পাল। শিকার করা মার্লিন মাছটাকে হাঙরের মুখ থেকে রক্ষা করতে বৃদ্ধ নিজের জীবন বাজি রেখে লড়াই করতে থাকে। কিন্তু বাঁচানো যায় না, সবশেষে যখন বৃদ্ধ উপকূলে ফিরে আসে তখন মার্লিন মাছের কংকালটাই কেবল অবশিষ্ট থাকে। ক্লান্ত বৃদ্ধলোক নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় ঢলে পড়ে। গভীর ঘুমে হারিয়ে যায় বৃদ্ধ। এদিকে অন্য জেলেরা বৃদ্ধের নৌকার সাথে বাঁধা বড় মাছের কংকালটা অবাক চোখে দেখে নেয়, সেই সাথে বৃদ্ধের জন্য সবাই সহানুভূতি প্রকাশ করতে থাকে।
বেচারা বৃদ্ধ লোক মাছটাকে আনতে না পারলেও মাছের কংকালের কল্যাণেই তার উপর আরোপিত অপয়া অপবাদ ঘুচে যায়, বৃদ্ধ লোক তার হারানো সম্মান আবার ফিরে পায়। ম্যানোলিন সিদ্ধান্ত নেয় সে আবার বৃদ্ধের সাথে মাছ ধরবে।
কাহিনীর বাস্তবতাঃ
উল্লেখ করার মত একটি তথ্য হল, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কয়েক বছর কিউবাতে ছিলেন। যে উপকূলের কথা উপন্যাসে পাওয়া যায় সেই উপকূলে তিনি হেঁটে বেড়িয়েছেন। সেখানে এক বৃদ্ধ জেলের সাথে লেখকের দেখা হয়েছিল, যে বৃদ্ধ মাঝ সাগরে গিয়ে বড় একটা মাছ শিকার করেও অক্ষত অবস্থায় কূলে তুলতে পারেনি। এই বাস্তব ঘটনার ছায়ায় লেখক লিখেছিলেন দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সি।
আমার মূল্যায়নঃ
মাঝসাগরে একজন বৃদ্ধ মৎস্য শিকারির সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাকে লেখক এতো নিখুঁতভাবে বর্ননা করেছেন, পড়লে মনে হবে যেন লেখক নিজেই সেই বৃদ্ধ লোক। এমনকি একজন ভালো পাঠকের মনে হবে পাঠক নিজেই বৃদ্ধলোকের সাথে নৌকায় অবস্থান করছেন। মজার ব্যপার হল উপন্যাসের লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কখনো সাগরে মাছ ধরতে যাননি। কিন্তু তিনি কিভাবে এতো সুন্দর ঘটনাপঞ্জী সাজালেন? এটাই একজন লেখকের কৃতিত্ব। লেখকের কল্পনাশক্তি এমনই প্রখর হওয়া উচিৎ। হতে পারে লেখক কোন এক বৃদ্ধ জেলের কাছে তার মাঝসাগরে একাকী ভেসে থাকার ঘটনা শুনেছেন। কিন্তু একজন জেলের বর্ণনা নিশ্চয়ই এতো চমকপ্রদ হবে না। সেই শোনা বর্ণনাকে লেখক নিজের মত করে শিল্পসম্মত রুচি অনুযায়ী সাজিয়ে তুলেছেন। সবকিছু ছাপিয়ে এই উপন্যাসের গল্পে যেন সেই বার্তাটিই আমরা পাই- সারভাইভাল ফর দ্যা ফিটেস্ট, যোগ্যতমই টিকে থাকে।
যারা আমার মত নতুন লেখক তাদের জন্য এই উপন্যাস একটি মডেল হতে পারে। এই উপন্যাসে ভাষার জটিলতা নেই, সুগভীর কোন তত্ত্বকথা নেই, আছে শুধু একাকী বৃদ্ধের মাঝসাগরে ভেসে থাকার বর্ণনা। সেই বর্ণনা এতো চমৎকার, পড়তে কেউ মোটেই একঘেয়ে অনুভব করবে না। এই বর্ণনা কৌশল ফলো করলে যে কেউ লেখালেখিতে সফল হতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
জেলেদের নিয়ে আমাদের ভাষায় উপন্যাস আছে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর পদ্মা নদীর মাঝি। তবে পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে যেভাবে জেলে সমাজের সামগ্রিক ছবি চিত্রিত হয়েছে ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সি তেমন নয়। ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সি কেবল একজন বৃদ্ধ মৎস্য শিকারির সংগ্রামের প্রতিচিত্র ।
ছোট একটি রিভিউ হতে উপন্যাসের প্রকৃত মজা পাওয়া যায় না, সবাইকে উপন্যাসটি পড়ে দেখার আমন্ত্রণ রইল।
একনজরে
বইয়ের নামঃ দি ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সি
লেখকঃ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
ভাষাঃ ইংরেজি (আমেরিকান)
বইয়ের ধরনঃ ছোট উপন্যাস, কল্পকাহিনী
প্রকাশঃ নিউ ইয়র্ক, ১৯৫২
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৮