somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেখ মুজিবের নির্বাচিত বক্তৃতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতা

০৭ ই মার্চ, ২০১০ বিকাল ৪:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(আমরা আজ প্রয়োজন হইলে জীবন বিসর্জন দিব-যাহাতে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের একটি কলোনিতে বাস করিতে না হয়। যাহাতে তাহারা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে সম্মানের সহিত মুক্ত জীবন যাপন করিতে পারে, সেই প্রচেষ্টা আমরা চালাইব-
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)



আজ ৭ মার্চ। এদিন মুক্তিকামী জনতার মহাসাগরকে সামনে রেখে মহাকাব্যিক এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই বক্তৃতা নিয়ে অনেক কাটাছেড়া হয়েছে। কেউ এর শেষে কাল্পনিক পাকিস্তান জিন্দাবাদ যোগ করেও প্রমাণ করতে পারেননি। জ্বলজ্যন্ত টেপ যেখানে বর্তমান, তারপরও তারা অন্য লোকের শ্রুতিকথার ওপর নির্ভর করে। শামসুর রাহমান, হাবিবুর রহমান, হুমায়ুন আহমদকে টানে। সর্বশেষ যা দেখলাম একজন এতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদলে ধর্মহীনতার সংগ্রাম খুজে বেরানোর চেষ্টা করেছেন এবং না পেয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ৭ মার্চের ভাষণ মোটেই ধর্মহীনতার সংগ্রাম নয়। মানে উনি একটি পুকুর পারে গিয়ে ঠিক করেছেন এখানে উনি তিমি মাছ খুজবেন, এবং খুজে দেখলেন ওখানে তিমি মাছ নেই। তারপর লিখলেন যে পুকুরে তিমি মাছ থাকে না, যারা বলে তিমি মাছ থাকে তারা ঠিক বলে না। উজবুক বুদ্ধিবৃত্তিতা আর কি‍! তবে অভিসন্ধিটা কিন্তু পরিষ্কার। মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতার অন্যতম স্তম্ভ ধর্ম নিরপেক্ষতাকে আক্রমণ। পজেটিভ, নিউট্রাল ও নেগেটিভ নামে তিনটে সুইচ। নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ মানে যখন পজিটিভ নেগেটিভ কোনোটাই না, তখন যারা এর মাঝে নেগেটিভ আবিষ্কার করেন তারা গোটা ব্যাপারটাই অস্বীকার করেন। অবশ্য আওয়ামী লীগের রাজনীতির শুরু থেকেই মুজিবকে ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে পাকিস্তানীরা। তা ধরে রেখেছে তাদের উত্তরসূরী জারজরাও। এবার আসি ধর্মের রাজনীতি ও ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতামালায় কবে কি বলেছেন। এটি সেই অর্থে তার বক্তৃতার নির্বাচিত সংকলন :

১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ ৬-দফা প্রসঙ্গে তার ভাষণ :

আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা,
আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবীরূপে ৬-দফা কর্মসূচী দেশব্যাপী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করিবার পরিবর্তে কায়েমি স্বার্থবাদীদের দালালেরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছে। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও নায্য দাবী যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈচৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব পাক জনগণের মুক্তি-সনদ একুশদফা দাবিযুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবী, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্পব্যয়ে শিক্ষা লাভের দাবী, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালেরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন। ...

১৯৭০ সালের নভেম্বরে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ :


...আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য লেবেল সর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসুলে করিম (স.) এর ইসলাম। যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বরাবর যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চণার পৃষ্টপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদেরই বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান সে দেশে ইসলাম বিরোধী আইন পাশের সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেন কেবল তারাই ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফায়স্তা করে তোলার কাজে। ...

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর রেসকোর্সে ভাষণ :

সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম এবং ভারত তৃতীয়। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো বিশেষ ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

১৯৭২ সালের ৭ জুন, রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ :

বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।

১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদে (জাতীয় সংসদে) ভাষণ :


আমাদের আদর্শ পরিষ্কার। এই পরিষ্কার আদর্শের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এই আদর্শের ভিত্তিতে এই দেশ চলছে। জাতীয়তাবাদ-বাঙালী জাতীয়তাবাদ, এই বাঙালী জাতীয়তাবাদ চলবে বাংলাদেশে। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার আকাশ-বাতাস, বাঙালীর রক্ত দিয়ে গড়া বাংলার জাতীয়তাবাদ। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, জনসাধারণের ভোটের অধিকারকে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে, যেখানে শোষনহীন সমাজ থাকবে। শোষক শ্রেণী আর কোনোদিন মানুষকে শোষণ করতে পারবে না। সমাজতন্ত্র না হলে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ ৫৪ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে বাঁচতে পারবে না। সেজন্যই অর্থনীতি হবে সমাজতান্ত্রিক, আর হবে ধর্ম নিরপেক্ষতা। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে, মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে না, বাংলার মানুষ এটা চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাঘাত করবে। এ বিশ্বাস আমি করি।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে ভাষণ :

জনাব স্পিকার সাহেব, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাঁধা দেওয়া ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাঁধাদান করতে পারবে না। খ্রীস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাঁধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।

২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে।

ধর্ম অত্যন্ত পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করছি। যদি কেউ বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলবো সাড়ে সাতকোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তাহলে তা করতে হবে।

১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ভাষণ :

আর একটা জিনিস। রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে , যারা সাম্প্রদায়িক, তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন, তিনি রাব্বুল আলামিন, রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খৃষ্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, সমস্ত মানুষ তার কাছে সমান। সেজন্যই এক মুখে সোস্যালিজম ও প্রগতির কথা আরেকমুখে সাম্প্রদায়িকতা চলতে পারে না। সমাজতন্ত্র, প্রগতি আর সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না।


এরপরও যারা জল ঘোলা করতে চান, তাদের অভিসন্ধিতে খোদার লানৎ পড়ুক।



সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১০ বিকাল ৪:৩৭
৫৭টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×