somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

পদাতিক চৌধুরি
আমি আমার নিরক্ষর কিন্তু বুদ্ধিমতী মায়ের কাছ থেকে এই শিক্ষাই পেয়েছিলাম,যথাযথ কর্তব্য পালন করেই উপযুক্ত অধিকার আদায় করা সম্ভব। - মহাত্মা গান্ধী

দীপ্ত কারোজ্জ্বল

২৯ শে জুন, ২০১৮ রাত ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অনেকদিন পরে হোমটাউন ধোপাহাটে ফিরেছি । সেদিন সকালবেলা পাড়ার গোপালদার চায়ের দোকানে বসে সবে চায়ে দুচুমুক দিয়েছি, এমন সময় আমাদের স্কুলজীবনের বন্ধু ভোম্বলকে পেপার দিতে আসতে দেখে কিছুটা চমকে উঠলাম ।
- হ্যাঁরে ভোম্বল, কত্তদিন পরে দেখা । তো কেমন আছিস বল?
- অ্যা, তপু সত্যি কতদিন পরে দেখা হল । আমি ভালো আছি। এবার বল তুই কেমন আছিস?
-আমিও উপরওয়ালার কৃপায় ভালো আছি।
- তুই তোর বাবার ব্যবসাতে লেগেগেলি?
- কী আর করবো বল । মাধ্যমিক পাশ করার পর বাবা এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো যে তখন এক প্রকার বাধ্য হয়ে বাবার কাজে নেমে পড়লাম। জানিসতো বাবা খুব ড্রিংক করতো । কতকরে ডাক্তার দেখালাম। কোনও কাজে এলো না । বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবা চলে গেল। তারপরে আর লেখাপড়া টানতে পারলাম না । তা তোর খবর বল তপু ।
-আমি কোলকাতায় থাকি । একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলা পড়াই । এই আরকি!!
- কোলকাতার কোথায়?
- রানিকুঠীর, ৮/ বি বাসস্ট্যান্ডের কাছে ।ছোট্ট একটি ফ্লাটও নিয়েছি । পারলে একদিন চলে আয় না ।
- নারে তপু, আমি যা কাজ করি তাতে একদিনও ছুটি পাওয়া যায় না । তার উপর... । না আজ আর সময় নেই। পরে কথা হবে ।
- কীরে বল, তার উপর মানে?
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভোম্বল হাত ইশারা করে সাইকেল নিয়ে দিলো একছুঁট ।

এদিকে ভাড়ের চা তখন একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে । গোপালদাকে বলতেই আবার এককাপ গরম চা দিয়ে দিলো । আমি তখন চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভোম্বলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, হঠাৎ গোপালদার কথায় যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম ।
-বুঝলি তপু, ভোম্বলের উপরে মানুষ হয়না ।
- হ্যাঁ, তা না হয় বুঝলাম । কিন্তু ভোম্বল কি করেছে, গোপালদা?
- আচ্ছা তপু, তোর ভোরার কথা মনে পড়ে?
- মনে পড়ে মানে। ও আমাদের ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিলো। ওর কথা মনে পড়ে মানে, আলবৎ পড়ে । তো কি হয়েছে ভোরার?
-ভোরা তোদের সঙ্গে পড়তো?
- হ্যাঁ । আমি, ভোরা, ভোম্বল সব এক ক্লাসে পড়তাম । আমরা যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন ভোরা আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল । তার আগ পর্যন্ত রাকিব ক্লাসে ফাস্ট হত ।
- হ্যা, ও শুধু পড়াশোনায় ভালো । তবে তপু আমরা তোদের মত অত লেখাপড়া শিখিনি ঠিকই। তবে আমার ছেলেকে আমি এখন থেকেই সময় পেলে দোকানে বসায়।পড়াশোনায় বেশি ভালো হলে বিদেশে চলে যাবে । মরার সময় মুখে জল দেবার লোক হবেনা ।
এবার আমি হো হো করে হাসতে লাগলাম ।
- তাহলে গোপালদা তুইতো খুব স্বার্থপর বাবা দেখছি । শুধুমাত্র নিজের সুবিধার জন্য ছেলেকে লেখাপড়া না শিখিয়ে দোকানে বসাবি? তা কার এমন কান্ড দেখে তোর এমন মতি শুনি ।
- তপু ভোম্বলের মা ভোরাদের বাড়িতে কাজ করতো , তোর মনে পড়ে?
- সে তো কোন ছোটো বেলা থেকে ।

উল্লেখ্য ভোম্বলের প্রকৃত নাম সুরোজিৎ দাস । অত্যন্ত সরল মনের ছেলে ভোম্বল । সারাবছর একটা ঢিলা প্যান্ট ও শার্ট পড়ে স্কুলে আসতো । আমরা তখন ক্লাস নাইনে পড়ি , ক্লাসটিচার বাংলার স্যর শ্রীনিবাস বাবু ওর ঢিলঢোলা চেহারার জন্য সেই যে ভোম্বল বললেন। সেদিনেই গোটা স্কুলে রটে গেলো সুরোজিতের নুতন নাম । প্রথমদিকে ও রাগ করলেও পরে আর রাগতো না । ক্রমশ ভোম্বল নামেই ও পরিচিত হয়ে গেলো । প্রায় প্রত্যেকদিন ক্লাস বসার পরে যেন দুরমুশ করতে করতে ক্লাসে আসতো । কিছুপরে শ্রীনিবাস বাবুস্যর অনেকের মত ওকেও পড়া ধরতেন । ও মুখ কাঁচুমাচু করে একবার এজানলার দিকে তো পরক্ষণেই অন্য জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতো । স্যর ওর দিকে তাকিয়ে বলতেন,

অমলকান্তি,
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারতো না ।
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে ,
এমন অবাক হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের ।
সেই ভোম্বলকে দেখে, গোপালদার কথানুযায়ী,

-সম্ভবত ওদের বাড়িতে অনেক আগে থেকেই পরিচারিকার কাজ করতো ভোম্বলের মা । তখন এ বাড়িতে ছিলো ভোরার ঠাম্মা ঠাকুরদা। ওর বাবার তখন ময়নাগুড়িতে পোষ্টিং হওয়াই ওরা ওখানে কোয়ার্টারে থাকতো । পরে যখন ওরা পাকাপাকিভাবে এখানে চলে আসে তখন ভোরার মায়ের মধ্যে ভোম্বলের মা খুঁজে পেয়েছিলো, সত্যিকারের এক দিদিবোনের সম্পর্ক । ভোরার মাকে ভোম্বল নুতনমা বলেই ডাকতো । তুইতো জানিস, উচ্চমাধ্যমিকের পর ভোরা চলে যায় দেরাদুনে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনিস্টিটিউটে। ওখান থেকে পাশ করেই একটা বহুজাতিক কোম্পানির হয়ে ব্যাঙ্গালোরে চাকুরীতে জয়েন করে । বাড়িতে তখন একটা উৎসব চলেছিলো । মেশোমশায় গোটা পাড়ার লোকদের মিষ্টি খাইয়েছিলেন । সমস্যা হলো এরপরে , ভোরা ব্যাঙ্গালোরে এক দক্ষিণ ভারতীয় মেয়েকে বিয়ে করে সেটেল্ড হয়ে গেলো । ফলে বাবামা পড়ে থাকলো এখানে সম্পূূর্ণ একা । একটা সময় ও বাড়ি আসা প্রায় বন্ধই করে দিল। ও অবশ্য চেয়েছিল বাবামা ওর ওখানে গিয়ে থাকুক। মাসিমা মেশোমশায় বেশ কয়েকবার গেছিলেন ওখানে । কিন্তু দু তিন সপ্তাহের বেশি থাকতে পারেননি । একদিন শুনলাম মাসিমা মেশোমশায়কে নাকি ভোরা দেহদানের অঙ্গিকার পত্রে সই করার জন্য চাপ দিচ্ছে । আচ্ছা বলতো সারাজীবন যে মানুষদুটা পূজার্চনা করে এসেছে, সেই মানুষটা হঠাৎ করে এমন আধুনিক হতে পারে?

গোপালদা আরোও বলতে লাগলো, কিন্তু এমন সময় দোকানে খরিদ্দারের চাপ অত্যধিক বেড়ে গেল । গোপালদা চাপ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো । সেই ফাঁকে আমি সেদিনের আমার সেই বন্ধু বা সৌম্যজিৎ মুখার্জীকে আজকের সৌম্যজিতের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। কী অমায়িক ব্যবহার। যেমন হাতের লেখা, তেমনি অসম্ভব ভালো আবৃত্তি ও ছবি আঁকতে পারতো। তেমনি স্টকে ছিল প্রচুর ইডিয়ম। ইংরেজির শিক্ষক অমিতাভ মিত্র স্যর ওর ইডিয়ম মুখস্তকে ভীষণ প্রশংসা করতেন। সেদিনের সেই সৌম্যজিতের পরিবর্তনে নিজেকে খুব বিষন্ন লাগলো । আপনমনে যখন এসব ভাবছিলাম তখন নিরবে পাশে দাঁড়িয়ে গোপালদা কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠলাম । গোপালদা আবার বলতে লাগলো,
-এদিকে বয়সের ভারে দুজনের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে । নিঃসঙ্গ , বিষন্নতা বা অবসাদ সহ্য করতে না পেরে গতবছর জুলাইতে মেশোমশায় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তবে সবচয়ে আশ্চর্য মেশোমশায় শেষ নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করেছেন ভোম্বলের কোলে মাথা রেখে।

আমরা প্রকৃত পক্ষে এক পাড়ায় থাকলেও ওদের ব্যাপারে অত আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু ভোম্বলের মুখ থেকে শোনা, বৃদ্ধ বয়সে বাবামা ব্যাঙ্গালোরের জলহাওয়া সহ্য করতে না পেরে তার উপর দেহদানের অঙ্গীকারে চাপ দেওয়ায় ধোপাহাটে এসে একপ্রকার থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন । এর পরে সপ্তাহ দুই ভোরা এখানে ছিল। ও চলে যেতেই মাসিমা ভোম্বলকে এখানকার সম্পত্তি উইলকরতে উকিল ডেকেছিলেন । তবে ভোম্বল তা নিতে অস্বীকার করে শুধু আশীর্বাদ চেয়েছিল যাতে নিজের মায়ের সঙ্গে নুতন মাকেও সেবা করতে পারে । মাসিমার আবার সুগার আছে । প্রত্যেকদিন সকাল রাতে ঠিক নটার সময় ইনসুলিন দিতে হয়। ভোম্বল এজন্য হাজার কাজ থাকলেও ঠিক টাইমে বাড়ি চলে আসে । দেখতে দেখতে নয় মাস অতিক্রান্ত হল, ভোরার অবশ্য মাকে নিয়ে কোনও চিন্তা নেই বা খোঁজও নেয়না । অথচ ভোম্বল ও ওর মা সারাক্ষণ মাসিমার সেবাকার্য করে যাচ্ছে । তপু নিজে চোখে না দেখলে বুঝতে পারবিনা যে ভোম্বল ও ওর মা কত বড় মাপের মানুষ । গোটা পাড়ায় ওরা সকলের নয়নের মনি ।

আমি এতক্ষণ গোপালদার মুখের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এবার কার্যত স্বীকার করে নিলাম যে সেদিন যারা লেখাপড়ার গন্ডি বেশি টপকাতে পারেনি, কিছুটা বাধ্য হয়ে চায়ের দোকান বা পেপার বিক্রির মত পেশাকে জীবনে বেছে নিয়েছে, মানবিকতায় এর অনেক গুন উৎকর্ষ ।

আজ আমাদের ক্লাস নাইনের ক্লাসটিচার শ্রীনিবাস বাবু স্যর নেই, কিন্তু সেদিন কবির নাম না জানলেও আজ জেনেছি । শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর , অমলকান্তির পরিচয় । হ্যাঁ সেও যে,
" একদিন রোদ্দুর হয়ে যেতে চেয়েছিল । "

বিঃ দ্র- ছবিটি আমার ছাত্র শ্রীমান সুজিত কুমার দাসের আঁকা ।

পোষ্টটি শ্রদ্ধেয় ব্লগার মনিরা সুলতানা আপুকে উৎসর্গ করলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১:২৫
৩৪টি মন্তব্য ৪১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×