কিছুক্ষণ আগেও আন্তালিয়া শহর ছিল বৃষ্টি মুখর। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে যেন কোথাও ভেসে যাচ্ছিল শহরটি। চারিদিকে নিঃশব্দ আর হাহাকার করা শূন্যতা। মনে পড়ে গেলো নরসিংদী শহরের সেই বৃষ্টি মুখর মধ্য দুপুরটির কথা। অদূরেই গাবতলীর বিশাল মাঠ। নেমে গেছে রাস্তায় বালকের দল, মেতে উঠছে ফুটবল খেলায়। আর নোলক পরিহিত একটি বালিকার জানালায় উঁকি দেয়া কৌতূহলী চোখ।
তখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধ্যা নেমে আসার মুহূর্তে আমি বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। দীর্ঘ দিনের চেনা রাস্তাগুলো কেমন যেন অচেনা লাগছে। ভেজা রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন আলোর প্রতিবিম্বটা তৈরি করছে এক অন্য রকম ঘোর লাগা পরিবেশ। আমি হাঁটছি ঘোরের মধ্যদিয়ে আন্তালিয়ার পথে-ঘাটে।
বর্ষা আমার প্রিয় ঋতু হলেও এখানে কেউ বৃষ্টি পছন্দ করে বলে মনে হলো না। আমি বিড়বিড় করে আন্তালিয়ার জনগণকে সম্বোধন করে বললাম, হে হতভাগা আন্তালিয়াবাসি! তোমরা যারা এখনো আকাশের উপরে আকাশ আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো বর্ষার জল দেখনি তারা মন দিয়ে শুনো, যে শিশুটি কোনদিন কাঁথা মুড়ি দিয়ে টিনের চালের রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়নি তার শৈশবকাল ব্যর্থ হয়েছে। যে বালক মধ্য দুপুরের প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ফুটবল খেলতে বের হয়নি তার বাল্যকাল ব্যর্থ হয়েছে। যে বালক কিংবা বালিকাটি গ্রীষ্মের প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আম কুঁড়াতে বের হয়নি তার বাল্যকালও ব্যর্থ হয়েছে। আর যে প্রেমিক তার প্রেমিকার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজেনি কোনদিন সে হচ্ছে ব্যর্থ প্রেমিক। আর যে বৃদ্ধ এখনো পুলকিত মন নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেনি তার জন্য বড়ই আফসোস। সুতরাং হে হতভাগার দল! কেউ যদি তার শৈশব-কৈশোর-যৌবন কালকে সফল করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই বাংলাদেশে যেতে হবে।
অবশ্য আন্তালিয়াবাসীর বৃষ্টি কে পছন্দ করার কোন কারণও দেখছি না। এখানে শীতকালে বৃষ্টি হয়। এমনিতে প্রচণ্ড শীত তার উপর বৃষ্টি। বৃষ্টি তাদের উপর নেমে আসে অভিশাপ সরূপ। যা শীতের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে অর্ধনগ্ন মেয়েগুলোর জন্য এই সময়টাতে আমার খুব মায়া লাগে। মেয়েটি প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে অথচ নগ্নতা পরিহার করতে পারছে না। হতে পারে এটা তাদের জন্য প্রচণ্ড ধৈর্য শক্তির বহিঃপ্রকাশ, যা ছেলেদের মধ্যে নেই।
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে আমার কিছুটা হলেও কাক ভেজা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু এই শহরে তো কোন কাক নেই। কাক ভেজা ভিজবো কি করে? অদূরেই একটি নেড়ি কুকুর দেখতে পেলাম। ডাস্টবিনের পাশটায় আয়েশ করে বসে সেও 'কাক ভেজা' ভিজছে। আহারে হতভাগ্য তুর্কি কুকুর। আমার ধারণা পৃথিবীর সব দেশেই স্থানীয় কুকুর গুলো হতভাগা হয়ে থাকে। আমার রুমমেট ইয়াফেজ গৃহহীন কুকুরদের পুনর্বাসনকারী একটি সংগঠনের সাথে কাজ করে। তাকে বলতে হবে এই কুকুরটার কথা। হতভাগার ভাগ্য ফিরেও যেতে পারে।
'কাক ভেজা' প্রবাদটা কিভাবে তৈরি হয়েছে এই মুহূর্তে জানতে খুব ইচ্ছে করছে। বাংলা ভাষার 'কাক ভেজা' প্রবাদটি তুর্কি ভাষায় পরিবর্তিত করে 'কুকুর ভেজা' হলে কেমন হয়? বিড়বিড় করে কুকুরটিকে সম্বোধন করলাম, হে হতভাগা তুর্কি কুকুর আমি তোর সম্মানে হাজার বছরের বাংলা প্রবাদ পরিবর্তন করে দিলাম। আন্তালিয়া শহরের মানুষ এখন থেকে 'কুকুর ভেজা' ভিজবে। এবার খুশি তো? সে খুশি হয়েছে কিনা বুঝতে পারলাম না। সেই আগের মতই আয়েশ করে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে।
আচ্ছা সে কি রবীন্দ্র সঙ্গীত জানে?
"আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে
কিছুতেই কেন যে মন লাগে না।"
কুকুর নিয়ে আমার স্মৃতি গুলো অবশ্য খুব বেশি সুখকর না। একদিন আমি আর নুরুল্লাহ ভার্সিটির ভেতরে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। এক জায়গায় থামলে হঠাৎ করে দুটি কুকুর আমাদের কে ধাওয়া করে বসল। নুরুল্লাহ দ্রুত প্যাডেল চালিয়ে বিপদ মুক্ত হয়ে গেলেও আমি পেছনে পরে গেলাম। দুটি কুকুর আমাকে ধাওয়া করছে। দেখার মত একটি দৃশ্য হলেও আমি প্রচণ্ড ভয়ে ছিলাম। কুকুর দুইটার সাথে না পেরে এক পর্যায়ে সাইকেল থামিয়ে দিলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম পৈশাচিক আক্রমণের। কুকুর দুটি আমার কাছে আসল। গন্ধ শুঁকল, তারপর চলে গেলো। সেদিন বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম।
তবে আজকে কুকুর নিয়ে আর কোন গল্প হবে না; গল্প হবে বৃষ্টি নিয়ে। কেননা আজ আমার শহরে অনেক বৃষ্টি। অনেকটা কবিতার মত এবং সাথে এইলুলের হাতে ধুঁয়া উঠা এক কাপ কফির মত। কফির কথা মনে হলেই এইলুলের সেই কফি পানের নিমন্ত্রণের কথা মনে পড়ে যায়। সেদিনও বৃষ্টির দিন ছিল। আমরা বৃষ্টির কারণে বাস স্টপেজের ছাউনিতে আটকা পড়েছিলাম। সেখান থেকেই পরিচয়। আমি কথায় কথায় বললাম, এই মুহূর্তে এক কাপ কফি হলে খুব জম্পেশ হত। কথা নেই বার্তা নেই সে আমাকে কফি পানের দাওয়াত দিয়ে বলল, আসবেন তো?
আমি রবিঠাকুর কে কপি করে বলতে গেছিলাম, “মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য, অতএব কথা না-দেওয়াই সব চেয়ে নিরাপদ।” রবিঠাকুর কে টার্কিশ ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে আমার করুণ অবস্থার কথা বিবেচনা করে সে চিন্তা বাদ দিলাম। তাছাড়া কফি পানের লোভ তো ছিলই। সুতরাং সাহিত্য ফলাতে গিয়ে কোন ভাবেই মিস করা যাবে না।
আমি বললাম, বাঙ্গালীরা তো কফি পান করে না কফি খায়।
- তাই নাকি!
- শুধু কফি না, চা খায়, পানি খায়, এক কথায় যত পানীয় আছে সবই আমরা খাই। এমন কি সাহিত্যিকরাও তাদের গল্পের চরিত্র গুলোকে পানীয় খাওয়ায়। কারণ চরিত্র গুলো বাঙ্গালী। সে আমার কথা শুনে হাসছে আর আমি বলছিলাম, বেঁচে থাকাটা হতে পারে কখনো কখনো শুধুমাত্র এক কাপ কফির তৃষ্ণায়, শুধু আপনার হাতে। আপনার হাতের কফি না খেয়ে যদি মরে যায়; আমার তৃষিত আত্মা আপনার আশে-পাশে ঘুরে বেড়াবে এক কাপ কফির তৃষ্ণায়।
- আপনি আসবেন কিনা সেটা বলেন।
আসবো বলেছিলাম কিন্তু আসা হয়নি। কেন আসা হয়নি সেটা কফির জানার কথা নয়, মানুষেরই জানার কথা। কেননা মানুষের কারো অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান হওয়ার মুহূর্তটায় ভীতি আছে। কফির স্বাদ যেমনটা হবে ভেবেছিলাম তেমনটা যদি না হয় কিংবা যা প্রত্যাশা করেছিলাম তার চেয়ে বেশি হয় তখন পুনরায় না পাওয়ার ভয় থেকে যায়।
সেদিন অনেক বৃষ্টি ছিল। আজও আমাদের শহরে অনেক বৃষ্টি।
"ভিজিয়ে দিয়ে যাওয়া আজ রাতের বৃষ্টি,
শুধু ভেজাতে পারেনি একটি হৃদয়কে।
তাই প্রেম এই শহর ছেড়ে চলে গেছে।"
প্রেম অবশ্য শহর ছেড়ে চলে যায়নি। বৃষ্টির কারণে রাস্তা ছেড়ে ঘরের ভেতর চলে গেছে। আচ্ছা ওরা কি রবি ঠাকুরের 'আষাঢ়' কবিতা পড়েছে?
"নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।"
না পড়লেও রবি ঠাকুরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওরা সব আজ ঘরের ভেতরে। আর আমি হাঁটছি একা নগরের ভেজা রাস্তায়। অদূরেই একটি বাস স্টপেজ ছিল। এক জোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সেখানে হাতে হাত রেখে অপেক্ষা করছে। কিসের অপেক্ষা? হতে পারে বাসের জন্য কিংবা মৃত্যু। আমি নিজেকে তাদের জায়গায় কল্পনা করতে গিয়ে শিউরে উঠলাম। আমারও একদিন যৌবন ছিল। এখন আমি বৃদ্ধ। কি আশ্চর্য! মৃত্যু একদিন থামিয়ে দেবে এইসব কোলাহল। আমরা বেড়ে উঠছি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার জন্য।
বৃদ্ধা তার বৃদ্ধ স্বামীর হাতটি এখনো ছেড়ে দেইনি। হয়ত বহুদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে শরীরের প্রতি শরীরের টান। দিন শেষে ঠিকই রয়ে গেছে ভালবাসা আর সম্মান। ভালবাসা আর পারস্পারিক সম্মানবোধ আছে বলেই বহুতল প্যালেসে চাপা পড়া হাজারো দীর্ঘশ্বাসের উপর শহরটি এখনো জেগে আছে। আর তুমি আছো বলেই প্রেম এই শহর ছেড়ে এখনো পালিয়ে যায়নি।
হাটতে হাটতে চার্লি চ্যাপলিনের কথা মনে পড়ে গেলো। তিনি হাটতে চাইতেন বৃষ্টির মধ্য দিয়ে। কারণ বৃষ্টিতে ভেজার সময় কাঁদলে চোখের জল বৃষ্টিতে মিশে একাকার হয়ে যাবে। কান্নার কথা কেউ বুঝতে পারবে না। ইতোমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। আবারো মুখরিত হয়ে উঠছে চারপাশ। পাল্টে যাচ্ছে নগরের দৃশ্যপট। আর আমি হারিয়ে যাচ্ছি চির চেনা একটি শহরের রাস্তায়, জনতার কোলাহলে, নাগরিক ক্যাফেতে, চায়ের আড্ডায়, হাসি-কৌতুকের ভীড়ে। আর হয়ত এই শহরের কোন এক ঝাপসা কাচের জানালার ভেতরের দিকটায় কফি হাতে নিয়ে বসে আছেন কেউ। হয়ত ভাবছেন, আজ থেকে বহুদিন পর আপনি আর আমি হয়ত থাকবো না কিংবা আমাদের মাঝে থাকবে না কোন অদৃশ্য দেয়াল। কিন্তু ঠিকই থেকে যাবে এক কাপ কফির তৃষ্ণায় কারো কারো বেঁচে থাকার মিথ্যে সংলাপ।
আর আমি পাগলের মত সশব্দে বলে উঠলাম, আজ থেকে বহুদিন পর আপনি ঠিকই জেনে যাবেন আমি সাহসী ছিলাম না। পাথরের দেয়ালের অন্ধকার দিকটায় পড়ে থাকা বিস্তীর্ণ শ্রাবণের আকাশ, অগণিত শাপলার মেলায় বর্ষার প্রথম কদম ফুলটি আপনার হাতে আর তুলে দেওয়া হলো না।
পুনশ্চঃ প্রেমিক, প্রেমিকা কিংবা প্রেম শব্দ গুলো শুনলেই আমাদের কাছে মনের পর্দায় ভেসে উঠে বিবাহবহির্ভূত এক অবৈধতা। অথচ প্রেমের সৌন্দর্য হচ্ছে বৈবাহিক জীবনে। এবং আমার দুর্ভাগ্য যে আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।
আকদেনিজ ইউনিভার্সিটি
আন্তালিয়া, তুরস্ক।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:১৯