আমি ছিলাম বুয়েটের মেইন ওয়েটিং লিস্টে, আর ও ছিলো বুয়েটের আর্কিটেকচারের ওয়েটিং লিস্টে। বুয়েটে শেষ পর্যন্ত ওয়েটিং লিস্টে কতদূর টানবে এই হিসাব করতে গিয়েই ওর সাথে ফেসবুকে আমার বন্ধুত্ব।
এরপর আরেক ভার্সিটির ইলেকট্রিকাল ডিপার্টমেন্টে থিতু হলাম দুইজনই। গোঁফওয়ালা ফর্সা একটা মেয়ে, ওকে প্রথম দেখে এটাই আমার মাথায় আসে সবার আগে।
তারপর অনেকগুলো ক্যাফের পরোটা, অনেকগুলো হলিক্রস-নটরডেম যুদ্ধ, অনেকগুলো ইসিবি ক্যান্টিন, আর ক্লাসশেষে মিরপুর ডিওএইচএসের অনেক-অনেক রোদবৃষ্টি।।
প্রথম দেখা গোঁফওয়ালা সেই মেয়েটা তার নাকের নিচের ঐ কিঞ্চিৎ কেশ-নির্মূল অভিযান চালায় তারও দুই বছর পর। সেটা অবশ্য কখনও চোখে লাগে নি আমার আর। সর্বনাশ যা হওয়ার ততদিনে হয়ে গেছে।
আমি ছিলাম ভ্যাগাবন্ড। আর আমার চারপাশের সার্কিট-পড়ুয়া আঁতেলগোষ্ঠী ক্লাসে কিংবা পরীক্ষার খাতায় পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ফেলতো!!
কিন্তু সবার থেকে ও একটু আলাদা ছিল। কিছুটা উন্মাদ, কিছুটা ভাবুক... আর হয়তো, কিছুটা আমার মত। দুনিয়ার সব আজগুবি বিষয় নিয়ে এই মেয়েটার সাথেই গল্প করা যেত।
আমি আগে পূজায় ঘুরতে বের হতাম না।
পূজা-পার্বণে আলাদা করে বিশেষ কিছু মনে হত না কখনই। তবে ভার্সিটিতে ঢোকার পর শার্টের নিচে এতদিন যত্ন করে ঢেকে রাখা পাখাগুলোয় আস্তে আস্তে প্রাণসঞ্চার হলো। এলোমেলো ঘুরাঘুরির পাশাপাশি পূজার সময় নিয়ম করে রামকৃষ্ণ মিশন কিংবা ঢাকেশ্বরীতে ঘোরা শুরু করলাম।
ধর্ম নিয়ে ওর মধ্যেও সংস্কার ছিল না কোনও। আমাকে সুন্দর করে ও-ই প্রথম বোঝায় শ্রী-কৃষ্ণের অবতারতত্ত্ব। আর এইতো, বছরখানেক আগে হরতালের সময় বাসে উঠে ওকে যানবাহনের দোয়াটা আমারই শেখানো।
দেখিস, এটা পড়লে তোর কিচ্ছু হবে না।
আমরা স্রষ্টা বিশ্বাস করতাম।
আর... একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করতাম, অনেক।
ফার্স্ট ইয়ারে ভার্সিটির পাশের একটা ছোট্ট মণ্ডপে ওর সাথে পূজা দেখি। এরপর বনানীতে। তারপর জগন্নাথ হলে; গত স্বরস্বতী পূজায়।
সেবার বেদীর উপর শাড়ি পরে অমর্ত্যের দেবীকে প্রণাম করছিলো ও। আমি ওর বামপাশে দাঁড়ানো। সত্যি বলছি, ঐটা এখন পর্যন্ত আমার দেখা সেরা দৃশ্যের মধ্যে একটা।
ক্যাবলাকান্তের মত আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম এক মর্ত্যের দেবীর দিকে।
আমার খুব ইচ্ছা করত, এই পাগলাটে ধরণের মেয়েটাকে ওর বিয়ের আগ পর্যন্ত খুব যত্ন করে দেখেশুনে আগলে রাখবো। খুব আবেগ নিয়ে যুগল-বন্দীদের মত হাত ধরার কোনও ইচ্ছা আমার কখনই ছিল না। অন্তত টং-এর চা খেয়ে ফেরার পথে হোঁচট খেলে তো ওর হাতটা ধরা যেত, দশ লক্ষ মাইক্রো সেকেন্ডের জন্য।
ঐটুকুই তো অনেক।
পূজার সময় আমি এখনও বের হই।
কারণ আমাকে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে হয়; বাসায় ফিরে নিজের গল্পটা লেখার জন্য হলেও। গত দুর্গা পূজায়ও একা একা ঘুরলাম কয়েকটা মণ্ডপে। বেদীর উপর উঠলাম কোথায় যেন। দশমীর রঙ-উৎসব চলছে তখন। হুট করে শাড়ি পরা এক মহিলা কপালে লাল এঁকে দিলো খুব যত্ন করে।
খুব ভালো লাগলো হঠাৎ করে কেন যেন।
মেডিকেল টার্ম অনুযায়ী, ব্রেইনের ফ্রন্টাল লোব অর্থাৎ কপালের দিকেই মানুষের আবেগ-অনুভূতির সৃষ্টি। আর এই কারণেই যুগ যুগ ধরে বোধ হয় কপালের স্পর্শকে ধরে নেয়া হয় নির্ভরতা। আমি ধর্মবোদ্ধা নই। তবুও ভাবতে ভালো লাগে; এজন্যই হয়তো কপালে সিঁদুর দেয়া হয় হিন্দুধর্মে।
ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে জিআরই দিয়ে বাইরে চলে যাবি তুই, তাইনা?? যাওয়ার আগে আমার কপালে খুব যত্ন করে একবার লাল রঙ দিয়ে যাস তো দশমীর দিনের ঐ অচেনা মহিলাটার মতন।
জানিস তুই, আমার চুল পড়ে যাচ্ছে??
তোর জন্য আমার কপালে বিরাট ক্যানভাস নিয়ে বসে আছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:০৭