somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডায়েরীর পাতা থেকেঃ যুদ্ধশিশু এরিনা ও তার বীরাঙ্গনা মায়ের যন্ত্রণা গাঁথা

১৯ শে অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এপ্রিল ১৭, ১৯৯১

আমি যেদিন প্রথম জানলাম আমার খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যু হতে যাচ্ছে, সেদিন আমার একবারও কান্না আসেনি।আমি আসলে হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম এই জীবনের প্রতি।প্রতিদিন সকালে উঠে আমি নিজের দিকে তাকাতাম আর মনে হতো, ছি! এই আমার পরিচয়।তবুও বেচে থাকতে হয় বলে, আমি এরিনা একজন বাঙ্গালী আমেরিকান এই ব্যস্ত নিউইয়র্ক শহরে শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে বেচে আছি।আমার ফস্টার গার্জিয়ান রোমা একজন ইতালীয়ান সম্ভ্রান্ত বংশের নারী যে জীবনে কখনো বিয়ে করেনি।কেন যেন তার সাথে আমার কখনো সেভাবে কথা বলা হয়না সেই ছোট্ট বেলা থেকে।তবে অত্যন্ত মহৎ যে কাজটা সে করেছে, তা হলো আমাকে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি সে শিখিয়েছে।আমাকে একজন আদর্শ নারী হিসেবে বড় হয়ে উঠার শিক্ষা দিয়েছে।আরেকটি মহৎ কাজ সে করেছিলো ১৯৯০ সালের ২৪শে ডিসেম্বর।আমাকে রাত্রি ১১টার কিছু পর তার রুমে ডেকে নিয়ে সে বলেছিলো,

“এরিনা তুমি জানো তুমি বাংলাদেশী একটি মেয়ে।আমি তোমাকে শুধুই দত্তক নিয়েছিলাম।তোমাকে আমি এতদিন বলেছিলাম তোমার বাবা মা কেউ বেচে ছিলোনা তাই তোমাকে আমি একটি এতিমখানা থেকে তুলে নিয়ে এসেছি।কিন্তু আসলে ব্যাপারটি সত্যি নয়।বুঝতে পেরেছো?”
আমি তাকে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলাম, “সত্যিটা কি বলবে মা?”

“এরিনা আমি খুব দুঃখিত তোমাকে সত্যি তথ্যটা জানাতে হচ্ছে বলে।তুমি একজন যুদ্ধশিশু।৭১ সালে তোমাদের দেশে পাকিস্তানীরা যে অত্যাচার চালিয়েছিলো তারই ফসল তুমি।তোমার মাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম।ইউএসএ থেকে যে মেডিকেল টিম ৭২ সালে বাংলাদেশে গিয়েছিলো তার একজন সদস্য ছিলাম আমি।তোমার মা তোমাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালে আমি তোমাকে এই দেশে নিয়ে আসি।তুমি তো জানো আমি অনেক একাকী।তাই কোন প্রতিষ্ঠানে না দিয়ে আমি নিজেই তোমাকে দত্তক নেই।”

মা যখন আমাকে এই কথাগুলো বলছিলো আমি তখন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে।আমার চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো।মা আমার দিকে সমবেদনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বললো, “এরিনা তুমি কি তোমার মায়ের নাম, ঠিকানা জানতে চাও?”

আমি নিজেকে সামলিয়ে বললাম “হ্যা”।"

এরিনা টিভির দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার মা অসাধারণ রুপবতী একজন নারী ছিলেন।কিন্তু তার পরিবার ছিলো অত্যন্ত দরিদ্র।তোমার মায়ের নাম ছিলো ইরিনা।তুমি কি বুঝতে পেরেছো কেন তোমার নাম আমি এরিনা রেখেছি?”

আমি মাথা নাড়লাম।মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “শেষবার যখন তোমার জন্মদাত্রী মায়ের সাথে আমার কথা হয় তখন সে সুইডিশ একটি ফার্মাসিকিউটিক্যাল ফার্মে চাকরী করতো।তাকে তোমাদের দেশের মানুষ আসলে বাচতে দিচ্ছিলোনা।তাই আমি নিজেই তাকে সুইডেনে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।সে আমার অত্যন্ত ভালো বান্ধবী ছিলো।তবে তার সাথে আমার প্রায় অনেকবছর হলো যোগযোগ নেই।আমি চেষ্টা করবো তার ঠিকানা তোমাকে যোগাযোগ করে দিতে”।

আমি তখন কান্নার দমকে বারবার কেপে উঠেছিলাম।মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।আমি তাকে শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সে কি কখনো আমার কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো?”
মা আমাকে বললো, "না"

আজ আর লিখতে ইচ্ছা করছেনা।

মে ২১, ১৯৯১

পালক মা আমাকে আমার আসল মায়ের ঠিকানা যোগাড় করে দিয়েছে।আমি কাল সুইডেন যাবো, আমার জন্মদাত্রীর সাথে দেখা করবো।আমি জানিনা সে আমাকে দেখে কি বলবে?তবে আমার পালক মাকে আমি বলে এসেছি যেন আমার জন্মদাত্রী না জানতে পারে আমি তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।

আমি দিন দিন আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছি।মা অবশ্য জানেনা আমার শরীরে যে লিউকেমিয়া নামে একটি রোগ বাসা বেধেছে।আমি শুধু শুধু তার ঝঞ্ঝাটহীন জীবনে ঝামেলা করতে চাইনা।তবুও মাঝে মাঝে সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তোমাকে কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছে।তুমি চাইলে আমাকে বলতে পারো তোমার কি হয়েছে?"

আমি ওকে জানাই, "আমি অনেক ভালো আছি মা।"

আমি অবাক হই যখন ভাবি আমার জীবনের পরিবর্তনগুলোর কথা।মাত্র চার মাসের ব্যবধানে আমি জানতে পারলাম আমি একটি অবৈধ জন্মগ্রহণকারী মেয়ে, আমি জানতে পারলাম এই অসহ্য পৃথিবীতে আমার আয়ু আর মাত্র কিছু দিন।আমি কি অপরাধ করেছি জীবনে জানিনা।আমার এই ১৮ বছরের জীবনে কারো মনে কষ্ট দিয়েছি বলে মনে পড়েনা।আমার হাইস্কুলের যত বান্ধবী আছে তারা সবাই নিজেদের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত।যা খুশি করে বেড়ায়, বয়ফ্রেন্ড নিয়ে উইকেন্ডে ফরেস্ট ক্যাম্পিং, নায়াগ্রা ফলস ঘুরে বেড়ানো সবই তারা করে।কিন্তু আমি কখনো কেন যেন কাউকে আমার বয়ফ্রেন্ড বানাতে পারিনি।এমন না যে কাউকে আমার পছন্দ হয়নি, বা কেউ আমাকে পছন্দ করেনি।আমার একটি ছেলেকে অনেক ভালো লেগেছিলো।ওর নাম ছিলো ফয়সাল।বাংলাদেশী একটু মোটাসোটা একটা ছেলে।কিন্তু তাকে কখনো জানানোর সুযোগ হয়নি।হয়তো ইচ্ছাও করেনি।

আমি একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমি আমার মারা যাওয়ার আগেই আত্নহত্যা করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমি জানি আমার মৃত্যুতে কারো কোন যায় আসবেনা।

মে ২৪, ১৯৯১

আমি কিছুক্ষণ আগে ক্লারার সাথে ফোনে কথা বললাম।সে আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী এবং সেই একমাত্র মানুষ যাকে আমি আমার সবকিছু বলি।ক্লারা ফোন করে কান্নাকাটি করলো অনেকক্ষণ।ফোন রাখার আগে আমাকে বললো, "ওয়াই আর ইউ ডুইং দিজ টু ইউরসেলফ?আই কান্ট বিয়ার দিজ এনিমোর! আই এম নট গোয়িং টু টক উইথ ইউ এনিমোর।নেভার এভার এগেইন।"

আমার এই আমেরিকান বান্ধবীর যে ভালোবাসা নিয়ে আমার সাথে কথা বলে আমি জানিনা মৃত্যুর পর এই ভালোবাসার কতটুকু আমি সাথে নিয়ে যেতে পারবো।আজকে আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে খেয়াল করলাম আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।আমি মাত্র ১৮ বছর বয়সে এত বড় একটি রোগ শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি, অথচ কাউকে একবারও বলিনি।কারো কাধে মাথা দিয়ে একবারও কাদিনি।এই আমি আজ একা একা ভীন দেশে আমার জন্মদাত্রীর সাথে দেখা করতে এসেছি।
তার সাথে আমার দেখা হয়েছে।কথাও হয়েছে।কিন্তু সে জানেনা আমি কে।আমার জন্মদাত্রী ২৬,৬৭০ বর্গকি.মি. এর নড়বট্টেন স্টেটের ছোট গ্রাম গ্যামেলস্টেডে একটি ওষুধের দোকানে চাকরী করে।তাকে যখন আমি প্রথম দেখি তখন এমনিতেই চোখ দিয়ে একগাদা পানি বের হয়ে গিয়েছিলো।কি অদ্ভুত সুন্দর একটা নারী।কত সুন্দর তার আকাবাকা চোখগুলো।আমি যখন তার পাশে গিয়ে দাড়াই সে আমার দিকে একবারও তাকায়নি।আমি মাথা ব্যথার জন্য কিছু ওষুধ তার কাছে চাইলে সে আমার দিকে না তাকিয়েই সেগুলো আরেকজনকে দেয়ার নির্দেশ দেয়।শুধুমাত্র যখন আমার কন্ঠস্বর শুনলো তাকে একটু কনফিউজড মনে হয়েছিলো।
এখন লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে।বোধহয় বমি করবো।ডাইরী তোমাকে শুভরাত্রি।

৩১ মে ১৯৯১

কালকে বেশ কিছু অসাধারণ ব্যাপার আমার সাথে ঘটেছে।আমি কাল সাহস করে আমার জন্মদাত্রীর সামনে যেয়ে দাড়াই।না তার ওষুধের দোকানে আমি যায়নি।আমি তার ছোট্ট বাসায় সন্ধ্যাকালে যখন পৌছাই, তখন রক্তস্নাত সূর্য চারপাশ কমলা রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দিয়ে রেখেছিলো।দরজার কড়া নাড়ার পর সেই এসে দরজা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।আমি তাকে শান্ত স্বরে বাংলায় বললাম, "আমি কি ভেতরে আসতে পারি?"

আমার জন্মদাত্রী আমাকে একটা কথাও জিজ্ঞেস করলোনা।শুধু দরজার সামনে থেকে সরে এসে আমাকে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলো।আমার মনে হলো, যেন সে সব বুঝে ফেলেছে।আমি তাকে বেশ অনেকক্ষণ নীরবতার পর নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি জানেন তো আমি কে?"

উনি কিছু বললেন না।শুধু ধপ করে বিছানায় পড়ে গেলেন।
আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকলাম।আমি কি জানতাম যে আমার হৃদয়ে এত কষ্ট বাসা বেধে ছিলো?আমার মনে হচ্ছিলো আজ অশ্রুজলে সবগুলো কষ্ট বের করে দিবো, নাহলে যে আমার মুক্তি নেই।আমি তাকে দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি কেন একবারও আমার কথা জানতে চাননি?এত ঘৃণা কেন আমার প্রতি আপনার?এত ঘৃণা কেন?"

আমার দিকে তাকিয়ে এবার সে কেদে দিলো।আমাকে বললো, "তুমি কেন আমার কাছে এসেছো?তুমি তো আমার ভালোবাসার চিহ্ন নও, তোমাকে দেখে আমার শুধু অসহ্য লজ্জা, নির্মমতা আর পাশবিকতার কথা মনে পড়ে।আমি তোমাকে ভালোবাসিনা, তুমি সামনে থেকে চলে যাও।আর কখনো আমার কাছে আসবেনা।তুমি আমার ভালোবাসার কেউ না।
আমার বুকের মধ্যের কষ্টগুলো দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো।কিন্তু আমার এই ১৮ বছরের ছোট্ট জীবনে আমি কখনো কাউকে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারিনি, কারো কাছে ভালোবাসার দাবী জানাতে পারিনি।আজও পারলাম না।আমি আমার কান্নার স্রোতধারা থামাতে না পেরে সেই বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম।কেউ কি বুঝবে তখন আমি কতটা অসহায় বোধ করছিলাম?কতটা ঘৃণা নিজের প্রতি আমার হচ্ছিলো?কেউ না বুঝলেই ভালো।কারণ ওটা যে সহ্য করার মত নয়।

জুন ৩ ১৯৯১

গতকাল আমার জীবনে আবার চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটেছে।সকালবেলা আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার পালক মাতা আমার ভাড়া করা হোটেলের ছোট্ট রুমে আমার পাশে বসে কাদছে।আমি তাকে দেখে নিজেও কেদে দিলাম।আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "মা তুমি কি জানো আমি মরে যাচ্ছি?আমি সর‌্যি মা তোমাকে আগে জানাইনি।"

মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "তোমার মেডিকেল রিপোর্ট আমার হাতে না আসলে কখনো জানতাম না এরিনা।তুমি আমাকে না জানিয়ে ঠিক করোনি।"

আমি তাকে বললাম, "আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।"

এরিনা আমাকে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, "মামণি তুমি জানো আমি যখন তোমার বয়সী তখন চারদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা আর পাশবিকতা ছড়িয়ে পড়েছে।আমি তখন এক আমেরিকান সৈনিকের প্রেমে পড়েছিলাম।আমরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত একসাথে ভালোবাসা বন্টন করেছি।একসময় যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় তখন সে আমার থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বলেছিল মাসখানেকের মধ্যে ফিরে আসবে।কিন্তু সে আসেনি।আমার ভালোবাসা তার প্রতি তবুও আজো একটুও কমেনি।একটুও না।ওর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে যখন আমার একটি মেয়ে হয়েছিলো, সে ছিলো দেখতে ঠিক তোমার মত।একেবারে তোমার মত চোখ, তোমার মত নাক।কিন্তু বিধাতা তাকে জন্মের ৭২ ঘন্টা পর তার বাগানে নিয়ে যান।আমি একা হয়ে পড়েছিলাম, ভীষণ একা।তোমাকে যখন আমি প্রথম দেখি, আমার প্রচন্ড লোভ হয়েছিলো তোমাকে কাছে রাখার জন্য।অনেক।মামণি তুমি কি জানো আমি তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি?আফসোস আমি তোমাকে জন্ম দেইনি।"

আমি কোন কথা না বলে আমার পালক মায়ের বুকে নিজেকে লুকিয়ে রাখলাম।মা ইতালীয় ভাষায় কি বললো, আমি বুঝতে পারছিলাম না।শুধু বুঝলাম সে বলছে "আমার এত্ত ছোট্ট মামণিকে ছাড়া আমি কি করে বাচবো?"

আমি খুব অবাক হয়েছি গতকাল।আমি মারা যাচ্ছি বলেই কি আমার পালক মা তার অসীম ভালোবাসা আমাকে জানান দিলো?আমি আগে কেন কখনো বুঝিনি, সে আমাকে এত ভালোবাসে?

৯ জুন ১৯৯১

সকালবেলা আমার পালক মা আমাকে জানালো আজ আমার জন্মদাত্রী আমার সাথে দেখা করতে আসবে।আমি হতবাক হয়ে গেলাম এবং ভাবতে লাগলাম, তাকে কি আমার আর কিছু বলার বা বোঝানোর বাকি রয়ে গেছে?আর সে নিজে থেকে কেন আবার কষ্ট পেতে আমার সাথে দেখা করতে আসবে?

১০ জুন ১৯৯১

গতকাল আমার আসল মা আমার সাথে যখন দেখা করতে আসলো আমি তখন বমি করে অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় ছিলাম।সে আমার বিছানায় আমার পাশে বসে আমার কপালে হাত রাখলো। আমি চোখ খোলার শক্তিটুকুও পাচ্ছিলাম না।আমার মার দুফোটা গরম অশ্রু হয়তো আমার কপালে এসে পড়লো।আমি কেপে কেপে উঠলাম।মা আমাকে বললো, "আমার সোনা তুই আমাকে মাফ করে দিস।আমি তোকে সত্যি কথা বলি শোন।তুই যখন জন্ম নিলি, আমি জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম যখন তোর মুখ দেখলাম তোকে তখন অনেক ভালোবেসে ফেলছিলাম।আমি ভেবেছিলাম তোকে অনেক ঘৃণা করবো আমি।কিন্তু এত্ত ছোট একটা শিশু তাও আমার রক্ত মাংশের গড়া, আমি তাকে কি করে ঘৃণা করি? আমার সোনা তুই কি বুঝবি একজন মা তার সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে কোন অবস্থায় আরেকজনের হাতে তুলে দেয়?আমার অনেক কষ্ট হয়েছিলোরে।কিন্তু আমার কিছু করার ছিলোনা মা।আমি জানতাম তোকে আগলে রাখা আমার মত একজন সাধারণ বাঙ্গালী নারীর জন্য সম্ভব না।কেউ তোকে বাচতে দিবেনা।
জানিস মা যখন যুদ্ধের সময় ওই পিশাচ গুলো প্রতিরাতে আমার আত্নাকে আঘাত দিয়ে মেরে ফেলতো তখনো এত কষ্ট হয়নি যতটা হয়েছিলো তোকে আরেকজনের হাতে তুলে দিতে।মা আমি তোকে প্রতিদিন ভোলার চেষ্টা করেছি। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে তোর ওই জন্মের পর দেখা আমার মত চোখগুলো কত কত আমার বুকে আঘাত করতো তুই বুঝবিনা।মা আমাকে ক্ষমা কর।আমি সাহসী ছিলাম না।আজকে আমাকে খোদা শাস্তি দিচ্ছে দেখ।আজ যখন তোকে কাছে পেলাম তখন তুই আমাকে রেখে চলে যাচ্ছিস।আমি কি পাপ করেছি জীবনে যে আমার সাথে ..."

আমার মা অজ্ঞান হয়ে গেলো একটু পর।আমি আমার দু পাশে আমার আপন মা আরেক পাশে আমার আরেক আপন মা যে আমাকে বড় করেছে তাদেরকে একসাথে দেখে ভাবতে লাগলাম, কে আমায় বেশি ভালোবাসে?তারপর ভাবলাম, আমি কত বোকা!আমার তো ভাবা উচিত আমি কত ভাগ্যবান যে আমার চলে যাওয়ার সময় দু দুটো মা একসাথে পেয়েছি।বিধাতা তোমাকে ধন্যবাদ।

৮ জুলাই ১৯৯১

আমি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছি।হয়তো আজকের পর আমি আর লিখতে পারবোনা।এখন আমি নিউইয়র্কে আমার দুই মায়ের একগাদা ভালোবাসা নিয়ে সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকি।গভীর রাতে আমি অনেক কষ্ট হলেও উঠে বসে জানালার কাছে যাই।আমি আকাশের তারা গুনি।আমি জ্বলজ্বলে তারাগুলো দিয়ে আমার সুন্দর নামটি লিখার চেষ্টা করি।একটু পর আবার ঘুমাতে চলে যাই।ঘুমুবার আগে আমার পাশে বসে থাকা বা শুয়ে থাকা মায়েদের দিকে তাকিয়ে বলি, "মা তোমাদের অনেক ভালোবাসি।"

ডায়েরীতে আর কোন লেখা পাওয়া যায়নি।

********************************************************************
আমি বলতে চাই- কোন গল্প, সাহিত্য অথবা উপন্যাস দিয়ে ৭১ এর সেই ভাগ্যহারা নারীদের অথবা সেই সময়ের ভাগ্যহারা যুদ্ধশিশুদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।তবুও বারবার ইচ্ছা করে তাদের কষ্টগুলো একটু করে ছুয়ে দেখতে।আমার এই লিখা ওই ছুঁয়ে দেখারই ফসল হয়তো।ক্ষমা চাই, আমার লিখার অক্ষমতা কাউকে পীড়া দিয়ে থাকলে।


সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ২:১০
৪৩টি মন্তব্য ৩৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×