somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প ঃ দিপালীর বিয়ে এবং

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রত্যেক বছর বৈশাখ মাসে আমাদের স্কুল থেকে প্রায় দেড় মাইল দক্ষিণ পশ্চিম দিকে কালী বাড়িতে মেলা বসে। মেলাটি একমাস চলে। বৈশাখ মাসের প্রত্যেক সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী পাঠা বলী হয়। অনেক দূর দূরান্ত থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বি অনেক লোক এই কালী বাড়িতে এসে পুজা অর্চনা করে থাকে। হিন্দুদের পাশাপাশি এলাকার অন্য ধর্মের লোকজনও এই মেলায় আসে।

কোন কারণে হাফ স্কুল থাকায় তিন বন্ধু মিলে কালীর মেলায় বেড়াতে গিয়েছি। প্রচন্ড রোদ, রোদের ভিতর হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে মন্দীরের পূর্ব পার্শ্বে রাস্তার ধারে বট গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছি। আমার সাথের দুইবন্ধু মেলা ঘুরতে গেছে। হঠাৎ চেয়ে দেখি কালী মন্দীরের পূর্ব পার্শ্বে যে বট গাছটির নিচে বসে আছি সেই রাস্তা ধরে লাল শাড়ি পরা একটি মহিলা এদিকেই আসছে। মহিলার কোলে দুই তিন বছর বয়সের একটি মেয়ে। মাহিলাটি কাছে আসতেই অনেকটা পরিচিত মনে হলো। তবে কপালে লাল টিপ আর সিঁথির সিঁদুর থাকায় চেনার পরেও অচেনা লাগছে। সত্যি সত্যি যদি পরিচিত না হয় তাহলে আহাম্মক হওয়ার ভয়ে কৌশল অবলম্বন করে অন্য দিকে তাকিয়ে অনুচ্চ স্বরে বললাম, ‘দিপালী’। লক্ষ্য করলাম মহিলা এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। আমি আবার উচ্চারণ করলাম, ‘দিপালী’। এবার মহিলা থমকে দাঁড়িয়ে জবাব দিল, ‘কে’?

আমি বট গাছের উল্টা দিকে শিকড়ে বসা ছিলাম। উঠে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি।
দিপালী কিছুটা আশ্চার্য হয়ে চোখ কপালে তুলে বলল, ছোটকু তুই! তুই এখানে কি করিস? তোর স্কুল নাই?
আমি স্বাভাবিক ভাবে হাসতে হাসতে বললাম, কেন? আমি মেলায় এসেছি এতে কি তুই আশ্চার্য হয়ে গেলি।
-- না রে আশ্চার্য হইনি, তবে তোর তো স্কুল থাকার কথা?
-- হাফ স্কুল ছিল, ছুটি হয়ে গেছে তাই মেলায় বেড়াতে এসেছি।
-- আর কে এসেছে?
-- সুবল আর রহীম সাথে এসেছে।
-- ওরা কই?
-- মেলায় বেড়াতে গেছে।
-- তুই যাসনি?
-- গিয়েছিলাম, গরমে হাঁটতে গিয়ে খুব ক্লান্ত হয়েছি , তাই এখানে বসে জিরিয়ে নিচ্ছি।
-- শুধু শুধু ঘুরাফিরা করছিস না কিছু কিনেকেটে খেয়েছিস?
-- দীপালীর কথায় সায় দিয়ে বললাম, না না খেয়েছি।
-- কি খেয়েছিস?
-- তিনজনে মিলে তরমুজ কিনে খেয়েছি।
-- আর কিছু খাবি না?
-- না রে, আর কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না শুনে ও আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে, আমিও ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কপালে সিঁদুর দেখেও বালসুলভ ভাবে বললাম, তুই স্কুলে আসিস না কেন?
-- আমার তো বিয়ে হয়েছে।
-- তোর বিয়ে হয়েছে কবে রে?
-- এই তো ছয় মাস হলো।
--- তোর বর আসে নাই?
--- এসেছে?
--- তোর সাথে নাই কেন?
--- ওই তো পিছনে পিছনে আসছে?
ওর কথায় পিছনে তাকালাম। চল্লিশোর্ধ একজন আট দশ বছরের একটি মেয়ে সাথে নিয়ে আসছে। কিন্তু দিপালীর যে বয়স সেই বয়স অনুযায়ী কোনো বর চোখে পরছে না।
আমি দিপালীকে আবার প্রশ্ন করলাম, কই রে তোর বর?
দিপালী মুখ কালো করে বলল, তুই কি কানা নাকি রে, পিছনে মানুষ দেখতে পাচ্ছিস না?
--- দেখছি তো, উনি কি তোর বর?
দিপালী মুখ কালো করে কিছুটা লজ্জিত কিছুটা বিরক্তভাবে বলল, হ, ওটাই তো!
ইতিমধ্যেই ভদ্রলোক কাছে এসে পৌঁছেছে। কাছে এসে দিপালীকে দাঁড়ানো দেখে বলল, দিপালী দাঁড়ালে কেন?
দিপালী জবাব দিল, এমনি, বলেই সে আবার হাঁটা শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে আমাকে লক্ষ করে বলল, তোরা সব ভাল আছিস রে?
-- হ্যাঁ, ভাল আছি।
-- স্যারেরা ভাল আছে?
-- হুঁ, ভাল আছে।
আমাদের দু’জনের কথাপোকথন দেখে ভদ্রলোক বলল, এ ছেলেটি কে গো দিপালী?
দিপালী সহজ সরল ভাবেই জবাব দিল, আমাদের সাথে পড়তো?
--- তোমাদের কে হয়?
--- কে হবে আবার, তোমার শালাবাবু হয়?
--- তাহলে তো ভালই হলো, একজন শালাবাবু পাওয়া গেল? কথাটি বলেই দিপালীর স্বামী হাসিমুখে বলল, তা শালা বাবুর নামটা কি জানতে পারি?
নাম জানতে চাওয়ায় ছোট করে উত্তর দিলাম, আমার নাম ছোটকু।
-- শুধু ছোটকু না আগে পড়ে আরো কিছু আছে?
-- আগে পড়ে আরো কিছু আছে তবে স্কুলের সবাই ছোটকু নামেই ডাকে।
-- যে যাই বলুক আমি তোমাকে ছোটকু না বলে শালা বাবু বলে ডাকবো।
-- ঠিক আছে দাদা।
-- তাহলে শালাবাবু এখন কোন দিকে যাওয়া হবে?
-- বাড়ির দিকে যাব।
-- বাড়ি কোন দিকে?
-- উত্তর দিকে।
-- তাহলে ভালই হলো, একসাথে যাওয়া যাবে?
মাথা কাত করে বললাম, চলেন?
দিপালী মেয়ে দু’টিকে সাথে নিয়ে আগে আগে হাঁটছে আমি এবং দিপালীর স্বামী ওদের পিছনে পাশাপাশি হাঁটছি। দিপালীর স্বামী কিছুক্ষণ নিরব থেকে জিজ্ঞেস করল, তা শালাবাবু, তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে?
আমি আস্তে আস্তে জবাব দিলাম, ভাল।
-- তোমাদের ক্লাসে মেয়ে কয়জন?
-- নয়জন ছিল তার মধ্যে দিপালীর বিয়ে হয়ে গেল, এখন আটজন আছে।
-- ওদের কারো বিয়ে হয় নাই।
-- না, একমাত্র দিপালীর বিয়ে হয়েছে, আর কারো বিয়ে হয় নাই।
-- তাহলে বোঝা গেল দিপালীর পোড়া কপাল, ওর ভাগ্যে পড়াশোনা হলো না।
-- পোড়া কপাল কেমনে বলেন দাদা, ওরই তো কপাল ভাল, আগে আগে বিয়ে হয়ে গেল।
দিপালী পিছন ফিরে কিছুটা রাগান্বিত হয়ে ওর স্বামিকে লক্ষ্য করে ছোট্ট ধমকের সুরে বলল, তোমাদের আর কোন কথা নাই, যত সব আজেবাজে প্যাঁচাল।
দিপালীর স্বামী মৃদু হেসে বলল, আহা দিপালী-- শালা বাবুর সাথে একটু মন খুলে কথা বলছি তাও বলতে দিবে না।
দিপালী ঝাঁমটা মেরে বলল, এসব কথা মন খুলে না বলে অন্য কথা বললেই তো হয়।

দিপালীর স্বামী আস্তে আস্তে বলল, কি আর অন্য কথা বলবো দিপালী, আমারো কপাল খারাপ তোমারো কপাল খারাপ। আমার বউ মরে আমি বিপদগ্রস্ত হলাম, সেই অভাব পুরণ করতে এসে তুমিও এখন বিপদগ্রস্ত। তোমার অবস্থা তো আমি বুঝতে পারি, এই বয়সে তোমার উপযুক্ত স্বামীর অভাব পুরণ করা হয়তো আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
এসব কথা আমার কানে এলেও দিপালীর কান পর্যন্ত পৌছল কিনা জানিনা। তবে দিপালী তার মুখ নাড়ানো দেখে পিছন ফিরে বলল, আস্তে আস্তে বিড় বিড় করে কি বলছো?
দিপালীর স্বামী তাড়াতাড়ি বলল, না কিছু না, বলেই আমাকে লক্ষ্য করে বলল, শালাবাবু, একটু কষ্ট করতে হয় যে?
-- কি কষ্ট দাদা?
-- এই তেমন কিছুনা। আমার খাবারের ব্যাগটা যদি একটু কষ্ট করে নিতে, তাহলে আমার একটু রিলাক্স হতো।
-- তা দাদা এ আর কি কষ্ট? একটা ব্যাগ নেয়া কোন ব্যাপার হলো?
-- তা নয়, তবে হাজার হলেও শালাবাবু মানুষ, কাজেই সামান্য কষ্ট দেয়াও ঠিক নয়।
-- তবে দাদা একটা কথা আছে, আমাকে খাবারের ব্যাগটা বাদ দিয়ে অন্য যে কোন একটা ব্যাগ দেন।
-- আরে শালাবাবু খাবারের ব্যাগটা ওজনে কম দেখে দিতে চাইলাম, আর তুমি কিনা ভারীগুলো নিতে চাইছো। ধন্য তোমায়। তবে তোমাকে ভারী ব্যাগ দিলে দিপালী না আবার আমার প্রতি রক্ত চক্ষু ঝারে, সেটাও একটা সমস্যা। কাজেই তুমি আমার খাবারের ব্যাগটা নিয়ে নিলেই আমার জন্য যথেষ্ঠ উপকার হবে, বলেই সে খাবারের ব্যাগটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।
আমি ব্যাগ গ্রহণ না করে হাত সরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, দাদা-- খাবারের ব্যাগ আমার নেয়া যাবে না, সমস্যা আছে।
দিপালীর স্বামী আশ্চার্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি সমস্যা?
আমি মুখটা কাঁচুমাচু করে বললাম, দাদা আমি মুসলমান। আপনাদের পুজোর প্রসাদ ট্রসাদ থাকলে আমার হাতের ছোঁয়ায় ছুঁয়া হয়ে যেতে পারে, এই জন্যে নিতে চাচ্ছি না।

আমার কথা শুনে দিপালীর স্বামী অত্যান্ত খুশি হয়ে আমাকে বার বার ধন্যবাদ দিতে লাগল। দিপালীকে ডেকে বলল, দিপালী-- তোমার এই মুসলমান ভাইটি অত্যান্ত সচেতন লোক। তার হাতের ছোঁয়ায় আমাদের প্রসাদ যাতে ছুঁয়া না হয় সেজন্য সে আমাকে আগেই সতর্ক করে দিল। তার কথায় আমি খুব খুশি হয়েছি। তার এ কথাগুলো আমার চিরদিন মনে থাকবে। আমি এই সচেতন শালা বাবুর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।
দিপালী একটু সামনে ছিল এবার সে পিছনে এসে বলল, খাবারের ব্যাগটা তোমার খুব বোঝা হয়ে থাকলে আমাকে দাও। ও আমাদের সাথে সঙ্গ দিচ্ছে এটা বুঝি তোমার সহ্য হচ্ছে না। ওর ঘাড়ে ব্যাগ দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেছ, বলেই মুখ ঝামটা দিল।
আমি বললাম, না দিপালী, আমার ব্যাগ নিতে কোন অসুবিধা নাই, তোদের হিন্দু ধর্ম তো আবার ছোঁয়াছুয়ির ধর্ম, খাবারের ব্যাগ নিলে তোদের পুজোপালির প্রসাদ নিয়ে যদি কোন অসুবিধা হয়, এই জন্য খাবারের ব্যাগ নিচ্ছি না। বরঞ্চ তুই খাবারের ব্যাগটা নিয়ে তোর হাতের ব্যাগটা আমাকে দে।
দিপালী এবার পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর ঘাড়ে ব্যাগ তুলে দেই আর তুই আগামীকাল স্কুলে গিয়ে সবাইকে বলবি, দিপালী আমাকে দিয়ে ওর স্বামীর ব্যাগ বহন করিয়েছে। আমারে তুই পাগল ভেবেছিস, না--।
আমি বললাম, না না দিপালী, কি বলিস তুই? তোর ব্যাগ বহনের কথা স্কুলে গিয়ে বলব এটা তুই কি করে ভাবলি? তোর ভাই থাকলে কি ব্যাগ নিত না? আমাকে তুই কি ভাইয়ের মত ভাবতে পারছিস না? আমাকে পর পর ভাবতেছিস কেন রে?
দিপালী হাঁটতে হাঁটতে বলল, তোর ব্যাগ নেয়া লাগবে না, তুই আমাদের সাথে যেমন খালি হাতে হাঁটছিস তেমনি খালি হাতেই আয়।
আমি দিপালীর কাছে গিয়ে বললাম, এই দিপালী, ভন্ডামী করিস নাতো, দে তো, আমার হাতে ব্যাগটা দে, তুই দাদার কাছ থেকে খাবারের ব্যাগটা নিয়ে নে। দেখিস না দাদার খুব জুলুম হচ্ছে, দু’টা ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে পারছে না।
আমার কথায় দিপালী ওর হাতের ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে ওর স্বামীর হাত থেকে খাবারের ব্যাগ নিতে নিতে বলল, আমার চেয়ে তোর কি দাদার প্রতি দরদ বেড়ে গেল রে?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, হাজার হলেও দাদা হলো জামাইবাবু মানূষ, তার প্রতি দুর্বলতা নয় শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার, তা না হলে দাদা ভাববে আমাদের এলাকার লোকজন অভদ্র।
আমার কথা শুনে দিপালীর স্বামী হাসতে হাসতে বলল, দেখছো দিপালী-- আমার শালাবাবু কত সচেতন।

এমনি অনেক কথা বলতে বলতে একসময় ভরতখালী রেল স্টেশনে চলে এলাম। স্টেশনের পূর্ব পার্শ্বের আমগাছের ছায়ায় ব্যাগ রেখে ঘাসের উপর দিপালী বসে পড়ল। আমি আর দিপালীর স্বামী দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পরেই স্টেশনে ট্রেন আসার ঘন্টা দিল। দিপালীর স্বামী আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, শালাবাবু--আমাদের ট্রেনে না উঠিয়ে যাবে না কিন্তু। দিপালীকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি টিকেট কাটতে গেলাম তুমি তোমার ভাইকে কিছু খেতে দাও, শালাবাবু অনেক কষ্ট করেছে, বলেই তিনি টিকিট কাটতে চলে গেলেন।
দিপালীর স্বামী চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে দিপালী আমাকে উদেশ্য করে বলল, হারে ছোটকু, আমাদের ক্লাসে সব মেয়েরাই আসে রে?
-- আসে।
-- আর কারো কি বিয়ে হয়েছে রে?
-- না, শুধু তোর বিয়ে হয়েছে।
-- আমার কপাল খারাপ রে!
-- কেন, তুই তো ভাল আছিস?
-- না রে, ভাল নেই, তুই কি দেখতে পাচ্ছিস না আমার বরের বয়স কত?
-- দেখেছি, একটু বয়স বেশি।
-- একটু নয় রে, তিন মেয়ের বাবা, ওর বড় মেয়ে আমার সমবয়সী। সেও ক্লাস নাইনে পড়ে। ও যখন আমাকে মা বলে ডাকে তখন খুব লজ্জা লাগে রে। আমার বাবা যদি বেঁচে থাকত তাহলে কি আমার ভাগ্য এমন হতো রে। অবশ্যই সে দেখে শুনে আমাকে ভাল বরের সাথে বিয়ে দিত। মরে গেলেও কখনও তিন কন্যার জনক এমন আধাবুড়োর সাথে বিয়ে দিত না। অল্প বয়েসেই এখন বরের কারণে আধাবুড়ি হলাম। বলেই দিপালী দু’চোখের জল ছেড়ে কেঁদে দিল। আমি ইতস্তত করতে লাগলাম। কি বলে ওকে সান্তনা দিব বুঝতে পারছি না। বয়সে বেমানান বয়ষ্ক স্বামী কোন নারীই কামনা করে না। সেখানে তের চৌদ্দ বছরের তরুনী হয়ে চল্লিশোর্ধ স্বামীর পানি গ্রহণ করা যে কত কষ্টের সেটা দিপালীর কান্না দেখেই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে হয়তো এমন স্বামী বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। অবশেষে দিপালীকে সান্তনা দেয়ার জন্য বললাম, তুই কাঁদছিস কেন রে, এটা তোর ভাগ্যে ছিল তাই হয়েছে। আচ্ছা-- তুই কি বিয়ের আগে বর দেখিসনি?

দিপালী আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, দেখেছিলাম রে-- কিন্তু উপায় ছিল না। বাবা যুদ্ধে মারা যাওয়ার পর মায়ের তো কোন রোজগার নেই। মামাদের উপর নির্ভরশীল। মামারাই আমাদের ভরণ পোষণ করে, কাজেই মামারা যা বলে তাই মা শুনতে বাধ্য। মামারা এই আধা বুড়োর সাথে বিয়ে ঠিক করেছে।
-- তুই বিয়ের আগে এই আধাবুড়োকে দেখার পরও রাজী হলি কেন?
-- রাজী না হয়ে উপায় ছিল না রে, বিয়ের যৌতুক দেয়ার মত আমার মায়ের কোন সামার্থ ছিল না। মামারা যা করেছেন তাই মাথা পেতে বরণ করতে হয়েছে। তোকে আমি বুঝাতে পারবো না রে, আমার দুঃখটা কোন জায়গায়। আমি বেঁচে থেকেও আধামরা, বলেই দুচোখের জল ছেড়ে আবার কাঁদতে লাগল।

আমি ওর কান্না দেখে ব্যাথিত হলাম, কিন্তু ওকে কি বলে যে সান্তনা দিব ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, শুধু বললাম, কাঁদিস না রে, দাদা দেখলে হয়তো মন খারাপ করবে, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। বিধাতা হয়তো এমনই তোর কপালে লিখেছিল তাই মেনে নিতে হবে।
আমার কথা শুনে দিপালী কান্না বন্ধ করে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিল। শাড়ীর আঁচলের গাট খুলে পাঁচটি টাকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, দেখ তো-- ওই হোটেলে কিছু খাবার আছে নাকি? কিছু কিনে খেয়ে একটু জল খেয়ে নে। অনেক রাস্তা হেঁটেছিস। মুখ শুকিয়ে গেছে।
আমার হাতে যখন টাকা দিয়েছে তখন বুঝতে পারিনি ও আমার খাবার জন্য টাকা দিতেছে। ওর কথা শুনে যখন বুঝতে পেলাম তখন টাকাটা আবার ওর হাতে দিয়ে বললাম, আমার খিদে নেই রে, আমরা কয়েক বন্ধু মিলে অনেক কিছু কিনে খেয়েছি।
আমি খেয়েছি একথা দিপালী শুনতে নারাজ। কিন্তু ওর অসহায় অবস্থা দেখে টাকা নিতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। আমি টাকা নিচ্ছি না দেখে খাবারের ব্যাগ থেকে দু’টি সন্দেশ বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, নে-- তাহলে এদু'টা খেয়ে ঐ কল থেকে জল খেয়ে নে।
আমি ওর দেয়া সন্দেশ হাতে না নিয়ে মুখটা কাচুমাচু করে বললাম, নারে দিপালী-- আমার খাওয়া লাগবে না। বরঞ্চ তোকে একটা কথা বলতে চাই তুই কি রাগ করবি?
আকস্মিকভাবে ওর কাছে কিছু জানতে চাওয়ায় ও হকচকিয়ে আমার মুখের দিকে মাথাটা এগিয়ে এনে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে বলল, কি কথা রে?
আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম, তুই কি আগের মতো গান করিস রে?
ও হয়তো অনেক কিছু ভেবেছিল, কিন্তু আমি গানের কথা জিজ্ঞেস করায় আশাহত হওয়ার মত ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ও-- এই কথা! গান গাওয়ার সে সুখ কি আমার আছে রে? বলেই চোখের জল ছেড়ে কেঁদে কেঁদে গুন গুন করে গাইল-- --

‘দিপালীর দীপ নিভে গেছে আজি, কি গান গাইবো মনে আসে না----
দুখের সাগরে ডুবে গেছি তাই, সুরের সাথে কথা মেলে না।’
ভেবেছিলাম জীবনে সুখী হয়ে বাঁচবো
দখিন হওয়ায় উড়ে ঘুরে ঘুরে নাচবো
সে আশার গুঢ়ে বালি আজ, মিছে হলো মোর সাধনা
দুখের সাগরে ডুবে গেছি তাই, সুরের সাথে কথা মেলে না।’

এ টুকু গেয়ে চোখের জল মুছে আমার দিকে সন্দেশ দু'টি আবার এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল, নে ধর তো-- তোর দাদাবাবু এসে যদি দেখে আমি তোকে কিছু খেতে দেইনি, তাহলে খুব রাগ করবে। তুই কিছু খেয়ে নে তো।
দিপালীর অনুরোধে আমি আর বাধা দিতে পারলাম না। সন্দেশ দু’টি হাতে নিয়ে খেতে খেতে চাপ কলের দিকে চলে গেলাম। চড়া রোদে রাস্তা হেঁটে আসায় গলা শুকিয়ে ছিল। কল চেপে অনেক জল খেলাম। জল খেয়ে ফিরে এসে দেখি, দিপালীর স্বামী টিকিট কেটে ফিরে এসেছে। আমাকে দেখে হেসে বলল, আমি তো ভেবেছি আমার শালাবাবু পালিয়েছে।
আমি বললাম, না দাদা-- পালাবো কেন? আপনি থাকতে বলেছেন যখন তখন কি আর পালাতে পারি? আপনাদের গাড়িতে তুলে দিয়েই যাবো। জীবনের প্রথম আপনার সাথে দেখা এ অবস্থায় আপনাকে গাড়িতে তুলে না দিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে দাদা?
দিপালীর স্বামী আমার কথায় খুশি হয়ে দিপালীকে উদ্দেশ্য করে বলল -- আরে দিপালী-- ভাগ্যগুনে এমন শালাবাবুর দেখা পেয়েছি। না পেলে তো আমাদের আজকে খুব সমস্যা হতো।
একটু পরেই দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। দেখতে দেখতেই ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। তাড়াতাড়ি দিপালী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমি একটা ব্যাগ হাতে নিলাম। দিপালী মেয়েটাকে একহাতে ধরে গাড়ির দিকে আগালো। মাসের শেষ শনিবার হওয়ায় অনেক লোক কালীর মেলায় পুজা অর্চনা করতে এসেছে। সেই সাথে অনেকে পাঠা বলী দেখতে এসেছে। স্টেশনে অনেক লোকের ভির। লোকজনের সমাগম দেখে দিপালীর স্বামী আমাকে বলল, শালাবাবু তুমি আগে গড়িতে উঠে সিট দখল কর, আমরা তোমার পিছনে পিছনে উঠছি।
আমি গাড়িতে উঠে তিনটি সিট দখল করলাম। দিপালী আগে উঠে এলো। দিপালীকে বসিয়ে ওর হাতে ব্যাগটা দিয়ে বাকী দু’টা সিটে কেউ যাতে বসতে না পারে সেজন্য নিজে বসে সিট পাহারা দিতে লাগলাম। ভির ঠেলে মেয়ে দু’টিকে নিয়ে দিপালীর স্বামী উঠে এলো। দিপালীর স্বামীকে বসতে দিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। একটু পরে নামার উদ্যোগ নিলাম। দিপালীকে বললাম, তা হলে তোরা ভালভাবে চলে যা, আমি এবার আসি। ওর স্বামীকে বললাম, দাদা-- এবার তা হলে আসি।
দিপালীর স্বামী আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, যাবে তো বুঝলাম, আমার বাড়িতে কি কখনও পদধুলি দেয়া যাবে?
আমি হাসি হাসি মুখে বললাম, সমায় সুযোগ হলে অবশ্যই যাবো দাদা।
দিপালী নিচের দিকে মাথা নত করে ছিল দেখে ওকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি দিপালী, তুমি তোমর ভাইকে কিছু বলছো না কেন?
দিপালী স্বামীর কথায় খুশি হয়ে আমাকে বলল, তুই আমাদের বাড়ি বেড়াতে যাবি কিন্তু, অনেক পরিশ্রম করলি মনে কিছু করিস না। বেড়াতে যাস কিন্তু। সবাইকে আমার শুভেচ্ছা দিস। বলেই আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। চোখ দু’টো জলে ভরে গেছে। ওর স্বামী বিষয়টি লক্ষ্য করল কিনা জানিনা। কারণ সে তখন দাঁড়িয়ে উপরের বাফারে ব্যাগগুলো রাখতে ছিল। বিদায়কালে আমি ওর চোখের জলে ব্যাথিত হলাম। নিজেও ভিজা ভিজা চোখ নিয়ে নেমে এলাম।
এর পর অনেক দিন দিপালীর সঙ্গে দেখা হয় নাই। তবে ওর কান্না কণ্ঠের সেই গান আজও ভুলতে পারিনি। প্রায়ই ওর সেই দুঃখ ভরা মুখ ভেসে ওঠে আর মনে পরে যায় সেই গান--

‘দিপালীর দীপ নিভে গেছে আজি, কি গান গাইবো মনে আসে না----
দুখের সাগরে ডুবে গেছি তাই, সুরের সাথে কথা মেলে না।’
ভেবেছিলাম জীবনে সুখী হয়ে বাঁচবো
দখিন হওয়ায় উড়ে ঘুরে ঘুরে নাচবো
সে আশার গুঢ়ে বালি আজ, মিছে হলো মোর সাধনা
দুখের সাগরে ডুবে গেছি তাই, সুরের সাথে কথা মেলে না।’

(ছবি ইন্টারনেট)
আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচে ক্লিক করুন
গল্প ঃ দিপালী
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:২৯
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×