আলোর ঝলকানি দেখতে আমি চিলেকোঠায় উঠি ।
হাজার হাজার কষ্টের সিড়ি বেয়ে বেয়ে উঠতে থাকি এক বিভোরতায়। নীচে পড়ে থাকে কলোনি বাড়ির কলের পাড়, নোংরা গলি, খিস্তি খেউড়ে ডুবে থাকা আর অন্ধকারের সাথে বেড়ে ওঠা এক পাড়া । সারা সকাল পাড়াটা বেঘোরে ঘুমায় ।
দুপুরের আগে আগে পাড়া জাগতে শুরু করে। দাতঁমাজা, হাটুমাজা, দেহমাজাসহ কলপাড়ে ভিড়, চুলায় ভিড়সহ নানাবিধ ভিড় উপচে পড়ে । কেননা জায়গা বড় কম । মাত্র বিশ বর্গ ফিটে দুজন করে মানুষের বাস । সকাল থেকে শুরু করে শিশু শিক্ষার আপা, সিস্টার-ডাক্তার আপাদের কৌতূহলী আলাপচারিতা,বাজারবাবুর হিসাবের খাতার প্যাচাল,আলগা খুনসুটি, আর মাসিদের মোড়লীপানায় ভরে থাকে ক্লান্ত দুপুর-বিকেল ।
এর মাঝে হয়ত স্নান শেষে ভিজে চুলে কেউ দাঁড়ায় এক চিলতে রোদ্দুরে
কেউবা মুঠোফোনে জেনে নেয় দূরান্তে থাকা নিজ পরিবারের খোঁজ, পাঠানো মানি অর্ডারের খবর । নিজেকে পরিচয়হীন রেখে হয়ত অন্য কারো পরিচয়কে নিশ্চয়তা দেয় এই দেহজীবী নারীরা । কে জানে, তাদের পাঠানো অর্থেই লালিত হয় অন্য কারো স্বপ্ন । কেউবা বসে যায় সাজাতে নিজেকে কেননা সন্ধ্যা রাত্রে বিকোতে হবে নিজেকে ।সেখানে মুখের জেল্লাতি না বাড়ালে এ বাজারে টিকে থাকা বড় মুস্কিল । আর এ বাজারে প্রতারণা বড় এক পুঁজি ।
এখানে সন্ধ্যা হলে বাতি জ্বলে ওঠে ঘরে ঘরে । ঘরে ঘরে নকল ভালবাসার হাসি আর মুনাফার রাংতায় জড়ানো এক দেহজ বেসাতের আওয়াজ পাওয়া যায় । দেহলোভীরা ভিড় করে এইসব আত্মত্যাগী নারীর দরোজায় । যদিও ক্রেতা নাগরেরা নগদে বিনিময় করে কিন্ত ত্যাগ বড়ই একপেশে হয়ে যায় নারীদের জন্য ।
তাতে অবশ্য সমাজের কিছু এসে যায়না ।সমাজে ক্ষতের মত বেঁচে বর্তে টিকে যায় পাড়াটা, যুদ্ধ করে টিকে থাকে একদল মানুষ । মানুষই তো ।
দেখতে ,কথায়,আচার আচরণে ওদের মানুষের মতই তো লাগে । তবু কেমন একটা আশরাফী ঘৃনা আমাদের এই সত্যকে ঢেকে রাখতে চায় ।আমাদের বুঝিয়ে দিতে চায় ওরা মানুষ সত্যি কিন্ত যেন কেমন অন্য টাইপের মানুষ ।
অথচ অধিকাংশ নারীরাই কোথাও না কোথাও ছলনা-বঞ্চনার শিকার হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে । বেশীরভাগই অনিচ্ছায় শিকার হয়ে একেবারে উপাদেয় হয়ে চলে এসেছে সমাজের লাম্পট্যে ভরা এক আলুলায়িত শয্যায় ।
সারাটা জীবন ভাগ্যের দোষে জ্বলে পুড়ে অংগার হতে থাকে একদল নারী । একসময় এরাও মেনে নেয় ভাগ্য অথচ এরা কারো বোন, কারো স্ত্রী হতে পারত অনায়াসে ।
আর এর মধ্যেই জন্ম নেয় এবং বেড়ে ওঠে কিছু মানবশিশু, আদম সন্তান ।
কার পাপে বা কার ভালবাসায় এদের জন্ম তা উদঘাটন সম্ভব করা হয়ে ওঠেনা । সে উদঘাটন করতে গেলেই সমাজের বিরাট এলার্জি শুরু হয়ে যাবে ।
কার পাপে এই শিশুরা ক্রুশবিদ্ধ হয় প্রতিদিন ?
ওরা জানেনা পিতা,আব্বা,বাবা শব্দের মাহাত্ম কোথায় কতটুকুন । ওরা জানেনা এক নিবিড় আশ্রয়ের নাম –বাবা । হাজার হাজার অভিধান খুঁজেও পায়না বাবার কোন যুৎসই অর্থ । এক মা- তাও প্রতিদিনের দলাই মলাই শেষে আর মা হয়ে উঠতে পারেনা । হয়ত হটাৎ কোন মধ্যরাতে ঘুম ভেংগে গেলে মায়ের বুকের মধ্যে বা আঁচলের গন্ধের মধ্যে সামান্য একটু মা-কে খুঁজে পায় । সে বড়ই সামান্য ।
শিশুর অধিকার কে আর রক্ষা করে ! সরকার তো দূর আকাশের তারা তাকে দেখা যায় কিন্ত কাছে আসেনা । তাই ওরা বেশীদিন আর শিশু থাকেনা । অল্পতেই বুঝে যায় ব্যবসার কলা কৌশল , চাতুরী, সমাজের তাচ্ছিল্য ।
ওরা জেনে যায় দেখতে আদতে মানুষ হলেও ওরা আসলে মানুষ না ।
ওদের সাথে কেউই নেই । না ধর্ম, না সমাজ, না মা, না বাবা ! ওরা তাহলে বেঁচে ওঠে কিভাবে ? বেঁচে থাকে কিভাবে ? ওরা এই সমাজের বা মানুষের প্রতি কি মনোভাব পোষন করে তাহলে ? অথচ ওরাই জানে এই সমাজের কারা তাদের বাবারা ? সমাজের কারা রাতের আঁধারে মুখ মুখোশে ঢেকে ভিড় করে তাদের মায়েদের দরোজায় ।
এভাবেই একদল মানুষ দিনের পর দিন শোষিত হতে থাকে আমাদেরই সামাজিক বিলাস ব্যসনে , রাজনীতিতে, বাক্তিগত শয়তানিতে ।
আর আমরা মানব সেবার গল্প লিখি, মানব উন্নয়নে মেডেল নিই পারলে নোবেল নিয়ে টানাটানি করি,হ্যান করি ত্যান করি আসলে ঘোড়ার ডিম করি ।
আ স্টোরি অব ব্রোথেল/ ১৭।০৯।২০১৪