somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবিতা এবং বোধের ব্যাপ্তি

০৬ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"Poetry is when an emotion has found its thought and the thought has found words." -- Robert Frost.
কবিতা নিয়ে নিরন্তর ভাবনার ফল অবিরতভাবে সেই আদি প্রশ্নে ফিরে যাওয়া , কবিতা আসলে কোন রূপ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় যা আমাদের বোধের জগতকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যায় ? কবিতা উপস্থাপনের হয়তো বিভিন্ন ধারা আছে । আমাদের কাছে তা কি রূপে প্রতিভাত হয়? নন্দনের দিকটা অনেকাংশেই অন্ধ । আমরা মোটাদাগে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারি না অনুভবের ব্যাপকতার কারনে । আর এই ব্যাপকতা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে , সাম্প্রতিককালে কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ মোটামুটি গুরুতর । সিম্বলিস্ট মালার্মে তো ঘোষণাই দিয়েছেন , কবিতা শুধুমাত্র সেই পাঠকের জন্য যার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আছে । ' রহস্যতা ও দুর্বোধ্যতা সাধারণের অলস ঔৎসুক্য থেকে কবিতাকে রক্ষা করে ।' বস্তুত মালার্মে কবিতাকে নিয়ে গেছেন এক কঠোর উচ্চতায় যেখানে সাধারনের বোধগম্যতা অনেকাংশেই অচল । কঠোর বলছি এজন্য যে , মালার্মে যেহেতু প্রতীকবাদী ছিলেন , তাই স্বভাবতই তিনি চাইবেন কবিতার লাইন ,তার প্রতিটি রূপকল্পকে সিম্বলে পরিণত করতে । শিল্পের অন্যান্য শাখার মত কবিতার রূপও সর্বদাই এক রকম থাকে নি । নতুন চিন্তা , নতুন নিরীক্ষা কবিতাকে দিয়েছে ভিন্ন রূপ । এছাড়া নানান দার্শনিক ভাবনা দ্বারাও কবিতা কম প্রভাবিত হয় নি ।
মানব মনের যে বিভিন্ন রূপ - অবচেতন , অর্ধচেতন এবং সচেতন( ইদ , ইগো এবং সুপার ইগো ) সবগুলোই কব্যরস দিয়ে তাড়িত হয় । কোন কবি যেমন শুধু একটি লাইন দিয়েই অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারেন পাঠকের মনে ,আবার বিপুল কাব্যরচনাও কোন কবিকে কোন এক সীমাবদ্ধতায় আটকে ফেলতে পারে । কবি বিনয় মজুমদারের অতি পরিচিত একটি কবিতার কিছু লাইন -
' সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কতো বেশি বিপদসংকুল
তারও বেশি বিপদের নিলীমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ
এ সত্য জেনেও - তবুও আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হতে চাই , চিরকাল হতে অভিলাষী ।
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভাল লাগে বলে ।
তবুও কেন যে আজো , হায় হাসি ,হায় দেবদারু
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায় । ' (ফিরে এসো চাকা )
এই যে ' মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায় ' , অন্যান্য লাইন এবং রূপকল্পকে ছাড়িয়ে এটিই মনে গেঁথে যায় । এটি অন্তর্নিহিত একটা শক্তি যা আঘাত করে , অথচ কোমলরূপে । হয়তো চোখ বুলিয়ে যাই অজস্র লাইনের উপর অথবা প্রায়শই পাঠ করি প্রিয় কবিতাগুলো । মনের কোন এক গহীন কোণে জমা থাকে একান্ত নিজস্ব কিছু লাইন । সৌন্দর্য কিংবা নন্দন যাই নলি না কেন অনুভবের যে ভিন্নতা ,নানা রূপ তা তো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয় । কবিতার নিজস্ব কোন দায়বোধ নেই প্রচলিত অর্থে অর্থমন্ডিত হওয়ার , এমনকি প্রতিকীও নয় ,যতটা দায় আছে দ্যোতনার মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়ার । আসলেই তো তাই । আমি যদি পুরোপুরি একটি কবিতার ভেতর বাহির , তার যাবতীয় রূপ সব ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হই তাহলে পারতপক্ষে কি আমার চিন্তার জগতকে আলোড়িত করার জন্য অবশিষ্ট কিছু থাকে ? হুমায়ুন আজাদ বলেছেন , ‘ যদি কেউ দাবি করে কোন কবিতা পড়ে সে বুঝতে পেরেছে এবং তার বুঝতে পারার সাথে অন্যরা একমত হচ্ছে , ধরে নিতে হবে কবিতাটি ব্যর্থ ।’ তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায় , কবিতার উৎকৃষ্টতা পরিমাপের যে মানদণ্ড দিয়ে বিদগ্ধ সমালোচকগণ পাঠ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তা আসলে কিরূপ ? এবং এই ব্যাখ্যার যে নানা পদ্ধতি ,সেগুলোই বা কেন ? সৌন্দর্য অনুভবের বিষয়টি নিয়ে টানাপোড়ন দীর্ঘকালের আলচনার বস্তু । মানসিক যে অভিজ্ঞতা আমরা কবিতার মাধ্যমে অর্জন করি , তা আমাদের বোধকে নিয়ে যায় চেতনার নতুন এক স্তরে । সম্ভবত এজন্যই নন্দনতাত্ত্বিকেরা নন্দনকে জগতের আর সব কার্যকলাপ থেকে আলাদা ভেবেছেন । বাস্তবিক বোধের সাথে অবশ্যই একান্ত অনুভবের বোধগুলো খাপ খায় না । এখন তাহলে প্রশ্ন এসে যায় , কবিতা কি তাহলে মোটেই বাস্তবতা ধারন করে না ? এটি কি সর্বদাই বাস্তবের সাথে এক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে ? বাস্তবতা তথা জাগতিক জীবনের নানা উপাদান কবিতায় আসতে পারে , তবে তা সম্পূর্ণতায় নয় । যা আসে তাও অনুভবের মাত্রাকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার জন্য । কবিতা তার কোন বিশেষ অংশ নয় , বরং সমগ্রতা দিয়েই ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে । অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে কবিতা যা নিয়ে ক্রমিক উচ্চতায় উঠে আসে , তা হল রূপ । প্রথাগত অর্থে অসত্য কিছু কবিতায় স্থান পেলেও , কবিতায় অসুন্দর বলে কিছু নেই । এমনকি ধ্রুব সুন্দরতার যে ধারনা , আদর্শগত স্থির যে নান্দনিক বিচার , তাকেও বাতিল করে দিতে পারে কবিতা । জীবনের সুখকর বা বিষাদের অনুভূতিই শুধু নয় , কবিতা ধারন করতে পারে আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারন , গৌণ উপাদানও । আমার মতে শিল্পীর দায় শুধুমাত্র শিল্পের প্রতি । কবি যখন কবিতা লেখেন , তখন তিনি সমাজের কোন দায়বদ্ধ মানুষ কিংবা রাষ্ট্রের দায়িত্ববান নাগরিক নন । দায়বদ্ধতা আছে , তবে তা পুরোটাই তার কবিতার প্রতি । হ্যাঁ ,প্রতিবাদের ভাষা কবিতা ধারণ করতে পারে যদি তা হয় স্বতস্ফূর্ত । কবিতায় জোরপূর্বক কিছু আরোপ পুরো কবিতার শিল্পমানই নষ্ট করে দিতে পারে । জীবনের সংকট , পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা , বিপন্নতা সবই আসতে পারে , তবে তা পুরোপুরি মন থেকে উৎসারিত । কোনভাবেই আরোপিত নয় । অন্তরের সর্বাপেক্ষা গোপন অথচ গভীরের কুঠুরি থেকে কবিতার উৎপত্তি । তাই এর ভবিষ্যতও বিশাল । বাস্তবের অনুপুস্থিতি এখানে হাজির হয় নিজস্ব সিম্ফোনি নিয়ে । কবি আসলে কি করেন ? তার চিন্তাকে ভাষার রূপ দিয়ে একটা ক্ষেত্র তৈরি করেন । কবিতার পুরো ব্যাপ্তি সম্পর্কে পাঠক অপেক্ষা তার অজ্ঞানতা কম নয় । দুয়ার খুলে দেন কবি । আগ্রহভরে তিনি এবং পাঠক উভয়ই ওপাশের জগতের দিকে ধাবিত হন ।
‘ কবিতার যে মুহূর্তসৌন্দর্য তাতে আমরা অবগাহন করি । কিন্তু এর ব্যাখ্যা নিয়ে মাথা ঘামাই না । অজাতশত্রু একবার বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন , আপনি নির্বাণের যে মার্গর কথা বলেছেন তার উৎস কি ? বুদ্ধ উত্তর দিলেন , আমার অনুভব । কবিতার নন্দনের সূত্রও নিহিত আছে এই অনুভবে । বাগানের ভেতর সারাদিন থেকেও কোন উদ্ভিদবিজ্ঞানী হয়তো পান না ফুলের অজানা সৌন্দর্য ও গন্ধ ।কারণ , তিনি যে অজানা ফুলের নাম নিয়েই ব্যস্ত থাকেন । কিন্তু মালাকার নিমিষেই মুগ্ধ হয়ে পড়েন ফুলের এক এক গন্ধে । বোর্হেসের মত আমরাও বিশ্বাস করি , কবিতা অনুভবে । শিক্ষা দেওয়াতে নয় । নান্দনিক জিনিসের ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দেওয়ার প্রয়োজন নেই । অনুভব দিয়েই তার প্রাপ্তি ঘোচে । ’( কবিতার অন্ধনন্দন , কুমার চক্রবর্তী)
বর্তমানে কবিতা ছাড়িয়ে গেছে তার কালিক এবং ভাষিক সমস্ত ব্যাকরণকে । নিয়ম দিয়ে কবিতার জগতকে সীমাবদ্ধ করার পুরনো সব রীতিকে অতিক্রম করে গেছেন আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক অধিকাংশ কবিরাই । শব্দগুচ্ছ নিয়ে কবিতা নিজেই একটা শিল্পশরীর । ভাষা শুধু প্রতীকের কাজ করে । এটা এক কথায় অবধারিত ছিল । নানা চিন্তা ,নানা দর্শন দ্বারা প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ হয় মানবমন । কবিতা ক্রমেই হয়ে ওঠে সার্বিক এক প্রকাশ মাধ্যম । বৈচিত্র তথা নতুনত্ব দিয়ে আমরা আমাদের বোধের জায়গা এবং কবিতা দুটোকেই নিয়ে যেতে পারি অন্য এক নান্দনিক উচ্চতায় ।



৮টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×