প্রথমে বলে নিতে হয় এই বইটি আমার কাছে দারুন লেগেছে। আহমদ ছফার অনেক গুলো বই সংগ্রহে রেখেছি কিন্তু পড়িনি । কেন সেটা জানি না । তবে নিজেকে সময় দিয়ে পড়তে ভালো লাগে । সে যাইহোক, আম এমন একটা সময় তার লেখা পড়েছি যখন আমার নিজের জীবনের প্রতি কিছুটা হলেও হতাশা ও বিরক্তিকর মুহূর্তে মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে “ গাভী বিত্তান্ত ” যেন আমার সব কিছু নতুন ভাবে শুরু করার এক মুহূর্ত নিয়ে এল । অনেক দিন বই পড়তে পারছিলাম না । এমন কিছু যেন দরকার ছিল আর সেটাই হলো ।
“গাভী বিত্তান্ত” বইটি যদি কিছুটা স্যাটায়ার ও সারকাজম এ লেখা । কিন্তু সেটা প্রঙ্গগত ভাবে একদম ঠিক। কারণ বইটি যে বিষয়টির উপর ভিত্তি করে লেখা তা থেকেই বোঝা যায় যে কতটা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর ভিতর থাকা মানুষ গুলো নিজেদের মধ্যেই প্রতিহিংসা ও দলাদলিতে লিপ্ত থাকেন । কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে না । তার কাজ ঠিক সময়ের উপর দিয়ে চলে যায় । যেন সব আগে থেকেই ঠিক করা ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কিছু ঘটনা, কিছু মানুষের দ্বি-মুখী আচরণের মাধ্যমে পুরো সমাজকে ব্যাঙ্গ করেছেন ছফা এই উপন্যাসে। সাধারণ কিছু স্যাটায়ার আছে। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, তার রাজনীতি আর মানুষগুলোর দ্বিচারিতা যেন সামনে চলে আসলো। আমরা ছাত্রদেরগুলো দেখতে পাই, প্রশাসনিক বা শিক্ষকদের গুলো হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হয় না, এখানে সেগুলো সামনে আনা হলো।দুর্দান্ত স্যাটেয়ার! ছফা এদেশের পাবলিক বিশববিদযালয়ের অনদরমহলের খবর তুলে ধরেছেন কোনরকম রাখঢাক ছাড়াই। উনার সেন্স অব হিউমার অতুলনীয়! ১৯৯৫ সালে লেখা হলেও দুঃখজনকভাবে এখনো সমান প্রাসঙ্গিক।
যেমন ধরুন " সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের ছেলে মেয়েরা সদল বলে মিছিল করে এসে উপাচার্যের দপ্তরের দরজা জানালা ভাঙাচুর করেছে । তাদের দাবি ছিল একটাই, কেন তাদের পরীক্ষা বারবার পিছানো হচ্ছে । ভাঙা দরজা জানালা নতুন করে মেরামত করার পর সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে মেরামত করা দরজা জানালা আবার নতুন করে ভেঙে দিয়ে গেছে । "
আবার অন্যদিকে " তিরিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে এক হাজার কবি, সংখ্যাটা কিছুতেই অধিক বলা যাবে না । বাঙালি মাত্রই কবি । "
দেশের সেরা ও প্রাচীণতম বিশ্ববিদ্যালয়টির জ্ঞানতাপস শিক্ষকদের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, স্বার্থপরতার নোংরা বলয়ের বাইরে স্রেফ নিস্ক্রিয় জীবনযাপনকারী একজন শিক্ষক রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ। খুবই সাধারণ তার জীবনযাত্রা, তার চিন্তা বা স্বপ্ন। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি আর অতিরাজনীতির ঘেরাটোপে একপ্রকার হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন তিনি; এই উপাচার্যের পদে আসীন হওয়াটাই তার নিজস্ব জীবন যাপন এবং দৃষ্টি ভঙ্গীতে নিয়ে আসে এক আমূল পরিবর্তন।
পারিবারিক, সামাজিক বা পেশাগত বিভিন্ন সমস্যা নিরসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিং মিছিল দুর্ঘটনা, নিজ দলীয় সহকর্মীদের অসন্তুষ্টি সামলে উঠতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, ক্ষমতা লাভের চেয়ে বরং তার সদ্ব্যবহার করা সত্যিই কঠিন। কখনো কখনো তিনি বেশ হাপিয়ে ওঠেন।
তার চারপাশে গজিয়ে উঠতে থাকে সুবিধা শুষে নেবার মত ধুরন্ধর লোকেরা; পারিবারিক জীবনে চরমভবে অসুখী হয়ে উঠতে থাকেন তিনি, এক পর্যায়ে ভিসির বাংলোতে একটা দুর্দান্ত গোয়ালঘর বানিয়ে একটা দুর্লভ জাতের গাভী কিনে পুষতে শুরু করেন। অবলা প্রানীটাই বরং ভালো, কোন দাবী দাওয়া নেই, ষড়যন্ত্র নেই বা মাথা ধরানো হই চই নেই। এক পর্যায়ে শান্ত সমাহিত এই প্রাকৃতিক পরিবেশটিই হয়ে দাঁড়ায় তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ কিংবা শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতির কাজও পরিচালিত হতে থাকে সেই গোয়ালঘর থেকে। এর শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় ?
বিশ্ববিদ্যালয় কে তিনি তুলনা করেছেন আত্মার সঙ্গে । শতাব্দীর প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টির সব কিছুই আছে । ইট-পাথর আর কারুকার্যের কাজ ও ঐতিহ্য গুলো কে বহন করে চলেছে । যেন কোন এক ইতিহাসের সাক্ষীরা আজ ও বলে চলেছে কি হবে আমাদের? আদৌ কি আমরা পেরেছি?
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:০৩