ব্রাজিল নিয়ে যতই গলা ফাটাই না কেন, আমার কাছে এখনও ফুটবলের শেষ কথা ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ওই একজন বাদে আর্জেন্টিনার প্রতি আমার পক্ষপাতের দ্বিতীয় কোনো ওজর নেই। লিওনেল মেসির খেলা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করি বটে, ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে আবার বদলে যায় হিসাব। ফুটবল আমার কাছে বরাবরই প্রিয় বিনোদন। ৯০ মিনিটের ওই উত্তেজনা উইলো ব্যাটের ঠোকাঠুকিতে কখনোই মেলেনি। সেই ছোটবেলা থেকেই শুরু। স্কুলের বাটা কেডসটা মাসও টিকতো না, কদিন পরই ফুটো হয়ে বেরিয়ে যেতো বুড়ো আঙুল। এবং ম্যারাডোনাই প্রথম আর্জেন্টাইন নন যিনি আমাকে ফুটবল শৈলী দিয়ে ইমপ্রেস করেছেন। ’৭৮ বিশ্বকাপ আমার প্রথম। বাবার চাকুরী সুবাদে তখন ইরানে, আর আলী পারভীনের নেতৃত্বে সেবার খেলছে তারাও। লম্বা চুলের মারিও ক্যাম্পোসের আর্জেন্টিনাই ঘরের মাঠে কাপ রাখলো। কিন্তু আমার নজর কাড়লেন ওসভালদো আর্দিলেস। দারুণ এক্রোব্যাটিক ব্যাক ফ্লিপে ডিফেন্ডারের মাথার ওপর দিয়ে বল নিয়ে যাওয়ার জাদুকরী দেখে আমি স্তব্ধ। কত যে প্র্যাকটিস করেছি এরপর। কিন্তু পারিনি।
এতো বড় ভূমিকা দিয়ে শুরু এই লেখায় আর্দিলেসের আগমন আসলে অন্য একটি কারণে। ক’দিন আগেই একজন ব্লগারের একটি ম্যুভি রিভিউ পড়েছিলাম। বাংলা একটা সিনেমা এসেছে ‘জাগো’ নামে, যার পুরোটাই ফুটবলকেন্দ্রিক। অনেকটা ‘চাক দে’ ধাঁচের (ট্রেলার দেখে আমার তাই মনে হয়েছে)। সেখানেই সম্ভবত পড়েছিলাম এ ছবি নির্মাণে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে প্রেরণা মেনেছেন পরিচালক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফুটবল খেলে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লড়াইয়ে নামা এই যোদ্ধাদের নিয়ে অনেক আগে লিখেছিলাম একবার । মিত্রদেশ ভারতে শরণার্থী স্বাধীন বাংলা ফুটবল একাদশ শতভাগ সফল হয়েছিলেন তাদের মিশনে। কিন্তু প্রদর্শনী ম্যাচও কিন্তু ম্যাচই। আর তা সত্যি জীবন মরণ যুদ্ধের রূপ নেয় যখন প্রতিপক্ষ থাকে সত্যিকার শত্রুরাই। পেলে, আর্দিলেস, ববিমুরের মতো কিংবদন্তী ফুটবলাররা তারই সেলুলয়েড রূপ দিয়েছিলেন ভিক্টরি (আরেকটি নাম এস্কেপ টু ভিক্টরি) নামের ছবিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের বিপক্ষে মিত্রবাহিনীর সদস্যদের একট ফুটবল ম্যাচকে ঘিরে আবর্তিত যার কাহিনী।
জন হিউস্টন পরিচালিত এই ছবিতে আরো আছেন সিলভেস্টার স্ট্যালোন, মাইকেল কেইন, ম্যাক্স ফন সিডো। গল্পটা সংক্ষেপে এমন যে, নিজেদের ভাবমূর্তি বাড়াতে জার্মান প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় বিভিন্ন বন্দী শিবিরের ফুটবলারদের নিয়ে গড়া একটি দলের সঙ্গে নিজেদের জাতীয় দলের একটি ম্যাচ খেলাবে। ভেন্যু প্যারিস। এদিকে ফরাসি স্বাধীনতা যোদ্ধাদের যোগসাজশে পালানোর পরিকল্পনা আটে দলটি। পক্ষপাতদুষ্ট রেফারিংয়ের সেই ম্যাচের বিরতিতে পালানোর কথা তাদের। ম্যাচে তারা পিছিয়ে ১-২ গোলে। কিন্তু হঠাৎই কয়েকজন সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে জোর দেয় এই বলে যে ম্যাচটা তারা জিতবে। আর্দিলেসের সেই জাদুকরী ব্যাক ফ্লিপ, ইনজুরি থেকে জোর করে ফের খেলতে নামা পেলের দুর্দান্ত এক ব্যাকভলির গোল দিয়ে ম্যাচে ফেরে মাইকেল কেইনের দল। একটি গোল অফসাইডে বাতিল হওয়ায় ম্যাচ ড্র থাকে ৪-৪ গোলে। শেষ মিনিটে রেফারি পেনাল্টি দেয় জার্মানদের। কিপার স্ট্যালোন সেভ করে ফলাফল অক্ষুন্ন রাখেন। এরপরই হয় পিচ ইনভেসন। দর্শকরা মাঠে নেমে পড়ে, আর তাদের আড়ালে পালায় ফুটবলাররা। ইপসউইচ টা্উনের ফুটবলারদের ব্যবহার করে সত্যিকার ফুটবলের আবহ আনা শটগুলোর রূপকার পেলে। স্ট্যালনকে ট্রেনিং দিয়েছেন গর্ডন ব্যাঙ্কস (’৬৬ বিশ্বকাপে পেলের নিশ্চিত এক গোল বাঁচিয়ে হিরো হয়ে গিয়েছিলেন এই ইংলিশ কিপার)।
এই ছবিটির প্রেরণা কিন্তু একটি সত্যি ঘটনা। মৃত্যুর হুমকিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে যার রূপকার ছিলেন একদল রুশ ফুটবলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ ইউক্রেনের কিয়েভে জীবনবাজি রেখে ফুটবল ম্যাচ জিতে ছিলেন তারা। ‘ডেথ ম্যাচ’ নামে খ্যাত এই কিংবদন্তীতে ম্যাচ শেষে সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলে জার্মানরা। যদিও সত্যিটা অন্যরকম। ১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করে জার্মানরা। কিয়েভের বেশীরভাগ ফুটবলারই যোগ দেন যুদ্ধে। কিয়েভ পতনের পর অবরুদ্ধ ফুটবলাররা একটি ফুটবল দল গড়েন এফসি স্টার্ট নামে। এতে ডায়নামো কিয়েভের খেলোয়াড় ৮ জন আর বাকিরা তাদের শহুরে প্রতিদ্বন্দ্বী লোকোমটিভ কিয়েভের। ১৯৪২ সালের ৭ জুন স্থানীয় লিগে অপ্রতিরোধ্য এক যাত্রা শুরু হয় স্টার্টের। ৭-২ গোলের জয় দিয়ে অভিষেক হয় কিংবদন্তীর সেই অভিযাত্রার। মূলত বিভিন্ন গ্যারিসনের জার্মান সৈন্যদের বিনোদনের সেই লিগে স্টার্টই ছিলো একমাত্র স্থানীয় দল। আর তারা জিততেই থাকে। ২১ জুন হাঙ্গেরিয়ান গ্যারিসনকে তারা হারায় ৬-২ গোলে। পরের ম্যাচে রুমানিয়ান গ্যারিসনকে দেয় গুনে গুনে ১১ গোল। একে একে ধরাশায়ী হয় মিলিটারি রেলরোড ওয়ার্কার্স টিম (৯-১), পিজিএস (৬-০), এমএসজি ওয়াল (৫-১, ৩-২), ফ্লাকেল্ফ (৫-১)। মূলত শেষ ম্যাচের পরই টনক নড়ে জার্মান হাই কমান্ডের। ঠিকমতো খেতে না পারা, অনুশীলন করতে না পারা একটা দলের কাছে এমন গো-হারা হারাটা শুধু তাদের আভিজাত্যে আঘাতই নয়, একইসঙ্গে সম্ভাব্য জাতীয়তাবাদী উন্মেষের শংকাও। ব্যাপারটা যতি টানার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
ফ্লাকেল্ফ মূলত জার্মান বিমানবাহিনীর দল। আগের ম্যাচের হারের বদলা নিতে তারা পাল্টা ম্যাচ খেলার আমন্ত্রণ দেয় স্টার্টকে। ৯ আগস্ট জেনিট স্টেডিয়ামে ঠিক হয় ম্যাচ অনুষ্ঠানের। একজন গেস্টাপো অফিসার রেফারি হিসাবে দায়িত্ব নেয়। আর স্টার্ট খেলোয়াড়দের বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই ম্যাচ না হারলে পরিণামে মৃত্যু অপেক্ষা করবে তাদের। নিয়তি বরণ করেই মাঠে নামে অকুতোভয় ফুটবলাররা। শুরুতেই তারা নাজি স্টাইলে স্যালুট দিতে অস্বীকৃতি জানায় ম্যাচে দর্শক হয়ে আসা সেনা কমান্ডারদের। যথারীতি বাজে রেফারিং এবং তুমুল ফাউলের মধ্য দিয়ে শুরু করে ফাকেল্ফ। এগিয়েও যায়। ইভান কুজমেঙ্কোর দারুণ এক ফ্রি কিকে গোল শোধায় স্টার্ট। এরপর ম্যারাডোনা স্টাইলে প্রতিপক্ষের প্রায় সব খেলোয়াড়কে কাটিয়ে দলকে এগিয়ে নেন গঞ্চারেঙ্কো। বিরতিতে ২-১, এরপর দুদলই দুটো করে গোল করে। একদম শেষ মিনিটে ওলক্সি ক্লিমেঙ্কো ঠিক গঞ্চারেঙ্কোর স্টাইলে বল নিয়ে ড্রিবল শুরু করেন। গোলকিপারকেও কাটিয়ে বল জালে পাঠানোর বদলে, ঘুরে দাড়িয়ে ফের মাঠে ফিরিয়ে দেন। জার্মানদের অপমানের ষোলকলায় জ্বালিয়ে স্টার্ট ম্যাচ জেতে ৪-৩ গোলে।
এক সপ্তাহ পর রুখের বিপক্ষে ৮-০ গোলে জেতে স্টার্ট। নরক ভেঙ্গে পড়ে তারপর। ম্যাচ শেষে খেলোয়াড়দের গ্রেফতার করে গেস্টাপো। অভিযোগ স্থানীয় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগসাজশ। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান মিকোলা করোতকিখ। বাকিদের পাঠানো হয় সিরেতস বন্দি শিবিরে। সেখানে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় ডেথ ম্যাচের দুই গোলদাতা কুজমেঙ্কো ও ক্লিমেঙ্কো এবং গোলকিপার মিকোলা ট্রুসেভিচকে। পরের বছর ১৬ নভেম্বর স্থানীয় এক পত্রিকায় ফুটবলারদের হত্যাকান্ডের খবর ছাপায়। পুরো ঘটনা প্রকাশ্যে আসে অনেক অনেক পরে। ১৯৫৮ সালে জীবিত খেলোয়াড়দের একজন পেত্রো সেভেরভ ইভনিং কিয়েভ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন লেখেন- ‘দ্য লাস্ট ডুয়েল’। পরের বছর একই নামে একটি বই বেরোয় তার নামে। পরে ঘটনাটি নিয়ে দুটো ছবি তৈরি হয়, 'থার্ড টাইম' এবং 'দ্য ম্যাচ অব ডেথ'। 'এস্কেপ টু ভিক্টরি' এই কাহিনীর প্রেরণায় চতুর্থ ছবি। অন্যটি হাঙ্গেরিতে নির্মিত। ১৯৮১ সালে এই বীর যোদ্ধাদের সম্মানে জেনিথের নাম বদলে রাখা হয় স্টার্ট স্টেডিয়াম।
শেষ কথা : ঠিক কাছাকাছি একটা ঘটনা আমাদের এই উপমহাদেশেও ঘটেছিলো, অবিভক্ত ভারতে। বুট পড়া ইংরেজ ফুটবল দলগুলোর বিপক্ষে খালি পায়ে খেলে আইএফএ শিল্ড জিতে নিয়েছিলো বাঙালীদের নিয়ে গড়া মোহনবাগান। সে গল্প না হয় আরেকদিন হবে।
ছবি: জাগো'র স্ক্রিনশটের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ফুটবল একাদশের দুটো ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
ভিডিও : ভিক্টরি ছবির ট্রেলার এবং শেষ ম্যাচটির দৃশ্য
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১:৪১