তুমি কার তরে নিশি জাগো রাই
তুমি যার আসার আশে আছো
তার আসার আশা নাই ।
রামনিধি গুপ্তের গানটি তার ফেলে আসা অতীতকে এতোটা স্বচ্ছভাবে নেত্র পর্দায় নিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের ঘটনা। অথচ হিসেব করলে এক হাতের আঙ্গুলের দাগেও কূল পাবে না। জীবনের প্রথম ধাপটা এলোমেলো ভাবে পার করে এখন এমন একটা অবস্থানে থিতু হয়েছেন যে চাইলেই আর পেছনে ফেরার সম্ভাবনা নেই। সম্ভাবনা থাকলেও কেন জানি আগ্রহটা নেই আগের মতো।
পাহাড়ের গায়ে সবুজের মিতালী ভেদ করে উঁকি দিয়েছে গুটিকয়েক মঠের চূড়া। মা-বাবা, মাতৃভূমি,আপনজন ফেলে তিনি বসতি গড়েছেন এই মঠের শতশত প্রকোষ্ঠের মধ্যে নির্জন, নীরবতায় অচ্ছন্ন একটা কুটিরে । অথচ তার ছিল মুঠোভরা স্বর্ণালী স্বপ্ন। ছিল অসীম আকাশ। ছাত্র রাজনীতির মাঠে ছিল একছত্র আধিপাত্য। বইয়ের তাকে স্তরে স্তরে রবিঠাকুর, মিলটন, বঙ্কিমদের ছিল আনাগোনা।
সশরীরে পেছনে যেতে না পারলেও স্মৃতির সাগরে অনায়াসে সাঁতার কাটা যায়। তাই কিছু স্মৃতি কখনোই পুরনো হওয়ার নয়। হয় না। কাচের জানালা ভেদ করে তার দুচোখের দৃষ্টি দূরের পাহাড়ে থমকে আছে। দরজার পাশের নিম গাছটাতে ফুল ফুঁটেছে থরে থরে। ঝর্ণাধারার শাঁ শাঁ শব্দ মনের মধ্যে একাকিত্বের বেদনা বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ । মনে শিরশির করছে পুরানো অতীত। হীরা সেনের মন উড়ে গেল ছাব্বিশ বছর আগের সেই স্বর্ণালী সময়ে।
রাজপথ কাঁপানো এই হীরা একটা সময় ভেজা বেড়ালের মতো নীরা'র পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো। শিকারি চিতার মতো নীরবে-নিঃশব্দে নীরাকে ফলো করতো, পিছু পিছু। ভালবাসা একটা মানুষকে কতটা দুর্বল করে দেয়, তা এই হীরা'র বদলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে আঁচ করা যায় । অথচ কতশত ছেলেপুলে তার কথায় উঠবস করে, দাদা-দাদা বলে, দলবদ্ধ হাঁসের মতো পিছনে ঘুরঘুর করতো তখন !
এক শ্রাবণে ক্যাম্পাসের জারুলতলায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মাঝে হীরা নীরাকে কোনো প্রকার ভণিতা না করে সোজাসুজি জীবনসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। বিয়ে করে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখায়। নীরা তো আকস্মিক এই ঘটনায় স্তম্ভিত। বিস্মিত।
- ও মা...এক্কেবারে বিয়ে করতে চাও তুমি ?
হীরার পা কাপে। গলার ভেতর যেন একটা আস্ত নুড়ি পাথর আটকে আছে। কন্ঠনালী যেন বৃষ্টির আশায় থাকা চৈত্রের কাঠফাটা রোদে বুক ছেড়া শুকনো জমির মতো খাঁ খাঁ করছে। ব্যায়াকরণস্থিত উচ্চারনের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে রাঁজহাসের মতো ফ্যাসফ্যাস করে বলে- হ্যাঁ নীরা, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই !
ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ানো হীরা'র কানে তখন যেন ঐশ্বরিক কোনো বাণী প্রবেশ করলো। কে যেন বলল,হীরা, তুই নীরাকে বিয়ে কর। সুখী হবি তুই, বড্ড সুখী হবি !
পঞ্জিকার পাতা তন্নতন্ন করে খুঁজে পাওয়া গেল শুভদিন । ২৯ শে শ্রাবণ, সোমবার। বেলা গোধূলি। পূর্বাকাশে উদিত স্বর্ণালী সূর্যের ন্যায় অসীম স্বপ্নকণা তার হৃদয়জুড়ে বসতি গড়ে। শিরা উপশিরায় বয়ে চলে ভালবাসার স্ফুলিঙ্গ।
মানুষের স্বপ্নগুলো মাঝেমাঝে ফিকে হয়ে যায়। অদৃশ্যের প্যাচানো প্রহেলিকা ছিন্ন করে মানুষের বের হওয়ার ক্ষমতা নেই। তখন ফাঁদে আঁটকে পড়া ইদুরের মতো শুধু চটপট করে মানুষ। তাদের স্বপগুলো ভেঙ্গে টুকরোটুকরো হয়ে যায় কিন্তু প্রকৃত ভালবাসা থেকে যায় অটুট, অবিচ্ছেদ্য।
কিন্তু হীরা সেনগুপ্ত এখন আর নীরাকে অনুভব করেন না। হয়তোবা মাঝে মধ্যে মনে পড়ে তবে সেখানে নিখাদ ভালবাসা নেই। সে মনে পড়ার মাঝে আছে তীব্র ঘৃনার কঠিন আচ্ছাদন।
নীরা কি কখনো হীরার ন্যূনতম ভালবাসাটা পায়নি ? সে কি তার গভীর চোখে ঘোরলাগা প্রেমের সন্ধান পায়নি ?
না হয় বিয়ের ঠিক দেড় বছরের মাথায় কি কারণে, কোন ছুঁতোয়, অন্যের হাত ধরে পালিয়ে যায় নীরা সেনগুপ্তা। সে এক অনন্ত রহস্য। অপার জিজ্ঞাসা।
গুরুজী.. গুরুজী... ডাক শুনে নিজেকে ফিরে পান হীরা সেনগুপ্ত। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজাটা খোলেন তিনি। মঠের মধ্যবয়স্ক এক সেবিকা দাঁড়িয়ে আছেন। তার চেহারাতে নীরা'র যেন স্পষ্টত মিল পাচ্ছেন তিনি। যেন ভিন্ন নারীর অভিন্ন চোখ। এই মুহূর্তে বুক ফেটে একটি কথাই বলতে ইচ্ছে করছে তার। নীরা, তোমাকে মনে পড়ছে খুব। কিন্তু এই মনে পড়ার মাঝে কোন ভালবাসা নেই। দুর্বলতা নেই। প্রেম নেই। আছে ঘৃণা। অরুচি। অনিঃশেষ অভিশাপ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:০৮