এক
একাত্তরের এপ্রিলের কোন এক দুপুরে এক ২১ বছরের তরুণ ভয়ে ভয়ে বাবার সামনে যেয়ে তুলল কথাটা
- যুদ্ধে যাচ্ছি
রাশভারী সরকারি অফিসার বাবার ততোধিক রাশভারী উত্তর
- যাবি যা, তবে দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না!
বাবাকে সালাম করে ২১ বছরের তারছিরা তরুণ পায়ে হেটে রওনা হল আগরতলা। এবার দেশ কে স্বাধীন করতে হবে। এযে বাবার আদেশ। তার আদেশ অমান্য করা যাবে না। সত্যি সত্যি লোকটি দেশ স্বাধানী হবার পরই বাড়ি ফিরেছিলেন।
দুই
১৯৭২ সাল। তখন লাকী আখন্দ ও হ্যাপী আখন্দ দুজনেই দেশব্যাপী সঙ্গীত জগতে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তাদের গান মানুষের মুখে মুখে। যেন তাদের হাত ধরেই নতুন বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের বিস্তার ঘটছে।
তখন ই লোকটা আবার এল। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটার, সাদেক কে ড্রাম এবং নিজে প্রধান ভোকাল হিসেবে রইল। বিটিভির এক অনুষ্ঠানে গাইলেন দুটি গান
“ হে আল্লাহ, হে আল্লাহ রে
এতো সুন্দর দুনিয়ায়
কিছুই রবে না গো
হে আল্লাহ, হে আল্লাহ রে।”
ও
“ চার কালেমা সাক্ষী দেবে”
এই গান দুটি এনে দিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তবে তার যে গানটি তাকে জনপ্রিতার শীর্ষে এনে দিয়েছে সেটি হলো,
“ রেললাইনের ঐ বস্তিতে
জন্মেছিল একটি ছেলে
মা তার কাঁদে
ছেলেটি মরে গেছে।
হায়রে হায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ ”
এরপর থেকেই শুরু হলো এক নব জাগরন। ধীরে ধীরে পপ গানের শুরু হয়। বাংলাদেশের সঙ্গীতে যেন এক নতুন ধারা যুক্ত হয়ে যায়।
তিন
জন্ম ১৯৫০ সালে । বাবা সরকারী চাকরীজিবী হওয়াতে থাকতেন সরকারী কোয়ার্টারে। প্রথমে ঢাকেশ্বরী এবং পরে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে লেখা পড়া করেন। ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। এর পরের বছর মানে ১৯৬৯ সালে গনঅভ্যুত্থানের সময় শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
তিনি তখন ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠির সক্রিয় সদস্য। তাদের হয় শাসকদের শোষনের বিরুদ্ধে গনসঙ্গীত প্রচার করেন। এরপর ১৯৭১ এ বাবার কাছে গিয়ে বলেন যুদ্ধে যাবে। বাবা তাকে দেশ স্বাধীন না করে যেন বাড়ি ফিরে আসেন সেটা বলে দেন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর সত্যি দেশ স্বাধীন করে ফিরে আসেন। এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে।
চার
যে মানুষটির কথা বলিছি তিনি আর কেউ নন পপ গুরু আজম খান। তার পুরো নাম হচ্ছে মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। তবে তাকে সবাই পপ গুরু নামেই বেশি চেনে। তার গান গেয়ে অনেক ছোট বেলা কেটেছে। “ওরে সালেকা ওরে মালেকা’’ এই গান গেয়ে আমি অনেক লাফাতাম। এছাড়া “আলাল ও দুলাল” এটাও ছিল। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গীতে এক নতুন ধারা নিয়ে আসেন।
পাচ
আজম খানের ক্যান্সার ধরা পরে। তিনি হোটেল পূর্বানীতে যেই ব্যান্ড সঙ্গীত শুরু করেছিলেন। যা আজ আমাদের গর্ব। কিন্তু আমরা মানুষটাকে কতটুকু দিয়েছি। কতটা সম্মান দিয়েছি। ক্যান্সারের পর যখন টাকার অভাবে চিকিতসা অসম্পূর্ন রেখেই যিনি সিংগাপুর থেকে চলে এসেছেন।
যিনি কারো কাছে হাত পাতেননি। অভিমান করে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টাও দেননি। তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে কত কিছুই হয়েছে। অথচ সে অসুস্থ থাকা অবস্থা তার খোজ কতজনই বা রেখেছে।
হ্যা, সেই মানুষটার আজ ২০১১ সালের ৫ জুন মানে আজকের এই দিনে পৃথিবী ছেড়ে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
সেই চির তরুন ক্র্যাক হেডেড এক ছেলে যে গিটার হাতে বাংলাদেশ কে এক নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
সালাম তোমায় গুরু।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১১:১১