somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেই সময়, সেই একজন

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৩৬৩ বাংলা সনের ১৩ই পৌষের গল্প বলি।আমার বাবা সেদিন আমাকে এক আনার চিনির গুড়া কিনে দিয়েছিলেন।এখনকার সময়ে আপনারা এই সুস্বাদু খাবারটাকে বাতাসা বলে থাকেন বলে বোধ করি।আমি সেই চিনিগুড়া সারাদিন হাতে ধরে থাকি।মা জিজ্ঞেস করতেন, “বাজান খাস না কেন?”
আমি বলি, “খামুনা”।
মা মাথায় বাড়ি দিয়ে বলে, “পাগল ছেলে।তোরে তো পিপড়ায় ধরবো”।
আমি ফিক করে হেসে বলি, “পিপড়া খায়া ফালামু”।
মা আমাকে আদর করে কোলে বসায় ভাত রাধে।আমার বয়স তখন ৬ বছর।বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি।আমরা প্রায়ই একটা প্রবাদ ব্যবহার করি, দুধে ভাতে মানুষ করা।আমার বাবা মা আমাকে দুধে ভাতে মানুষ করেছেন।আমার একটা দিনও মনে পড়েনা যেদিন বাবা আমাকে গভীর রাতে কোলে নিয়ে ঠাকুরমার ঝুলির ভয়ংকর সব মজার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াননি।আর মা তো আমাকে কোথাও বের হওয়ার আগেই বিশাল বড় একটা কাজল মাথায় একে দেবেন অবশ্যই।কার দৃষ্টি থেকে বাচাতে চাইতেন আজও বুঝিনা।

আমার বাবা একজন কৃষক ছিলেন।তবে তার বেশ অনেক জমিজমা ছিলো ।অনেক জমি বর্গা দিয়ে রেখেছিলেন।তবে বাবা অনেক বোকা ছিলেন তো,তাই হেমন্তের শুভক্ষণে বাবা অনেক গরীব বর্গাচাষী থেকে ধান বুঝে নিতেন না।এরই মধ্যে একজন ছিলেন জমির চাচা।আমি জমির চাচার কাছে প্রায় সময় যেয়ে বসে থাকতাম।উনি মজার মজার ছড়া বলতেন।আমি শুনতাম।যখন তার বর্গা জমিতে সোনালী ধানে ছেয়ে যেত উনি তখন ভাটিয়ালীর সুর তুলতেন।আমি বিকেলের স্নিগ্ধ হাওয়ায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতাম।আমাকে মাঝে মাঝে উনি কাধের উপর নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।আমাকে বলতেন, “চল বাজান আইজ তোমারে লই হাট যাইয়াম।মিষ্টি খাইবা?”
আমি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে মিষ্টি খাওয়ার আবদার করতাম।মা বলতেন, “এত মিষ্টি খেলে তো পেটে পোকা হবে”।আমি বলতাম, “পোকারে হজম করি ফেলুম”।
এই ছিলো আমার চমৎকার শৈশববেলা।শহরে তখন অনেক সংগ্রাম, যুদ্ধ মারামারি চলতো।আমাদের ছোট্ট নূরপুর গ্রামে তার কোন স্পর্শ ছিলোনা।বাবা যেদিন আমাকে প্রথম স্কুলে নিয়ে যান সেদিন আমার খুশি কে দেখে?আমি একটা কালো রঙের পোটলার মধ্যে স্বরে অ স্বরে আ-র বই নিয়ে ক্লাসে যেয়ে বসি।আমার পাশে একটু মোটকু সুটকু একটা ছেলে বসে ছিলো।আমি কেন যেন ছেলেটাকে পছন্দ করলাম না।তার বিশাল ভূড়িতে একটা লাথি দিলাম।লাথি খেয়ে ছেলে আমার দিকে ক্যাবলার মত তাকিয়ে বললো, “মারিস ক্যা বে?”
আমি একথা শুনে আরেকটা লাথি দিলাম।লাথি খাওয়া ছেলেটার নাম ছিলো মফরুদ।মফরুদ ৭১ সনে শহীদ হওয়া সবচেয়ে সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন বলে আমি বিশ্বাস করি।আমার এই বীর বন্ধু ৭১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে একা একা একটা পাকিস্তানী ক্যাম্পে ঢুকে পাচটা পাকসৈন্য মেরে ফেলেছিলো।যাওয়ার আগে আমাকে বলছিলো, “দোস্ত আম্মারে অনেকদিন দেখিনা।এগুলারে মাইরা আকাশে যায়া আম্মার লগে দেখা করমু।খুদা হাফেজ”।
আমি তাকে বাধা দিতে পারিনি।আমার সেই সামর্থ্য ছিলোনা।

১৯৬৮ সনের কথা বলছি।প্রথমবার ঢাকায় এলাম, মোটর গাড়ি দেখলাম।মুগ্ধ হয়ে রমনার গেটের সাথে লাগানো বিশাল বটগাছটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম।তখন পুরনো ঢাকায় গুটিকয়েক কাবাব ওয়ালা ছিলো।আমি প্রতি শুক্রবার কাবাব খেতে যেতাম।রমজান মোল্লার কাবাব।রমজান মোল্লা লোকটাকে আমার বিশাল পছন্দ ছিলো।তার কাঠ দিয়ে বানানো চুল্লীর মত চোঙ্গে ভাজা কাবাবের সামনে গেলে তিনি আমাকে বলতেন, “আব্বাজী আইজকা তোমারে কাবাব কেমনে বানাই সেই কথা শুনামু”।আফসোস আমাকে উনি আর কিছুই বলতেন না।একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কাকু আপনি অনেকবার বলেছেন কাবাব বানানো শিখাবেন।পরে আর তো কিছু শিখাইলেন না”।
কাকু বললেন, “আব্বাজী আমি যদি তোমারে শিখায় দেই তাইলে তুমি তো আমার ইহানে আর আইবানা।একটা পোলারে কালাজ্বরে হারাইছি।আরেকটারে কেমনে হারাই”।
কাকু সেদিন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন।আমি মনে মনে বললাম, “বোকা কাকু তুমি আমাকে হাজার বার শিখাইলেও এই কাবাব আমি বানাতে পারবোনা।আমার অন্তরে এত ভালোবাসা সৃষ্টিকর্তা দেননি যা দিয়ে এমন যত্ন করে কাউকে কাবাব খাওয়ানো যায়”।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতাম।প্রতিরাতে মা আর বাবাকে চিঠি লিখতাম।আমার মা আর বাবা দুজন পাল্লা দিয়ে ইয়া বড় বড় চিঠি লিখে আমাকে জ্বালাতন করতেন।আমি পরম ভালোবাসায় প্রত্যেকটা চিঠি একটা ছোট্ট কাপড়ের ব্যাগে ভরে রাখতাম।আমার বন্ধু আজগর একদিন আমাকে বলে, “বন্ধু চিঠিগুলো কোন প্রিয় বান্ধবীর একটু বলো তো শুনি”।
আমি হেসে বলতাম, “এই চিঠিগুলো আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আর বান্ধবীর।এরা আমাকে যতনে ভালোবাসায় যা কিছু লিখে তার সবটাই এই কাগজে বন্দী হয়ে আছে”।
আজগর হাসে, কিছু বলেনা।আমাকে বলে, “একদিন তোমার বাড়িতে যাবো।প্রিয় বন্ধু বান্ধবীকে দেখে আসবো”।
আমি মাথা নাড়ি।তাকে কথা দেই নিয়ে যাবো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন খুব কড়া নিয়ম কানুন ছিলো।ছেলেরা মেয়েরা আলাদা বসতো।কোন ছেলে যদি কোন মেয়ের সাথে কথা বলে তাহলে সেটা পুরো ক্লাসে ছড়িয়ে পড়তো।অজস্র কানাকানি হতো, তাদের মধ্যে প্রেম টাইপ কিছু হয়েছে বলেও ধরে নেওয়া হতো।আমার খুব প্রেম করতে ইচ্ছা করতো।আমি অবশ্য পারতাম না কারো দিকে প্রেম প্রেম ভাব করে তাকাতে।একবার অবশ্য চেষ্টা নিয়েছিলাম।ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী ছিলো সুবর্ণা।আমি একদিন তাকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্লাসে আসতে দেখলাম।তার দিকে সেদিন তাকিয়ে আমি বিশাল প্রেমে পড়ে গেলাম।সেদিনই হলে যেয়ে একটা কাগজ আর মুখে কলম গুজে চিঠি লিখার চেষ্টা করলাম।মুখ থেকে কলম বের করা হয়নি।চিঠিটাও লিখা হয়নি।দুমাস পরে সুবর্ণার বিয়ে হয়ে গেলো আমাদের এক শিক্ষকের সাথে।ওই স্যার আমাদের আপেক্ষিক জ্যোতির্বিদ্যা পড়াতেন।আমি মুগ্ধ হয়ে তার কন্ঠে জ্যোতির্বিদ্যার সূত্র শুনতাম।কিন্তু সুবর্ণাকে বিয়ে করার পর থেকে তার ক্লাস আর করিনি।বজ্জাত লোকটা কিনা শেষ পর্যন্ত ছাত্রীকেই বিয়ে করলো।আহত হৃদয়ে আমি কবিতা লিখার চেষ্টা করেছি কতবার।আফসোস সেটাও পারলাম না কখনো।

তবে আমার কিছু একটা অবশ্যই লিখা হতো।সেই অখাদ্যগুলোর শ্রোতা ছিলো আমারই বন্ধু আজগর।যতক্ষণ না তার নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যেত ততক্ষণ আমি তার কর্ণে প্রদাহ সৃষ্টি পূর্বক কবিতা আবৃত্তি করতাম।একদিন কবিতা লিখলাম আমার প্রিয় সবজি পটল নিয়ে।আজগর সেদিন বিশাল রেগে গিয়ে ঘুম থেকে উঠে আমার গলা টিপে ধরেছিলো।আমাকে বলেছিলো, “হারামজাদা আরেকবার বেগুল পটল নিয়ে কবিতা লিখে আমার ঘুম নষ্ট করলে তোর গায়ে আগুন ধরায় সুবর্ণার কাছে পাঠায় দিবো”।সেটিই আমার জীবনে শেষ কবিতা ছিলো।কবিতার শেষ দু চরণ পাঠকের জন্য,
“পটল তোমার সবুজ খোসা আমি ভালোবেসে ফেলেছি
তোমায় সেদ্ধ করে খেয়ে আমি যেন স্বর্গ খুজে পেয়েছি”

৭০ সালের দিকে নির্বাচন হলো।শুনলাম মুজিব সাহেব বিশাল ব্যবধানে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।কিন্তু তাকে গদিতে বসতে দেয়া হবেনা।আমার বন্ধু পল্টু তখন এইসব রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলো।আমরা বন্ধুরা গোল হয়ে বসে তার জ্বালাময়ী রাজনৈতিক আলোচনা শুনতাম।পল্টু বলতো, “আমরা বাঙ্গালীরা কেন এমন নির্যাতিত এইটা কি জানো?কারণ আমরা হইলাম মেছো বাঙ্গালী।মাছ ভাত খাইতেই শুধু জানি।একটু রাস্তায় মিছিলে ডাক দিলে তোমরা বলো, Sorry need to do my water”.
আমি সেদিন সাহস করে বলে ফেলেছিলাম, “তুই কি বলতে চাস আমরা সবাই ডায়াবেটিকসের রোগী?”
পল্টু কিছু বললোনা।শুধু তার তীব্র দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো, “তোরে খাইছি”।

৭ই মার্চ ১৯৭১ সাল।আ্মি রেসকোর্সের ময়দানে।মাথার উপর গনগনে সূর্য।আজকে শেখ সাহেব আমাদের মাঝে আসবেন, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলবেন।তার সাথে নির্বাচনে জয়ের পরও যে হঠকারীতা হয়েছে তা নিয়ে আমাদেরকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানাবেন।আজ একটা কিছু হবে এটা সবাই বুঝতে পারছে।আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।প্রচন্ড গরম লাগছে।একটু সামনেই একটা ডাবওয়ালাকে দেখতে পেলাম।পকেটে তখন একটা কচকচে এক টাকার নোট।ডাবওয়ালার কাছে যেয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, “ডাব খাবো।একটা ছিলা দাও”।ডাবওয়ালা কিছু বলেনা।আমার দিকে বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “ডাব বেচুমনা”।
আমি কিছু না শুনার ভান করে চলে এলাম।একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।রক্ত শীতল করা অনুভূতি।মনে হচ্ছে আজকের দিনটা খুব খারাপ যাবে।আশেপাশে লক্ষাধিক মানুষ, সবাই চুপ হয়ে আছে।এই গুমোট ভাবের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হবে।আজ আমি আর আজগর দুজনই ক্লাস ফাকি দিয়েছি।আমাদের ক্লাসের মেয়েগুলো ছাড়া আসলে সবাই ক্লাস ফাকি দিয়েছে।অনেকদিন ধরে এই দেশের মানুষ চাচ্ছিলো কিছু একটা হোক।আজ বোধহয় সেই কিছু একটা হওয়ার দিন।
শেখ সাহেবের গলা কাপানো ভাষণে সবার রক্তে কাপন ধরিয়ে দিয়েছিলো বিশ্বাস করুন।আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।এই মুগ্ধতার কারণ একটা স্বপ্ন।এই স্বপ্ন সবার চোখে মুখে ঠিকরে বের হয়ে পড়ছিলো।শেখ সাহেবের ডাক দেওয়া সংগ্রামে যে স্বপ্নটা সফল হবে, সেই স্বপ্নে আমরা একটা দেশ পাবো।এই দেশটাকে আমরা সবাই কতই না ভালোবাসি, কিন্তু আমাদের রক্তে এভাবে কে কবে পেরেছিলো কাপন ধরিয়ে দিতে।আমি আর আজগর যখন সন্ধ্যার দিকে হেটে হেটে হলে ফিরছিলাম তখন আমাদের মনে ভয়ংকর আগুন।এই আগুনে আশেপাশের সব অন্যায়, নিপীড়ন শোষণ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।আজগর একটা সিগারেট ধরালো হলের গেটের মাথায়।আমাকে বললো, “সামনে কি যুদ্ধ হবে?”
আমি ডানে বায়ে মাথা নাড়ি।বিজ্ঞ ভাব ধরে বলি, “হওয়ার কথা না।এই উত্তাল সময়ে একটু আকটু এমন বিদ্রোহ হবে হয়তো।তারপর দেখিস সব ঠান্ডা হয়ে যাবে”।

আজগর চোখ বন্ধ করে ধোয়া ছাড়ে।ধোয়াগুলো সব এক হয়ে রুপালী চাদের আলো ঢেকে ফেলতে চায়।আমি হাই তুলি।ঘুম পাচ্ছে।আজকে বিশাল একটা পেইন গেছে।সারাদিন প্রায় না খেয়ে ছিলাম।হলে একটা বিস্কিটের প্যাকেট আছে, কসমস বিস্কিট।ভাত খেতে ইচ্ছা করছেনা।সমস্যাটা হলো রক্ত খুব গরম হয়ে আছে।কি যেন করতে ইচ্ছা করছে।বুঝতে পারছিনা সেটা কি।বাবা মাকে দেখতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে।আমাদের সবুজ গ্রামে এখন সবাই হয়তো শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।ঢাকার গরম বাতাস তাদের কাছে পৌছুতে পারেনা।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা।আমি মায়ের কাছে বসে আছি।মাকে গল্প বলি ঢাকার।বাবা চুপ করে শোনে।আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ক্লাস শুরু হবে কবে?”
আমি মাথা নাড়ি।বাবার দিকে তাকিয়ে বলি, “ক্লাস করতে ভালো লাগেনা আব্বা।তোমাদের সাথে থাকবো”।
আব্বা আমার কথা শুনে হাসে।মা আমার জন্য পায়েস বানিয়েছে।আমি মজা করে সেই পায়েস খাই।আমার মনে তখন একটা ভয়ংকর চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।যতবার বাহিরে তাকাই আমি লাল আগুন দেখতে পাই চারদিকে।এই আগুনটা অনেক ভয়ংকর।আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, সব শেষ হয়ে যাবে ওই আগুনে।
১০ই আগষ্ট, ১৯৭১ সাল।আমার বাবা মাকে এই একটু আগে আমার চোখের সামনে হত্যা করা হলো।আমার অনেকক্ষণ জ্ঞান ছিলোনা সেসময়।আমাকে প্রচন্ড জোরে মাথায় আঘাত করলে আমি শুধু মায়ের শেষ কথাটি শুনতে পেয়েছিলাম, “আমার বাজানরে মাইরোনা।ওরে বাচতে দাও”।
আমাকে একটা নৌকায় তুলে নেয় রাজাকার বদি আর তার দুই শিষ্য।একসময় আমাকে বলে, “তোমার বন্ধু মফরুদ আমার ঘরে আগুন ধরায় দিলো।সবার কাছে সে বইল্যা বেড়ায় আমারে নাকি তার বেয়াদ্দইপ মুক্তি বন্ধুগো লইয়া নেংটা কইর‍্যা গ্রামে ঘুরাইবো।তোমার বাড়িত তো কাল ও আসছিলো।আসেনাই?”

আমি মাথা নাড়ি।আমার মাথা থেকে একটু একটু করে রক্ত চুইয়ে পড়ছে পায়ের কাছে।আমি চাদের আলোয় সেই রক্ত দেখি।নৌকা নদীর পানিতে আস্তে আস্তে ঢুলে ঢুলে চলছে।আমি বদিকে বলি, “মফরুদ তোরে নিয়ে কি করবে জানিনা।আমি তোরে আজকে এই পানিতে চুবায় মারবো”।
বদি আমার দিকে তাকায় হতভম্ব দৃষ্টিতে।আমিও তার দিকে তাকাই।আমার বাবার কথা মনে পড়ে।আমার বুকে একটা ভয়ংকর হাহাকার সৃষ্টি হয়।আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুগুলো আমাকে আর কখনো আদর করে খাইয়ে দেবেনা। মা আমার মাথায় আর হাত বুলিয়ে দেবেনা।এই ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী সময়ের স্রোতে তারা হারিয়ে গেছে।আমার বুকটা ভেঙ্গে যায়।এই তো একটু আগেও তারা নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো, তাদের সত্ত্বাটা আমাকে ভালোবাসার জন্য জেগে ছিলো।আমি এই ভয়ংকর সময়ে যুদ্ধে যাইনি শুধু তাদের জন্য।আমার অনেক ভয় হতো যদি আমি মরে যাই, তাহলে আমার বাবা মাকে কে দেখবে।আমি এমন কোন সময়ের কল্পনা করতে পারতাম না যে সময়ে তারা আমার পাশে থাকবেন না।আমার মনে হচ্ছিলো আমি মারা যাচ্ছি।আমি বদির দিকে তাকাই।সে তখনো আমার দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমাকে বললো, “তোর সাহস তো কম না কাফিরের বাচ্চা।তোরে ক্যাম্পে নিয়া আজকে টাইট দিমু”।

আমি ডান দিকে তাকাই।আরেকটা নৌকা খুব দ্রুত আমাদের নৌকার দিকে এগিয়ে আসছে।বদি ভয় পাওয়া কন্ঠে বলে, “নৌকায় কেডা যায়?”
আমি মফরুদকে দেখতে পাই।মফরুদের হাতে চাইনীজ রাইফেল।আমি বদিকে নিয়ে নৌকা থেকে লাফ দেই।মফরুদ অপেক্ষা করেনা।বদির দুই শিষ্যর দিকে দ্রুতগতিতে অনেকগুলো গুলি ছোড়ে।আমি দুই রাজাকারের পানিতে পড়ার শব্দ পাই।বদিকে আমি পানিতে চেপে ধরে রাখি।পানি এদিকে খুব বেশি গভীর নয়।আমার গলা পর্যন্ত ঠিকমত পানি উঠেনি।আমি মাথা উপরে তুলে নিষ্পলক হয়ে বিশাল বড় চাদটাকে দেখি।আমার দুই হাত তখন বদির গলা টিপে পানিতে ডুবিয়ে রাখা।একসময় ক্লান্ত হয়ে আমি বদির দেহটা ছেড়ে দেই।বদির দেহটা পানিতে ডুবে যায়।সেই দেহে তখন আর প্রাণ ছিলোনা।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, আমার দিনটা ঠিক মনে নেই।সেই দিনের পর আমি একটাদিনও কাদতে পারিনি।আমি কারো সাথে কথা বলতাম না।বুকের ভেতর একটা গনগনে রক্তলাল আগুন জ্বলতো।একটাই চিন্তা ছিলো মাথায়।সব পাক হারামীকে এই দেশের মাটিতে মারবো, এদের নাপাক নীল রক্তের বন্যা দেখার জন্য আমার ভিতরে আগুন জ্বলতো।আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না একটাবারের জন্য।একটু চোখটা লাগলেই ধ্রিম ধ্রিম আওয়াজ শুনতাম।মফরুদ আমাকে বলতো, “দোস্ত ঘুমা কিছুক্ষণ।আমি পাহারা দিচ্ছি”।

আমি ওর কথা শুনতাম না।আমাদের ১৬ জনের দল, সবাই কাউকে না কাউকে হারিয়েছে।যুদ্ধের ভয়ংকর সময়ে আমরা হয়তো আরো ভয়ংকর হয়ে গিয়েছিলাম।গভীর রাতে সবাই চুপ করে শুয়ে শুয়ে নিজের আপনজনদের কথা ভাবতো।আমাদের মধ্যে হাফিজ ভাই ছিলেন যার একটা ৬ বছরের মেয়ে ছিলো।উনি প্রতিরাতে তার মেয়েকে কাদতে কাদতে চিঠি লিখতো।সেই চিঠির একটাও তিনি তার মেয়েকে দিতেন না।আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হাফিজ ভাই এত চিঠি লিখেন।মেয়েকে দেন না কেন?”

হাফিজ ভাই আমার কাধে হাত দিয়ে বলে, “আমি যদি মারা যাই তবে এই চিঠিগুলা দেখে আমার মেয়ে আরো বেশি কাদবে।ওকে এত ভালোবাসা বোঝানোর কি দরকার বলো?”

মফরুদ প্রায় সময় বলতো, “দোস্ত ক্ষিদা লাগছে”।আমি খুব বেশি কিছু খেতাম না কখনো।মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তাদের কাছে খাবার চাইতে ভয়ংকর লজ্জা লাগতো।আমাদের বেশিরভাগ অপারেশন চলতো তখন ঢাকায়।দালানকোঠাগুলোর সব প্রায় সময় খালি থাকতো।দুই একটায় যারা থাকতো, তারা আমাদের দেখলে ভয় পেতো।আহমেদ ভাই নামে একজন কলেজের টিচারের বাসায় আমরা প্রায়ই আশ্রয় নিতাম।আহমেদ ভাই আমাদের দেখলে ভাত বসিয়ে দিতেন।মোটা চালের ভাত আমাদের থালায় যখন বেড়ে দিতেন তখন তাকে দেখে মনে হতো লজ্জায় মারা যাচ্ছেন।একদিন কেদে দিয়ে বললেন, “আমার ভাইটা যুদ্ধে গেছে তোমাদের মত।কিছুদিন আগে শুনলাম ভাইটাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে।মনে হয় আর বেচে নেই তাই না?”

আমরা তাকে সান্তনা দিতাম না।ওই ভয়ংকর কালো সময়ে কেউ কাউকে সান্তনা দিতোনা।একদিন গভীর রাতে আহমেদ ভাইয়ের বাসায় যেয়ে দেখি বাসার দরজা ভাঙ্গা, ভিতরে আহমেদ ভাইয়ের জিহবা বের করা লাশ।ঘরবাড়ি সব লন্ডভন্ড।আমি আহমেদ ভাইয়ের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম।সেদিন আমার সাথে কেউ ছিলোনা মফরুদ ছাড়া।মফরুদ আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “লাশটা কবর দিতে হবে চল।এই লোকটা আমাদের জন্য যা করছে, তাকে এভাবে ফেলে রাখতে পারবোনা”।

গভীর রাতে আমি আর মফরুদ বখশীবাজার বড় মসজিদের পাশে যে একটা খালি জমি পড়ে আছে সেখানে কবর খুড়তে থাকলাম।আহমেদ ভাইকে কবর দিলাম আমরা সম্মানের সাথে।এই মানুষটা কখনো যুদ্ধ করেনি, কিন্তু একটা যুদ্ধকে বুকে আগলে রেখেছিলো।আমরা যখন তার বাসায় গোল হয়ে বসে খেতাম তখন তিনি প্রায়ই আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।আমি তাকে কবর দিয়ে পাশে শুয়ে পড়ি।অনেকদিন পর চোখ দিয়ে পানি বের হলো।মফরুদ শব্দ না করে কাদছে।আমাকে বিড়বিড় করে জিজ্ঞাসা করলো, “দোস্ত আর কতদিন এমন কুত্তার লাহান বাচুম?”
আমি বলি, “আরো একশ বছর।নাহয় দুইশো বছর।কিন্তু যুদ্ধ থামাবোনা।সবগুলারে মারবো।একটারেও ছাড়বোনা”।

কথা বলতে বলতে আমাদের পাশ দিয়ে একটা মিলিটারী গাড়ি আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়।মফরুদ উঠে বসে।আমাদের দুজনের কাছে তখন দুটা চাইনীজ রাইফেল।দ্রুত আমরা একটা ভাঙ্গা দালানের আড়ালে ঢুকে যাই।গাড়ি থেকে একজন দুজন করে দশ বারোজন পাকসেনা নামে।এদের মধ্যে একজন অফিসার আছে বুঝতে পারি।সেই অফিসার রাস্তার মাঝে পায়চারী করতে থাকে।তার মুখে সিগারেট।আমার বন্ধু আমার দিকে তাকায় বলে, “সামনের স্কুলে ওরা ক্যাম্প বানাইছে দেখছোস”।

আমি বলি, “ফজলু আর বাবুল থাকলে একটা অপারেশন নিয়ে ফেলতাম”।
কথাটা বলতেই আমাদের দুজনের রক্ত গরম হয়ে যায়।বুকের মধ্যে আগুন জ্বলতে থাকে।আমরা জানি আজ এই গভীর কালো অন্ধকার রাতে আমাদের কিছু একটা করতে হবে।হয়তো আমরা মারা যাবো, কিন্তু আমাদের কিছু একটা করতে হবে।আমি মফরুদের জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকাই।মফরুদের জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই অন্ধকার ঘেষে।হঠাৎ করে আমার বুকের মধ্যে একটা হাহাকার সৃষ্টি হয়।এই হাহাকার আমি যদি বেচে যাই তবুও কোনদিন ভুলতে পারবোনা।আজন্ম আমাকে তা জ্বালিয়ে মারবে।আজ হঠাৎ করে মনে হচ্ছে আমি এই দেশটাকে অনেক ভালোবাসি।এই দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া সহজ সরল মানুষগুলাকে অনেক ভালোবাসি।আমি তো ওদেরে জন্যই যুদ্ধ করছি।ইশ কেউ যদি আমার কথা লিখতো।আমি এই দেশের সাত কোটি মানুষের জন্য বুকের মধ্যে যে ভালোবাসা নিয়ে বেচে আছি তা যদি কেউ জানতো, কেউ বুঝতো।

মফরুদ আর আমি পাকসেনাদের থেকে একটা নিরাপদ দূরত্বে যেয়ে গুলি করার প্রস্তুতি নেই।বিশাল একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আমিই প্রথম গুলি ছুড়ি।একটার পর একটা গুলি।আমার হাত আগুনের ছিটায় জ্বলে যায় প্রায়, কিন্তু আমি গুলি ছুড়তে থাকি।পাকসেনারা প্রথমে বুঝতে পারেনি কোথা থেকে গুলি ছুটে আসছে। যখন বুঝতে পারলো সাথে সাথে তারা আমাদের দিকে গুলি ছুড়তে থাকলো।এভাবে কতক্ষণ গিয়েছিলো জানিনা।প্রতিটা মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি একটা গুলি এসে আমার বুকে লাগলো।কিন্তু আমার মনে কোন ভয় ছিলোনা।আজ হয়তো আমার এই সুন্দর পৃথিবীটা ছেড়ে যাওয়ার দিন।তাতে কি?আমি নাহয় আকাশ থেকে এই বসুন্ধরাকে ভালোবাসবো।

আমি আর মফরুদ একসময় বুঝতে পারি আমাদের গুলি শেষ হয়ে যাচ্ছে।মফরুদ আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “দোস্ত আম্মারে অনেকদিন দেখিনা।এগুলারে মাইরা আকাশে যায়া আম্মার লগে দেখা করমু।খুদা হাফেজ”।
আমি তাকে বাধা দিতে পারিনি।বাধা দেয়ার সময় খেয়াল করলাম আমার পা দিয়ে রক্ত পড়ছে।ডান পায়ের উরুতে ভয়ংকর ব্যাথা।মফরুদ আরেকবার পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে, “দোস্ত অনেক কষ্ট লাগতাছে।আমারে মনে রাখিস।তুই পালায়া যা।সবাইরে বলিস আমার কথা।যা ভাগ।দৌড়া।তোর জীবন অনেক দামী”।

আমি চুপ করে বসে ছিলাম।আমার মনে হচ্ছিলো আমি কেন যাচ্ছিনা।এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম নিজেও জানিনা।জ্ঞান ফিরলো ভয়ংকর গুলির শব্দে।হয়তো এই শব্দের মাঝে আমার বন্ধু মফরুদের হারিয়ে যাওয়ার হাহাকার ছিলো।আমার তখন মাথায় কিছু আসছিলোনা।আমি অনেক কষ্টে একপায়ে ভর দিয়ে উঠে দাড়ালাম।অন্ধকারের মধ্যে কোন দিকে ছুটে গিয়েছিলাম জানিনা।একটা পুরনো বিল্ডিয়ের সিড়ি দিয়ে খোড়াতে খোড়াতে উঠলাম।সাদা জামা পড়া একটা মেয়ে আমাকে দেখে ভয়ে চিৎকার দিলো।আমি মেয়েটা যেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো সেই দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় সেদিন শুরু হলো।

আমার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমার পাশে একটা বৃদ্ধ লোক বসে আছে।আমার মাথায় কেউ একজন পানি দিয়ে যাচ্ছে।আমি চোখ খুললে কেউ একজন বললো, “এখন ভালো আছেন?”
আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি।ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি একদল নেকড়ে আমার মাংশ খুবলে খুবলে ছিড়ে নিচ্ছে।আমি ভয়ংকর চিৎকার করছি।কেউ সেই চিৎকার শুনতে পায়না।
আমি প্রায় দুমাস বিছানায় পড়ে ছিলাম।এই সময়টায় আমি হামিদ সাহেব নামে একজন হোমিওপ্যাথী ডাক্তারের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।যে মেয়েটা আমাকে দেখে চিৎকার করেছিলো তার নাম ছিলো তাজিয়া।সে হামিদ সাহেবের মেয়ে।এই মেয়েটা আমাকে দেখলেই শুধু ভয় পায়।কেন পায় জানিনা।একদিন তাকে ডাকলাম।জিজ্ঞেস করলাম, “কি করো?”
মেয়েটা আমার দিকে তাকায় না একবারও।আমাকে আস্তে আস্তে বলে, “আমি কলেজে পড়তে চাই।স্কুল পাশ করেছি”।
আমি তার চোখে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে ভয় পান কেন?”
মেয়েটার মুখটা ভয়ে পাংশু হয়ে গেল যেন।আমাকে কিছু না বলে আমার ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।যাওয়ার আগে মনে হয় বললো, “কে বলেছে ভয় পাই?”

ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখ আমি আস্তে আস্তে হেটে জানালার কাছে গেলাম।আমাকে যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে সেখানে ঠিক পুব কোণে একটা ছোট্ট জানালা।নতুন কাঠের পরতা লাগানো।আমি জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকাই।আমার পায়ে যে অংশে গুলি লেগেছিলো সেখানে এখনো প্রচন্ড ব্যাথা।আমার ভাগ্য ভালো যে গুলিটা আমার উরু ছুয়ে বের হয়ে গেছে।নাহলে হয়তো আজীবন পঙ্গু হয়ে যেতাম।
এসময় হামিদ সাহেব আমার রুমে এসে ঢুকলেন।আমাকে বললেন, “তুমি নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছো বাবা?”
আমি মাথা নাড়ি।তাকে জিজ্ঞেস করি, “দেশ স্বাধীন হলে কি করবেন?”
হামিদ সাহেব তার চশমা খুলে চোখটা মুছলেন।আমাকে বললেন, “একটা দেশ স্বাধীন করার থেকে তার স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।আমি অপেক্ষা করবো দেখার জন্য তোমরা তখন কি করে দেশটা চালাও”।
আমি মাথা নাড়ি।তিনি কি বললেন আমি সেটা ঠিকমত অনুধাবন করতে পারলাম বলে মনে হলোনা।হামিদ সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন, “বাবা আজাদ তোমাকে একটা কথা বলি।এই দেশটা কবে স্বাধীন হবে আমি জানিনা, আদৌ হবে কিনা তাও জানিনা।কিন্তু তোমার মত কিছু মানুষ যখন যুদ্ধে নেমে পড়লো, বুকের ভিতরের টগবগে ভালোবাসার সবটা দেশের জন্য দিয়ে দিলো তখনই আসলে একটা দেশ তৈরী হয়ে গেছে।আজ থেকে আরো এক হাজার বছর পরও এই দেশটা থাকবে।দেশ মাটির হিসাব দিয়ে, আয়তন দিয়ে তৈরী হয়না।একটা দেশ তৈরী হয় ভালোবাসায়।যতদিন তোমার মধ্যে এই ভালোবাসাটা থাকবে ততদিন এই দেশটা থাকবে।যেদিন এই ভালোবাসাটা মরে যাবে এই দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে”।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কেউ শুনতে পায়না।

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল।আমি সারারাত জেগে রেডিও শুনেছিলাম।সেইসময় সমগ্র দেশে একটা ভয়ংকর আলোড়ন তৈরী হলো।যখন দেশ স্বাধীন হওয়ার ঘোষণা শুনলাম আমি হামিদ সাহেবের বাড়ি থেকে নিচে নেমে আসলাম।যেই মাঠে আহমেদ ভাইকে কবর দিয়েছিলাম সেখানে খুড়িয়ে খুড়িয়ে পৌছালাম।আমার বন্ধু মফরুদের রক্ত এখানেই কোন এক ঘাসে ঢাকা ছিলো।আমি চিৎকার করে কাদতে কাদতে সেই রক্তের রঙ খুজে বেড়ালাম।একসময় ক্লান্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম।আজকে আমার মন খুলে কাদার দিন।এখন আমি একটা দেশ পেয়েছি।এই দেশ কেউ আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা।এই দেশের জন্য বুকের গভীরে যে ভালোবাসা এটাও কেউ আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা।আমি পাগলের মত মাঠে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম আর কাদছিলাম।এই কান্না ভয়ংকর আনন্দের।প্রতিটা দিন, প্রতিটা সেকেন্ড একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার এই আবেগ এই জাতি কখনো ভুলবেনা।আমি চোখ বন্ধ করে আমার বাবা মায়ের মুখটা কল্পনা করি।এই তো তারা আমার কত কাছে, অনেক কাছে।

সেদিন রাতে আমি হামিদ সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নেই।আমার সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে।মনে হচ্ছে এই হাসি কখনো মুছবেনা।এখন আমি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যাবো।বন্ধুদের খুজে বেড়াবো।আমার গ্রামে যাবো।আমার যে ছোট্ট একটা ঘর ছিলো, যেই ঘরে মা আমাকে প্রতিরাতে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিতো ছোটকালে সেই ঘরে আমি ফিরে যাবো।হামিদ সাহেব আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় বললেন, “বাবা তোমার জন্য আমার হাজার জীবনের দোয়া করলাম।তুমি একটা দেশ উপহার দিছো সেই তুলনায় আমি তোমাকে কিছুই দেয়ার যোগ্যতা রাখিনা।আমাদের বাবা মেয়েকে ভুলে যেওনা।নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে।মনে রেখো, ঠিক আছে?”

আমি মাথা নাড়লাম।আমি যখন সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছিলাম, তখন তাজিয়া আমার পিছু নেয়।আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।তাকে বললাম, “তুমি প্রতিরাতে আমার পাশে বসে থাকতে যখন আমার জ্ঞান ছিলোনা।আমি তখন কিন্তু তোমার উপস্থিতি অনুভব করতাম।তুমি যখন চামচে করে আমাকে খাইয়ে দিতে আমার সবসময় চোখ ভিজে যেত।আমার মা ছাড়া কখনো কেউ আমাকে এভাবে খাইয়ে দেয়নাই।কোন ভাষায় তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো তা জানা নাই।আমি তোমাকে কোনদিন ভুলবোনা।কোনদিন না”।
তাজিয়া চোখ মুছে বারবার।আমাকে লাজুক মেয়েটা আস্তে আস্তে বলে, “আপনার উপর না একটা মায়া পড়ে গেছে।আপনি আরো দুটা দিন থেকে যান না”।
আমি ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলি, “দুদিন থাকলে কি হবে।চলে তো যেতে হবেই।আটকে রাখতে চাও?”
তাজিয়া আমার দিকে তাকায় না।মাথা নিচু করে পা দিয়ে সিড়িতে টোকা দিতে থাকে।একসময় বলে, “আমি আসলে স্বাধীনতা, যুদ্ধ অনেক ভালো বুঝিনা।আমি আপনার মুখে যখন যুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার কথা শুনতাম তখনই শুধু বুঝতে পারতাম একটা কিছু হচ্ছে।অনেক বড় কিছু।আপনি যদি এখন হারিয়ে যান এত সুন্দর করে কেউ এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলবেনা।আমার আরো অনেক জানতে ইচ্ছা করে।এগুলো নিয়ে শুনতে ইচ্ছা করে”।

আমি অবাক হলাম কিছুটা।এই মেয়ে এত কথা কিভাবে বললো।আমি ওকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলাম।এর দু মাস পর নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে আমি তাজিয়াকে বিয়ে করি।

৪০ বছর পর আমি মন্ট্রিলে বসে যখন সংবাদপত্র পড়ছিলাম তখন পত্রিকার ঠিক ছোট্ট এক কোণে দেখলাম বাংলাদেশের পতাকার ছবি দেয়া আছে।নিচে লিখা, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে বাংলাদেশ নামে ছোট্ট একটা দেশ অনেক রক্ত দিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা আদায় করেছিলো।এই দেশের মানুষ অনেক আবেগী এবং অলস।
আমি আজাদ করিম আজ থেকে ১০ বছর আগে যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম তাকে ছেড়ে বিদেশ বিভুইয়ে দিন কাটাচ্ছি।আমার দুটা মেয়ে আর একটা ছেলে আছে।আমার চারটা নাতনীও আছে।আমি তাদের কাছে অনেক গর্ব করে আমার দেশের গল্প বলি।শুধু লজ্জা পাই যখন তারা জিজ্ঞেস করে, “আমাদের দেশের মানুষ যখন এই দেশটাকে এত ভালোবাসতো, রক্ত দিতে একটুও কার্পণ্য করেনি তাহলে আজ এসব কি হচ্ছে?”

আমি কেন দেশ ছেড়ে দিয়েছি তা তাদের বোঝাতে পারতামনা।এই অভিমান কেউ কখনো তাদেরকে বোঝাতে পারবেনা।আমি আমার স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প তাদের বলতে পারতাম না।আমি বলতে পারিনা রাজাকার বদির ভাই জমির উদ্দিন এখন সংসদে দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে।আমি বলতে পারিনি এই দেশের সাধারণ মানুষরা আজকাল প্রায়ই ১৬ বছরের মিলনকে চোখের পলকে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলে। আমি বলতে পারিনি এই দেশের এক মা তার সদ্য জন্মানো সন্তানকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলো।এটাও বলতে পারিনি, যে এই দেশে এখন ছোট্ট ছোট্ট শিশুগুলো ভাত না খেতে পাওয়ার অভিমানে আত্নহত্যা করে।

আচ্ছা আপনাদের বলি, তবুও এই দেশটাকে আমি ভালোবাসি।আমি আমার পরবর্তী প্রত্যেকটা প্রজন্মকে এই দেশের জন্য আমার ভেতরে যে ভয়ংকর ভালোবাসাটা ছিলো সেটা গেথে দিয়ে যাবো।আমি আজও মনে একটা কথা লিখে রেখেছি, দেশ ভূমির মাপ দিয়ে হয়না।দেশ হয় ভালোবাসায়।এই ভালোবাসাটা যতদিন অন্তত একটা মানুষের মনে বেচে থাকবে, ততদিন এই দেশটা বেচে থাকবে।
*************************************************************

প্রিয় দেশ, এই লেখাটা তোমার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ৮:১৮
৪৮টি মন্তব্য ৪৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×