অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সামাজিক-পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করার কোন সম্পর্ক আছে কি না, সেটা সমাজবিজ্ঞানী বা নৃবিজ্ঞানীদের ভালো জানার কথা। খোলা চোখে আমরা দেখি উন্নত দেশগুলোতেই নিউক্লিয়াস ফ্যামিলি, ওল্ডহোমের মত ধারণা সৃষ্টি হয় এবং বাস্তবে তার ব্যাপক অনুশীলনও হয়। বিপরীতে দরিদ্র দেশগুলোর সামাজিক ব্যবস্থায় যৌথ পরিবার ব্যবস্থা প্রবল। এই পারিবারিক ব্যবস্থা টিকে থাকার পেছনে ধর্মের একটা জোরালো ভুমিকা নিশ্চয় থেকে থাকবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে ইসলামে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য ধর্মেও নিশ্চয় একই ধরণের বক্তব্য আছে।
পত্রিকায় একটা খবর দেখলাম, তিন ছেলে পুলিশ কর্মকর্তা, এক মেয়ে স্কুল শিক্ষিকা, তবুও বৃদ্ধা মাকে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করতে হচ্ছে!!! মানুষ হিসেবে এর চেয়ে দুঃখের, কষ্টের, গ্লানীর আর কিছুই হতে পারে না। পত্রিকায় ওই মায়ের ছবি দেখে চোখে পানি ধরে রাখা কষ্টকর। সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরণের খবর একদমই বিরল নয় বরং আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনকে দিন।
অন্যদিকে, মায়ানমারে গণহত্যার স্বীকার হওয়া রোহিঙ্গারা যখন প্রাণভয়ে পালিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে আসছে, সেই সব ছবিও বিস্তর প্রকাশিত হচ্ছে পত্রপত্রিকায়। বাংলাদেশের ওই মায়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গা মায়েদের-বৃদ্ধ বাবাদের ছবিও আমরা দেখছি। এই জীবন মরণ সমস্যার সময়েও কিশোর, যুবক, পৌঢ় রোহিঙ্গা ছেলেরা বৃদ্ধ বাবা-মাকে পিঠে কাঁধে চড়িয়ে, মাথায় তুলে, টুকরিতে বা চেয়ারে বসিয়ে মাইলের পর মাইল হেটে বাংলাদেশে আসছে।
ওদের কিসের এত জোর, আর আমাদের খামতিটা কিসে? ব্লগের ‘লিভিং লেজেন্ড’ চাঁদগাজী এবং আরো অনেকে রোহিঙ্গাসংক্রান্ত বিভিন্ন পোস্টে বা মন্তব্যে রোহিঙ্গাদেরকে শিক্ষাহীন, দরিদ্র, ধর্মপরায়ন এবং যুগ যুগ ধরে অসভ্য হিসেবে কটাক্ষ করেছেন দেখছি। অনেকে আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রোহিঙ্গারা আমাদের সাথে কি কি অন্যায় করেছেন, সেগুলোও খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন দেখেছি। কিন্তু উন্নত দেশের ইষদুঞ্চ কামরায় বসে প্রতিনিয়ত ধর্মহীন ও জাগতিক হওয়ার দীক্ষা দেওয়া চাঁদগাজী বা তার মত যারা, তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন জাগতিক মোহে অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিনতি কি? ধরতে পারছেন অশিক্ষিত, দরিদ্র আর ধর্মপরায়ন অসভ্য রোহিঙ্গাদের সাথে শিক্ষিত, ধর্মনিরেপেক্ষ এবং নব্য পুঁজিবাদি আমাদের পার্থক্যগুলো কোথায়?
ঠিক এই যায়গাটাতে আমরা ক্রমেই হেরে যাচ্ছি রোহিঙ্গাদের মত অশিক্ষিতদের কাছে। আমাদের প্রগতি আমাদের আত্মীয় স্বজনদেরকে অস্বীকার করতে শিখাচ্ছে। আমাদের মূল্যবোধগুলোকে গিলে খাচ্ছে। বুঝতেও পারছি না যে, আজকের শক্তিশালী যুবক আমাকেও একদিন বৃদ্ধ হতে হবে।
আমরা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করেছি। অসংখ্য বাংলাদেশি নিঃস্বার্থভাবে সাহায্যও করছি। তবুও ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের মত অনেক বাংলাদেশিই এখনও সহযোগিতায় স্বার্থহীন হতে পারিনি। একটা নিউজ দেখলাম, অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় এমপি ইয়াবা বদির নেতৃত্বে একটা সিন্ডিকেট রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অত্যন্ত কম মূল্যে তাঁদের মূল্যবান অলংকার কিনে নিচ্ছে। একইভাবে মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে প্রচন্ডভাবে ঠকানো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
আমাদের অতিশিক্ষা এইসবই শেখাচ্ছে আমাদেরকে। নিতান্তই দুর্ভাগ্য আমাদের। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দিকে যথাসময়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সত্যিকার মানবিকতা দেখানোর যে সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম, যৌথ অভিযান পরিচালনার প্রস্তাব দিয়ে প্রথমেই আমরা সেটা হারিয়েছি। এভাবে অমানবিকতার প্রাতিষ্ঠানিকরণ, রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে আমরা এখন নোবেল পাওয়ার লোভে উদগ্রীব হয়ে আছি।
যখন আমরা ক্রমেই একটা অমানবিক সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছি, সেই একই সময়ে, এই দুঃসহ সময়েও রোহিঙ্গারা মানবিকতার চুড়ান্ত উদাহরণ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। মৃত্যুবরণ করেও ওরা তাই জিতে যাচ্ছে আর নিরাপদে নির্বিঘ্নে বেঁচেও আমরা হেরে যাচ্ছি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৩১