১.
“জিহান তুমি দাঁড়াও।” পান্না মিস ক্লাসে এসেই গম্ভীর স্বরে বলল।
এনা জানে এখন কি কি হবে। পান্না মিস জিহানকে দিয়ে প্যাসেজটা পড়াবে। পড়া শেষে প্রশ্নগুলো বুঝিয়ে দিবে। উত্তর বাসা থেকে লিখে আনতে হবে। এরপর আরেকজনকে দাঁড় করবে। একই ঘটনা আবার ঘটবে। প্রতিটা ক্লাসে তিনটা করে প্যাসেজ পড়তে হয়।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো এনা। জানালার পাশের এই সিটটা ওর সবচেয়ে পছন্দের। ক্লাস ফোরের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটা দিন এই সিটেই বসে এসেছে। ক্লাস ফাইভে উঠলে এরকম চমৎকার একটা সিট পাওয়া যাবে না। ফাইভের ক্লাসের একটিমাত্র জানালা দিয়ে দেড়হাত দূরের দেয়াল ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না। আকাশও না।
এনা মাঝেমধ্যে ভাবে ফেল করে আরেকবার ক্লাস ফোরেই থেকে যাবে কিনা। কিন্তু ও জানে, চাইলেও ফেল করতে পারবে না। ওর আম্মুই ওকে পাশ করিয়ে নিয়ে যাবে। শুধু পাশ করাবে না, প্লেসও করাবে। এনার মনে হয় পড়াশোনা ও নিজে করে না, ওর আম্মু করে।
জানালার সামনেই রাস্তা। ছোট্ট রাস্তা, কিন্তু গাড়ি আর রিকশার অভাব নেই। ওদের স্কুলভ্যানগুলো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। রাস্তার ওপাশে কচুক্ষেত। কচু কি চাষ করে নাকি এম্নি এম্নি হয়ে আছে এনা জানে না। কিন্তু স্কুলের শুরু থেকেই ওখানে শুধু কচু আর কচু দেখে আসছে। হাতে ছোট্ট একটা কলাগাছ নিয়ে একটা লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এনা অল্প যে কয়টা গাছ চেনে তার মধ্যে কলাগাছ একটা। ও অবাক হয়ে দেখল লোকটা কলাগাছটা কচুক্ষেতের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গেল। একটু দাঁড়ালো-ও না লোকটা। কলাগাছটা কাত হয়ে পড়ে আছে কচুক্ষেতের কাঁদা কাঁদা মাটির উপরে।
“এনা, এই এনা!”
চিৎকার শুনে এনা মিসের দিকে তাকাল।
“বাইরে কি?” ঝাঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ম্যাম।
“কিছু না মিস।”
“দাঁড়াও, সেকেন্ড প্যাসেজটা পড়ো।”
২.
স্কুল শেষে সবাই বের হয়ে স্কুলভ্যানে ঢুকে বসল, অনেকটা মুরগির ছানার মতো। আর যাদের আব্বু বা আম্মু এসেছে ওরা তাদের কোলে উঠার জন্য লাফালাফি করতে লাগল, অনেকটা ছাগলের ছানার মত। এনা ভ্যানে উঠতে যাবে এমনসময় ওর চোখ গেল কচুক্ষেতের দিকে। কলাগাছটা এখনো ওখানেই পড়ে আছে। গাছটার গোড়ায় অনেকখানি মাটি লেগে আছে। কিছু না ভেবেই এনা কচুক্ষেতের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো। গাছটা বেশি দূরে না, কিন্তু তুলতে গিয়ে জুতোয় আর হাতে কাঁদা লেগে গেল।
কলাগাছটা নিয়ে ভ্যানের সিঁড়িতে মাত্র পা দিয়েছে তখনি ভেতর থেকে ওর ফ্রেন্ডরা চেচামেচি শুরু করে দিল।
জনি বলল, “ছিহ! ছিহ! ময়লা, ফেল ফেল!”
ডালিয়া কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, “এনা প্লিজ এটা নিয়ে উঠিস না, আমার জামায় ডার্টি লেগে যাবে, প্লিজ।”
সনি মেয়েটাতো মুখ বাঁকিয়ে বলেই ফেললো, “আস্ত ক্ষ্যাত একটা।”
ওরা মুখে যা-ই বলুক, অন্তত ওকে ভ্যান থেকে নামিয়ে দিবে না। এতটা খারাপ ওরা না, এনা জানে। আর ময়লা লাগার ভয়ে কেউ কলাগাছটাও ধরে ফেলে দিতে পারবে না। তাই কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে গাছটাকে সাবধানে ধরে রাখল যাতে কারো গায়ে না লাগে। ভ্যানের পুরোটা সময় এত ভাল বন্ধুগুলো কেউ ওর সাথে কথা বলল না। তবে এনা জানে এটা কোন ব্যাপার না, ওর বন্ধুরা আসলেই খুব ভাল।
৩.
“তোর হাতে এটা কি?” দরজা খুলে এনার আম্মু প্রথমেই জিজ্ঞেস করল।
“কলাগাছ।”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু পেয়েছিস কোথায়, কেন এনেছিস?” এনার আম্মু বিরক্ত।
“কচুক্ষেতে পেয়েছি, লাগানোর জন্য এনেছি।”
“লাগানোর জন্য এনেছিস মানে? লাগানোর যায়গা কোথায়? আর ময়লা আবর্জনা ধরতে তোকে কতবার না করেছি? কতবার?” বলে হাত থেকে গাছটা নিয়ে নিচে নেমে রাস্তায় ফেলে দিয়ে এলেন তিনি।
“ভেতরে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার কর। একি! জুতার কি অবস্থা করেছিস! দিব একটা চড়? দিব?”
এনা জানে আম্মু চড় দিবে না। লক্ষ্মী মেয়ের মত আম্মুর সবগুলো কথা মেনে যেতে লাগল।
দুপুরে খাওয়া শেষে একঘন্টা ঘুম। পাঁচ মিনিট ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থেকে এনা বুঝতে পারল আম্মু ঘুমিয়েছে। বিড়ালের মত খাট থেকে নেমে চুপিচুপি দরজা খুলে নিচে নেমে এল। কলাগাছটা এখনো রাস্তায় কাত হয়ে পড়ে আছে। তুলে নিয়ে বাসার মেইন গেটের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো এনা। বাসার চারদিকে বাউন্ডারি আর দেয়ালের মধ্যে ছোট্ট যায়গা, পুরোটাই পাকা করা। পুরো বাসাটা একবার চক্কর দিল এনা, কোথাও মাটি নেই, খালি কংক্রিট আর কংক্রিট। একটা যায়গায় কিছু মাটি দেখে এগিয়ে গেল, মনে পড়ল কোরবানীর সময় গরুটাকে এখানেই বেধে রাখা হয়েছিল। পরে কোরবানী শেষে গোবর আর অন্যসব ময়লা মাটিচাপা দিয়ে রেখে দিয়েছিল। কলাগাছটাকে কোনরকমে মাটির মধ্যে পুতে দাঁড় করিয়ে দিল এনা।
চুপিচুপি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলতেই আম্মুর সামনে পড়ে গেল। ঘুমঘুম চেহারা নিয়ে আম্মু হুংকার দিল, “কোথায় গিয়েছিলি?”
“গাছটা লাগাতে।”
এবার সত্যি সত্যিই চড় খেল। কিন্তু তাতে তেমন মন খারাপ হল না এনার। কলাগাছটা দাঁড়িয়ে আছে এটা ভেবেই খুব ভাল লাগছে। হাত-পা ধুয়ে লাফ দিয়ে বিছানায় গেল এনা, মিনিটখানেকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।