আমি ব্লগে পুরনো নই। মাত্র দুমাস আগে ব্লগে এসেছি।
ব্লগে প্রথম পোস্ট দেবার পর হতেই ব্লগারদের অভূতপুর্ব সাড়া পাচ্ছিলাম। আমার লেখা তখন প্রথম পাতায় আসতো না, অথচ সেসময় আমার পোস্টে এতো মন্তব্য পেতাম, সেফ হবার পরের কোন কোন পোস্টে আমি অত মন্তব্য পাইনি।
সবাই কি চমৎকার মন্তব্য করতো। প্রত্যেকের মন্তব্য ছিল আদর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। আমি তো মহাখুশি, হায় আল্লাহ, এতো ভালোবাসা তো মনে হয় আমার পরিবারের লোকেরাও দেয়না!
এনিওয়ে, তখন আমার কোন এক পোস্টে চাঁদগাজী একদিন দুম করে শক্ত একটা কমেন্ট দিয়ে বসলেন। সেই কমেন্টে সোজাসুজি বলে দিলেন আমার ধারণা ভুল। আমি তো হতবাক, কিরে, লোকটা এ কেমন মন্তব্য করল। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, ইউফেমিজম দিয়ে তো বলতে পারতো আমার বক্তব্যে ভুল আছে। তা না করে প্রকাশ্যে ডাউন দিলেন। সেই পোস্টে চাঁদগাজীর আগে আরও বারোজন মন্তব্য দিয়েছিলেন, কেউ ভুল ধরেননি, উনি ধরলেন। এমন রাগ লেগেছিল, আমার পোস্টটাই ডিলিট করে দিলাম। তখন এই কাজ করতাম, কেউ অপ্রিয় মন্তব্য করলে আস্তে করে পুরো পোস্ট হাওয়া করে দিতাম। এই চাঁদগাজীর উপর সেদিন আমার খুব রাগ লাগলো। কেনই বা রাগ লাগবে না? সব ব্লগার আমাকে এতো সুন্দর প্রশংসা করেন, আর চাঁদগাজী ঠিক উল্টো কাজ করলেন। বাপরে বাপ, নিজেকে কত জ্ঞানী মনে করে এই লোক, আমার ভুল ধরে! আমি নতুন বলে এমন করলো? জেনোফোবিয়া আছে নাকি লোকটার? এটা যদি ব্লগ না হয়ে ফেসবুক হত আমি সেদিনই চাঁদগাজীকে ব্লকলিস্টে ঢুকিয়ে দিতাম।
অচিরেই টের পেলাম চাঁদগাজী শুধু আমার পোস্টে চাঁছাছোলা মন্তব্য করেন তা নয়, এমনকি সিনিয়র ব্লগারদের বেলায়ও তিনি একই রকম। সে যাক, আমার বড় দুর্বলতা হল কাউকে বন্ধু মনে করলে তাঁকে আর শত্রু বানাতে পারি না। আর কাউকে একবার শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে ফেললে সহজে তাকে মেনে নিতে পারি না। চাঁদগাজী শত্রু না হলেও তাঁকে শত্রুভাবাপন্ন মনে করতাম। কখনো যদি কেউ চাঁদগাজীকে বাঁশ দিয়ে মন্তব্য দিতো আমি বেশ মজা পেতাম, বুঝো ঠেলা। আমার ভুল ধরে। বিরদ্ধ মন্তব্য করলে কেমন লাগে তুমিও টের পাও!
এর মাঝে সেফ হলাম। সেফ হবার খুশিতে যথারীতি বড় এক পোস্ট দিয়ে ফেললাম। সেখানে চাঁদগাজী আমাকে স্বাগত জানিয়ে মন্তব্য করলেন। যাক, কাঠখোট্টা হলেও লোকটার সৌজন্যতাবোধ আছে দেখছি। ধীরে ধীরে ব্লগের সাথে পরিচিত হচ্ছি। এর মাঝে টের পেলাম চাঁদগাজী একজন বয়স্ক লোক। তারপর আরও তথ্য পেলাম, তিনি মুক্তিযোদ্ধা! ও গড, তাহলে এই লোক তো আমার বাবার চেয়েও বড়!
সময় যেতে থাকে, চাঁদগাজীর প্রতি আমার প্রিজুডিস হালকা হতে থাকে। এক ব্লগারকে নিয়ে না ভাবলেও আমার দিন চলবে।
আমি পোস্ট দিয়ে যাচ্ছি, আর তাতে চাঁদগাজী যথারীতি হুল ফুটিয়ে দেন। ব্যপার না, এই হুলের বিষ এখন আর আগের মত অসহ্য লাগে না, সয়ে গেছে। যথারীতি তাঁর পোস্টে অন্যদের ফোটানো হুল দেখে সান্ত্বনা পেতাম।
চাঁদগাজীর রাজনৈতিক পোস্টে আমি কখনো যাই না। রাজনীতি বড় নোংরা জায়গা, সেখানে পা ফেলে নিজেও নোংরা হতে চাই না। কিন্তু ভাবতাম এই চাঁদগাজী কোন কোরামের লোক? তাঁকে কখনো মনে হয় আওয়ামী লীগ, আবার কখনো মনে হত নন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের লোকেরা এই সরকারের ভুল খুঁজে পায়না। কিন্তু চাঁদগাজী সবসময় সরকারের দোষত্রুটি নিয়ে উচ্চকন্ঠ! অদ্ভুত ক্যারেক্টার! একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, তিনি উত্তর দিলেন- ‘আমি নিজেকে সোশ্যালিজমে বিশ্বাসী মনে করি।’ সেদিন বুঝলাম, ঘটনা তাহলে এই! আমার বাবাও মাঝে মাঝে নিজেকে সোশ্যালিজমে বিশ্বাসী লোক বলে মনে করেন। চাঁদগাজীর সাথে বাবার একটা মিল খুঁজে পেলাম। এই একটা কারণে চাঁদগাজীর প্রতি আমার মনে একটা সফট কর্ণার তৈরি হল। ভেবে দেখলাম, ব্লগার চাঁদগাজীকে মাত্র একটি কারণে আমি অপছন্দ করি, তা হল তিনি কড়া কড়া মন্তব্য করেন। কিন্তু তাঁকে ভালো লাগার মত আরও দশটি কারণ তো রয়েছে। কাজেই শুধু এক ছুতায় আমি উনাকে ঘৃণা করতে পারি না।
এরপর আগের মত তাঁর কথায় চুলকানি বোধ করতাম না। আগে তাঁকে কেউ কটাক্ষ করে কথা বললে ভালো লাগতো। এখন ভালো লাগে না। এতদিন যেই লোকের মাঝে শুধু গোঁয়ার গোবিন্দকে খুঁজে পেতাম, এখন তাঁর মাঝে আমি অনেক পজেটিভ বৈশিষ্ট্য পেতে থাকি। চাঁদগাজীর সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য আমার ভালো লাগে, তা হল- তাঁকে যতভাবেই পচানোর চেষ্টা করা হোক, তিনি কখনো রেগে গিয়ে বকাবকি করেন না (যা অনেক সিনিয়র ব্লগার করেন)।
কিন্তু অ-নে-ক ব্লগার চাঁদগাজীকে পছন্দ করেন না। কেন যে সবাই তাঁর উপরে বিরক্ত এটা বুঝতে বেশি চালাক হতে হয় না। যে কারণে চাঁদগাজীকে আমার কাছে অসহ্য লাগতো ঠিক সেকারণেই উনার উপর সবাই বিরক্ত। চাঁদগাজীর স্পষ্ট মন্তব্য কেউ পছন্দ করেন না। বিষয়টা উনিও বোঝেন-
তবুও কেন তিনি এরকম ঠোঁটকাটা লোক? খুব সহজ, তিনি একজন স্পষ্টবাদী। কারো লেখায় ভুলচুক পেলে তিনি স্বজনপ্রীতি না দেখিয়ে সরাসরি বলে দেন। এটা কি দোষ হতে পারে? এই মহান গুণ যার আছে, তার দুনিয়াভরা শত্রু থাকে। কি আশ্চর্য! কেউ যদি উপরে বন্ধুত্বের ভাব রেখে ভেতরে ভেতরে আমাদের মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে তাকে আমরা শুধু বাহ্যিক আচরণের কারণেই বন্ধু বানিয়ে রাখি। আর কেউ যদি মুখের উপর আমার ভুল ধরে দেয় তাকে আমি মনে করি কপট লোক।
চাঁদগাজী কখনো মিষ্টিমধুর পামপট্টি জাতীয় মন্তব্য করেন না। একে তো ঋজু কথা বলেন। তার উপরে মন্তব্যে তিনি কখনো ইমোটিকন ব্যবহার করেন না। একটা ছোট্ট ইমোটিকন কত ভাব প্রকাশ করতে পারে। ইমোটিকন দেখে আমরা বুঝে নিই ওপাশের ব্লগার হাসার অথবা কান্নার ভাব প্রকাশ করছে। আমাদের অভ্যাস এমন খারাপ হয়ে গেছে, ইমোটিকন ছাড়া কোন মন্তব্যকে আমরা পরিপূর্ণ মনে করি না। চাঁদগাজী এই ব্যপারে ফ্লপ। উনি হাসি কান্না সবই মন্তব্যে প্রকাশ করে দেন। কোন পোস্ট ভালো লাগলে সেখানেও পাম দেবার মত কথা বলেন না, খুব সংক্ষেপে বলে দেন ভালো লেগেছে।
ইমোবিহীন মন্তব্য হওয়াতে তাঁর সহজ সরল মন্তব্যকে আরও কাঠখোট্টা মনে হয়।
চাঁদগাজী একজন মুক্তিযোদ্ধা। জীবন বাজি রেখে একাত্তরে যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন সেই দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা পাননি। এখন শেষ বয়সে এসে তিনি যদি ক্ষুব্ধ হন, তাঁকে কি দোষ দেয়া যায়?
আসলে সমস্যা চাঁদগাজীর নয়। সমস্যাটা আমাদের। আমরাই চাঁদগাজীকে বুঝতে ভুল করছি।
চাঁদগাজীকে সবাই মিলে সালাম করতে থাকুন এই কথা আমি বলব না। কিন্তু তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাবেন কেন? তিনি আপনার মন্তব্যে অপ্রিয় কমেন্ট করেন? চাঁদগাজী সবার পোস্ট পড়েন না।
তিনি আপনার পোস্টে মন্তব্য করেছেন মানে আপনার পোস্ট পড়েছেন, পড়ার যোগ্য মনে করেছেন। সেখানে আপনাকে যদি সংশোধনী দেয় আপনি রেগে যান। সমস্যাটা কার? আপনার নাকি চাঁদগাজীর?
আমার আরেকজন শ্রদ্ধ্যেয় সিনিয়র ব্লগার কাওসার চৌধুরী চাঁদগাজীকে নিয়ে একদিন বেশ ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। আমার খুব খারাপ লেগেছিল। কাওসার ভাইয়াকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করতাম। আমি ব্লগিং শিখেছি উনার মত অল্প কয়েকজনের উৎসাহ পেয়ে। তিনি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যেগুলো উনার পার্সোনালিটির সাথে যায় না। উনাদের বাক বিতণ্ডা শুরু হয়েছে শুধুমাত্র ইগো প্রবলেমের কারণে। চাঁদগাজীর মন্তব্যকে কাওসার ভাইয়া সহজভাবে গ্রহণ করলে এতকিছু হত না। আমি আশা করব কাওসার ভাইয়া তাঁর ইগোকে দূরে ঠেলে চাঁদগাজীর সাথে আগের মত স্বাভাবিক ব্লগিয় সম্পর্ক বজায় রাখবেন। যদি কাওসার ভাইয়া নিজের অহংবোধ দূরে রাখতে পারেন, আবার যদি চাঁদগাজী এবং তাঁকে স্বাভাবিকভাবে দেখি তাহলে বুঝব কাওসার ভাইয়া আমাদের কাছে অনেক সম্মানের যোগ্য।
শুধু কাওসার চৌধুরীর জন্য আমি এতো বড় পোস্ট দিচ্ছি না। সম্প্রতি মডারেটরের একটি পোস্টে দেখলাম সবাই মিলে চাঁদগাজীর ‘উসকানিমূলক’ মন্তব্যের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার মতামত দিলেন। সবার অভিযোগ, চাঁদগাজী খোঁচাখুঁচি করেন। অপ্রিয় মন্তব্য যদি খোঁচাখুঁচি হয়, তাহলে তিনি তো তা করবেনই। সবাই আপনার লেখা পড়ে খালি প্রশংসা করবে- এই দুরাশা কেন করছেন জনাব? আমি, আপনি, আমরা কেউই রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল নই, আমাদের লেখায় ভুল থাকবেই। এই ভুল শুধরে যদি নিতে পারেন তবে ব্লগার হিসেবে আপনি পারফেক্ট। চাঁদগাজী আপনাকে সেই ভুল শুধরে নিতেই সাহায্য করছে।
আমি আবারো বলছি, সমস্যা চাঁদগাজীর নয়, সমস্যাটা আমাদেরই। আমরা কেবল ব্লগে মিষ্টি মধুর প্রশংসাবাণী খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাই কেউ গঠনমূলক সমালোচনা করলেও তা আমাদের সহ্য হয় না।
আমি ব্লগে একদম নতুন। একজন সিনিয়র ব্লগারকে সমর্থন করতে গিয়ে অ-নে-ক লোকের শত্রু হবার আমার ইচ্ছে নেই। যদি অন্য কেউ এই কথাগুলো বলে ফেলতেন আমি এই পোস্ট দিতাম না। কিন্তু সবাইকে নীরব থাকতে দেখে আমি মুখ খুলতে বাধ্য হলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:১০