somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবাকে সমাপ্তিতে শুভেচ্ছা

০২ রা জুন, ২০০৯ রাত ১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যখন থেকে স্পষ্ট করে প্রশ্নের উত্তর দিতে শিখলাম, লোকে বাবা কি করে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতাম, "ব্যাংকে চাকরি করে"। কোন ফর্ম পূরণ করবার সময় পিতার পেশা লিখতাম, "চাকুরি (ব্যাংকার)"। আজ হতে উত্তরটা অন্যরকম হবে। বলব, "বাবা ব্যাংকার ছিল, রিটায়ার্ড করেছে"।

পহেলা জুন ২০০৯ এর কথা শুনে আসছি সেই অনেক বছর ধরে। এইদিন বাবা অবসরে যাবে। সময়ের স্রোতে দিনটা এল এবং চলেও গেল। সময়ের এই প্রবাহ নিয়ে ভাবতে বসলে স্তব্ধ হয়ে যাই। প্রতিটা অক্ষর টাইপ করবার সাথে সাথে সেই অক্ষরটা টাইপ করবার জন্য অপেক্ষা শেষ হয়ে যায়। একটা একটা অক্ষরের শব্দ, অনেক গুলো শব্দের বাক্য, অনেকগুলো বাক্যের অনুচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ মিলে অধ্যায়, অনেক গুলো অধ্যায়ের সমষ্টিতে একটি জীবনী। বত্রিশ বছরের চাকরির অংশটুকু আমার বাবার জীবনের একটি অধ্যায় আর চাকরিজীবি বাবার ছেলে হিসেবে সেটা আমার জীবনেরও একটা অধ্যায়। দুজনের জীবনীর দুটি অধ্যায়েরই আজ সমাপ্তি।

জীবন নিয়ে, ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা চিন্তার শুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর দশজন ছাত্রের মতই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে খুব উজ্জীবিত ছিলাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ইতিহাসের অংশ ভাবতাম নিজেকে। "কি হব ভবিষ্যতে"- এটা নিয়ে বন্ধুরা কথাও বলতাম। বিশাল কিছু করব, এটাই ছিল স্বপ্ন। সেই বিশাল কিছু হওয়াটাও দূরের মনে
হত না। ভাবটা এমন যে, হাতের কাছেই আছে, হাত বাড়ালেই আমি হয়ে যাব অনেক বড়, অনেক ক্ষমতাবান। বন্ধুদের বলতাম, "নিজের বাপের মত পঁচিশ বছর ধরে নয়টা পাচটা চাকরি করতে পারব না"। কি ঢিলা লাইফ, সারা জীবনে সর্বোচ্চ ৬/৭ টা প্রমোশনই সম্ভব। একটা প্রমোশনের পরে লম্বা সময় বসে থাকা পরেরটার জন্য। আমাদের পেশা হবে বৈচিত্রময় কিছু, অনেক অনেক গতিশীল, আধুনিক। অনেকেই সায় দিত। সময়ের সাথে এক, দুই, তিন করে চার বছরের অনার্স শেষ করে ফেললাম। বাস্তবতা যখন দরজার কড়া নাড়ল, তখনই ছাত্রজীবনের অপরিপক্কতা উদ্বায়ী হয়ে গেল। বুঝে গেলাম, বাবা তার জীবনে যতটুকু উঠেছে ততটুকু হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় না। সংগ্রাম করে পেতে হয়।


পেছনের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে উঠে, এতদিন ধরে অদেখা কিছু দৈনন্দিন ঘটনা। তার বত্রিশ বছরের চাকরির অন্তত ২২ টা বছর আমি দেখেছি। বাবাকে আমি কখনই নয়টার পরে অফিস পৌছতে দেখি নি। বত্রিশ বছরেরর ছুটির দিন বাদে অনান্য প্রতিটি দিন। আমার জীবনে এ যাবৎ দেখা নিজ কাজের প্রতি সবচাইতে নিষ্ঠাবান আমার বাবা। কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা। বাবা তখন অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকার একটি জোনের প্রধান। ব্যাংকে জুন ও ডিসেম্বর মাসে ক্লোজিং হয়। জোনের বিভিন্ন শাখায় শাখায় বাবা খোঁজ খবর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদেরই সামনের বিল্ডিংএ বাবারই সাবেক বস থাকত। উনি তখন অবসর প্রাপ্ত। আন্টির সাথে কথা বলতে, মা মাঝে মাঝে তাদের বাসায় যায়। একবার কোন এক জুন মাসে, রাত নয়টা বাজে বাবা তখনও অফিসে। লোকটা তুচ্ছার্থে বাবার সম্পর্কে বলছিল, "আপনার জামাই ব্যাংকরে বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে। তাই মনে করে আগলিয়ে রাখে। আরে ক্লোজিংএ ব্রাঞ্চের ম্যানেজাররা কাজ করবে, জোনাল হেডের অহেতুক খোজ খবরের জন্য দৌড়া দৌড়ির কী মানে হয়"। সেই ব্যক্তি তুচ্ছার্থে বললেও, আমি আমার বাবার জন্য গর্ব বোধ করি। সে সত্যিই তার কর্মস্থলকে নিজের বাপদাদার সম্পতির মতই আগলে রাখার মানসিকতা রাখে।

একবার খালার সাথে অগ্রণী ব্যাংকের এক শাখায় গিয়েছিলাম। অফিসে গিয়ে দেখি ম্যানেজার তার চেয়ারে এমন ভাবে বসে আছে যে, অন্য কেউ দেখলে ভাববে লোকটা হয় শুয়ে আছে বা ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে পিছলে যাচ্ছে। পান চিবাতে চিবাতে কথা বলছে। খালার একটা ড্রাফট নিয়ে আসবার জন্য অনেক চিল্লাচিল্লি করছে অথচ ব্যাংকের কর্মচারীরা তার কথার পাত্তা দিচ্ছে না। একই শাখায় বাবাও ম্যানেজার ছিল কয়েকবছর আগে। দুইজনকে মিলিয়ে দেখলাম। আমার বাবা সব সময় চেয়ারে সোজা হয়ে বসত, তার অধঃস্তন কর্মচারীরা সব সময় তটস্থ থাকত স্যারের।

সেই বাবাই কাল হতে আর সকাল নয়টার মাঝে অফিসে পৌছবে না। বাসায় ফিরে রাতের বেলা ফোনে অফিসারদের সাথে অফিসিয়াল ব্যাপারে কথা বলবে না। ঘটনাগুলো স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছি না। বাবাকে এভাবে আমি দেখতে চাই না, দেখতে অভ্যস্ত নই। কয়েকদিন ধরেই নানা লোককে বলে যাচ্ছি, আমার জীবনটাকে এমন ভাবে চালাব যেন কখনও অবসর নিতে না হয়। জানি না, হয়ত এইদিন আমারও একদিন এসে যাবে। অনেক ভেবে চিন্তে আজ বুঝতে পারলাম, "আমি আমার বাবার মতই হতে চাই"। অবশ্য আমি আমার কাজ যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথেই করি। গুনটা আমার নিজের না, অনেক বছর ধরে বাবাকে দেখতে দেখতেই পাওয়া।


বাবার শেষ অফিসের দিনটা নিয়ে কিছুদিন ধরেই মনে মনে প্লান করছিলাম। কিছুই করা হয়ে উঠল না। বাবার সাথে কিছু কথা বলার ইচ্ছে ছিল, বলতে পারলাম না। রাতে বাবা যখন ফিরল, মনটা ছলছল করছিল আমার। কিন্তু বাবার সামনে কিছুই প্রকাশ করতে পারলাম না। স্বাভাবিক ভাবই দেখালাম, অন্যদশটা দিনের মত। ছেলেরা বোধ হয় বাবার সামনে আবেগ প্রকাশ করতে পারে না।


তার এই অধ্যায়ের শুভ সমাপ্তিতে শুভেচ্ছা সহ বলতে চাই, "আমি তোমার মতই হতে চাই"।
২৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×