যখন থেকে স্পষ্ট করে প্রশ্নের উত্তর দিতে শিখলাম, লোকে বাবা কি করে প্রশ্ন করলে উত্তর দিতাম, "ব্যাংকে চাকরি করে"। কোন ফর্ম পূরণ করবার সময় পিতার পেশা লিখতাম, "চাকুরি (ব্যাংকার)"। আজ হতে উত্তরটা অন্যরকম হবে। বলব, "বাবা ব্যাংকার ছিল, রিটায়ার্ড করেছে"।
পহেলা জুন ২০০৯ এর কথা শুনে আসছি সেই অনেক বছর ধরে। এইদিন বাবা অবসরে যাবে। সময়ের স্রোতে দিনটা এল এবং চলেও গেল। সময়ের এই প্রবাহ নিয়ে ভাবতে বসলে স্তব্ধ হয়ে যাই। প্রতিটা অক্ষর টাইপ করবার সাথে সাথে সেই অক্ষরটা টাইপ করবার জন্য অপেক্ষা শেষ হয়ে যায়। একটা একটা অক্ষরের শব্দ, অনেক গুলো শব্দের বাক্য, অনেকগুলো বাক্যের অনুচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ মিলে অধ্যায়, অনেক গুলো অধ্যায়ের সমষ্টিতে একটি জীবনী। বত্রিশ বছরের চাকরির অংশটুকু আমার বাবার জীবনের একটি অধ্যায় আর চাকরিজীবি বাবার ছেলে হিসেবে সেটা আমার জীবনেরও একটা অধ্যায়। দুজনের জীবনীর দুটি অধ্যায়েরই আজ সমাপ্তি।
জীবন নিয়ে, ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা চিন্তার শুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর দশজন ছাত্রের মতই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে খুব উজ্জীবিত ছিলাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ইতিহাসের অংশ ভাবতাম নিজেকে। "কি হব ভবিষ্যতে"- এটা নিয়ে বন্ধুরা কথাও বলতাম। বিশাল কিছু করব, এটাই ছিল স্বপ্ন। সেই বিশাল কিছু হওয়াটাও দূরের মনে
হত না। ভাবটা এমন যে, হাতের কাছেই আছে, হাত বাড়ালেই আমি হয়ে যাব অনেক বড়, অনেক ক্ষমতাবান। বন্ধুদের বলতাম, "নিজের বাপের মত পঁচিশ বছর ধরে নয়টা পাচটা চাকরি করতে পারব না"। কি ঢিলা লাইফ, সারা জীবনে সর্বোচ্চ ৬/৭ টা প্রমোশনই সম্ভব। একটা প্রমোশনের পরে লম্বা সময় বসে থাকা পরেরটার জন্য। আমাদের পেশা হবে বৈচিত্রময় কিছু, অনেক অনেক গতিশীল, আধুনিক। অনেকেই সায় দিত। সময়ের সাথে এক, দুই, তিন করে চার বছরের অনার্স শেষ করে ফেললাম। বাস্তবতা যখন দরজার কড়া নাড়ল, তখনই ছাত্রজীবনের অপরিপক্কতা উদ্বায়ী হয়ে গেল। বুঝে গেলাম, বাবা তার জীবনে যতটুকু উঠেছে ততটুকু হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় না। সংগ্রাম করে পেতে হয়।
পেছনের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে উঠে, এতদিন ধরে অদেখা কিছু দৈনন্দিন ঘটনা। তার বত্রিশ বছরের চাকরির অন্তত ২২ টা বছর আমি দেখেছি। বাবাকে আমি কখনই নয়টার পরে অফিস পৌছতে দেখি নি। বত্রিশ বছরেরর ছুটির দিন বাদে অনান্য প্রতিটি দিন। আমার জীবনে এ যাবৎ দেখা নিজ কাজের প্রতি সবচাইতে নিষ্ঠাবান আমার বাবা। কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা। বাবা তখন অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকার একটি জোনের প্রধান। ব্যাংকে জুন ও ডিসেম্বর মাসে ক্লোজিং হয়। জোনের বিভিন্ন শাখায় শাখায় বাবা খোঁজ খবর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদেরই সামনের বিল্ডিংএ বাবারই সাবেক বস থাকত। উনি তখন অবসর প্রাপ্ত। আন্টির সাথে কথা বলতে, মা মাঝে মাঝে তাদের বাসায় যায়। একবার কোন এক জুন মাসে, রাত নয়টা বাজে বাবা তখনও অফিসে। লোকটা তুচ্ছার্থে বাবার সম্পর্কে বলছিল, "আপনার জামাই ব্যাংকরে বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে। তাই মনে করে আগলিয়ে রাখে। আরে ক্লোজিংএ ব্রাঞ্চের ম্যানেজাররা কাজ করবে, জোনাল হেডের অহেতুক খোজ খবরের জন্য দৌড়া দৌড়ির কী মানে হয়"। সেই ব্যক্তি তুচ্ছার্থে বললেও, আমি আমার বাবার জন্য গর্ব বোধ করি। সে সত্যিই তার কর্মস্থলকে নিজের বাপদাদার সম্পতির মতই আগলে রাখার মানসিকতা রাখে।
একবার খালার সাথে অগ্রণী ব্যাংকের এক শাখায় গিয়েছিলাম। অফিসে গিয়ে দেখি ম্যানেজার তার চেয়ারে এমন ভাবে বসে আছে যে, অন্য কেউ দেখলে ভাববে লোকটা হয় শুয়ে আছে বা ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে পিছলে যাচ্ছে। পান চিবাতে চিবাতে কথা বলছে। খালার একটা ড্রাফট নিয়ে আসবার জন্য অনেক চিল্লাচিল্লি করছে অথচ ব্যাংকের কর্মচারীরা তার কথার পাত্তা দিচ্ছে না। একই শাখায় বাবাও ম্যানেজার ছিল কয়েকবছর আগে। দুইজনকে মিলিয়ে দেখলাম। আমার বাবা সব সময় চেয়ারে সোজা হয়ে বসত, তার অধঃস্তন কর্মচারীরা সব সময় তটস্থ থাকত স্যারের।
সেই বাবাই কাল হতে আর সকাল নয়টার মাঝে অফিসে পৌছবে না। বাসায় ফিরে রাতের বেলা ফোনে অফিসারদের সাথে অফিসিয়াল ব্যাপারে কথা বলবে না। ঘটনাগুলো স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছি না। বাবাকে এভাবে আমি দেখতে চাই না, দেখতে অভ্যস্ত নই। কয়েকদিন ধরেই নানা লোককে বলে যাচ্ছি, আমার জীবনটাকে এমন ভাবে চালাব যেন কখনও অবসর নিতে না হয়। জানি না, হয়ত এইদিন আমারও একদিন এসে যাবে। অনেক ভেবে চিন্তে আজ বুঝতে পারলাম, "আমি আমার বাবার মতই হতে চাই"। অবশ্য আমি আমার কাজ যথেষ্ট নিষ্ঠার সাথেই করি। গুনটা আমার নিজের না, অনেক বছর ধরে বাবাকে দেখতে দেখতেই পাওয়া।
বাবার শেষ অফিসের দিনটা নিয়ে কিছুদিন ধরেই মনে মনে প্লান করছিলাম। কিছুই করা হয়ে উঠল না। বাবার সাথে কিছু কথা বলার ইচ্ছে ছিল, বলতে পারলাম না। রাতে বাবা যখন ফিরল, মনটা ছলছল করছিল আমার। কিন্তু বাবার সামনে কিছুই প্রকাশ করতে পারলাম না। স্বাভাবিক ভাবই দেখালাম, অন্যদশটা দিনের মত। ছেলেরা বোধ হয় বাবার সামনে আবেগ প্রকাশ করতে পারে না।
তার এই অধ্যায়ের শুভ সমাপ্তিতে শুভেচ্ছা সহ বলতে চাই, "আমি তোমার মতই হতে চাই"।