ভোরের কাগজ : শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
মৌলবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন
:: বোরহান বীজান্ত ::
না, কাজগুলো খুব সহজ তা আমি বলছি না। কারণ বাংলাদেশে মৌলবাদী রাজনীতির শিকড় অনেক দূরে প্রোথিত। তা উপড়ে ফেলা সহজ কাজ নয়। কিন্তু তারপরও সেই শিকড় উপড়ে ফেলার দাবি উঠেছে আজ। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে যখন মৌলবাদী রাজনীতিকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের লেবাসে জায়েজ করা হয় তখন বিষয়টি ভালো করেই জানতেন সামরিক শাসক জে. জিয়াউর রহমান। তিনি রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করতে এই কাজটি করেছিলেন খুব জোরালোভাবে। তার দরকার ছিল- মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের একটি প্যারালাল শক্তি। খান এ সবুর, শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, আলীম আল রাজী, আব্দুল আলীমরা তা লুফে নিয়েছিলেন। ডানপন্থী মুসলিম লীগার, চীনপন্থী কিছু মধ্যস্বত্বভোগী শক্তি জিয়ার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। জামাত তখনো ছিল পেছনে। সামনে আসতে আকটু সময় নিয়েছিল। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন আব্বাস আলী খান। গোলাম আজম তখনো পাকিস্তানে। পাকিস্তানে থেকেই তিনি জামাতের আমির ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। সে কারণেই ‘ভারপ্রাপ্ত’ ছিলেন আব্বাস আলী খান। সে সব কথা আমরা ভুলে যাইনি।
বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষকে ঠেকাতেই জিয়াউর রহমান, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মূল পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন। অথচ জিয়া কি নিজে খুব ধার্মিক ছিলেন? সে প্রশ্নের জবাব তার সমকালীন মানুষেরা খুব ভালো করেই জানেন। জামাতিরা তাদের আসন পাকাপোক্ত করতে চেয়েছে- ছাত্র শিবিরের মাধ্যমে। আশির দশকে ওরা প্রতিটি কলেজে নতুন ‘সাথী’ নির্বাচনের কাজ চালাতো। গ্রাম থেকে উঠে আসা ছাত্রকে ইসলামের দাওয়াতের নামে মূলত মওদুদীর তত্ত্ব বিতরণ করতো। আর এভাবেই তারা শিকড় গাড়তে থাকে। বাধা যে সে সময় দেয়া হয়নি, তা নয়। আওয়ামী ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ সেই সময়েই শিবিরকে দেশের নানা স্থানে প্রতিহত করে। জিয়ার পর এরশাদ এসেও একই কায়দা অব্যাহত রাখেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশকে ‘ইসলামি’ পালক দেয়া হয়। সংবিধান সংশোধন করা হয়। এরশাদের স্বৈরাচারী তখত টিকিয়ে রাখতে ধর্মের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। রাজাকার মওলানা মান্নানকে মন্ত্রিত্ব দেন এরশাদ। আর এ সময় থেকে বাণিজ্যিকভাবে দেশে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে জামাত। বিএনপি জামাতিদের গাড়িতে শুধু মন্ত্রিত্বের পতাকাই দেয়নি, তাদের টাকাকড়িতে পুরো স্বাবলম্বী হবার পথ করে দিয়েছে। ফলে আলবদর-রাজাকারদের বাঁচাতে তারা লাখ লাখ ডলার-পাউন্ড খরচ করতে মোটেই কসুর করেনি, করছে না। এটা হলো অতি সাম্প্রতিক ঘটনা।
জামাত সুযোগ পেলে কী করতে পারে, তার একটি নমুনা বলে দিয়েছে ‘আমার দেশ’ দৈনিকের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। মাহমুদুর রহমান বলছেন- ‘একাত্তরে রাজাকাররা যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছিল, ঠিক তেমনি অনেক মুক্তিবাহিনীও রাজাকারদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। হত্যার দায়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারের সমান অপরাধী। এই সরকার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাজাকারদের বিচার করছে। জামাত সমর্থিত দল যদি কখনো ক্ষমতায় আসে তাহলে রাজাকার হত্যার দায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিচার হবে।’
এই কথাগুলোই জামাতিদের মনের কথা। কারণ তারা জানে তারা ২০০১-২০০৫ সময়ে এদেশে অনেক তা-বের নেপথ্য নেতৃত্ব দিয়েছে। একটা বিষয় খুব স্পষ্ট, একজন বিচারক ব্লগার রাজীব হায়দারকে ‘মুরতাদ‘ বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এটা কার প্রেতাত্মা? জাতীয় সংসদে এই বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মৌলবাদীদের প্রেতাত্মা ছড়িয়ে আছে দেশের বিভিন্ন স্থরে। যা চিহ্নিত করা কঠিন কাজ। তবে মোটেই অসাধ্য নয়। যে বিষয়টি আমি সম্মানিত পাঠক সমাজকে জানাতে চাই, তা হচ্ছে- নয়া দিগন্ত, আমার দেশ কিংবা দিগন্ত টিভিতে এদেশের প্রগতিশীল ব্যক্তিরা এতোদিন অংশ নিলেন কী করে? কিভাবে নয়া দিগন্তে লিখছেন- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, কবীর চৌধুরী এরকম আরো বরেণ্য ব্যক্তিরা? কিভাবে দিগন্ত টিভিতে মুখ দেখাচ্ছেন দেশের অনেক বরেণ্য শিল্পীরা? আজ সময় এসেছে সামাজিকভাবে মৌলবাদীদের বর্জন করার। জানতে চাই, জামাতের মজলিশে শুরা পরিচালিত ‘ইসলামী ব্যাংকে’ প্রগতিশীল রাজনীতিকদের কতোটা একাউন্ট আছে? তারা কি তাদের সে সব একাউন্ট ত্রুত বন্ধ করে, অন্যত্র সরিয়ে নেবেন? তারা তা পারবেন? তাদের পারতে হবে। কারণ প্রজন্ম আজ শাহবাগের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশে। এই আলোতে অনাগত প্রজন্মও অংশ নেবে। তা থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। সম্প্রতি দেশের অন্যতম ওয়েব দৈনিক বিডিনিউজ২৪ ডটকম একটা জরিপ চালিয়েছিল। জরিপে পাঠকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামাতে ইসলামীর কোনো অধিকার নেই বাংলাদেশে রাজনীতি করার। সারা দেশে জামাত নিষিদ্ধের দাবি ওঠার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আপনি কি একমত?’
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বাংলা হোমপেইজের মাধ্যমে এই জরিপে মতামত দিয়েছেন ১৯ হাজার ৭৩২ জন, যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই বলেছেন ‘হ্যাঁ’। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রীর মতো তারাও মনে করেন, বাংলাদেশে জামাতে ইসলামীর রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। আর ১০ শতাংশ পাঠকের মত এসেছে এর বিপক্ষে, অর্থাৎ তারা ‘না’ তে ভোট দিয়েছেন। এছাড়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ইংরেজি হোমপেইজের মাধ্যমে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন দিয়েছেন। আর বিপক্ষে মত এসেছে ১৫ শতাংশ পাঠকের। আদালতের পর্যবেক্ষণের দিকে তাকালে আমরা দেখি- জামাতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জামাতে ইসলামী একাত্তরে ‘পাকিস্তান রক্ষার’ নামে ‘সশস্ত্র বাহিনী’ তৈরির মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করে।
‘যে নিপীড়ন ও নির্যাতন সয়ে, যে রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে নিরস্ত্র বাঙালিকে একাত্তরে মুক্তি অর্জন করতে হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সেই সময়ের বিশ্ব ইতিহাসে আর কোনো জাতিকে বোধ হয় লক্ষ্য অর্জনে এতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি।’ বলা হয়েছে – ‘আর তাদের অধিকাংশ বাংলাদেশের সীমানায় প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনে বর্বর কর্মকা- সংগঠনে নিবেদিত হয়েছিল এবং সহায়তা করেছিল।’ খবর বেরিয়েছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামী ব্যাংক থেকে একাউন্ট বন্ধ করে টাকা তুলে নেয়ার হিড়িক পড়েছে। দেশের মানুষের এই সামাজিক সচেতনতা খুবই জরুরি। ইবনে সিনা হাসপাতাল কিছু শিবির কর্মীর পিতা-মাতার ফ্রি সেবা দিয়ে ঐসব তরুণদের মাথা কিনে নিয়েছে। এদেশে এর বিকল্প কী? তা রাজনীতিকদের ভাবতে হবে। মনে রাখা দরকার- ক্ষুধার পেট বচনে ভরে না। সামাজিক সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি রাষ্ট্রকে নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রত্যয়ী হতে হবে। তা ছাড়া এই পরাজিত শক্তিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে আরো বেগ পেতে হতে পারে।
বোরহান বীজান্ত : লেখক।
মৌলবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন :: বোরহান বীজান্ত ::
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ
একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন
কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।
ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম
স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন
দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ
মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!
বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন