ইয়ার এন্ডিংয়ে ব্যাংকের হুলুস্থুল ব্যস্ততার পাশাপাশি পারিবারিক কিছু ঝুটঝামেলায় বেশ কিছুদিন ব্লগাড্ডায় আসতে পারিনি। ফলাফলও নগদে পাচ্ছি; আমার মত দুর্বল, পার্টটাইম লেখকদের যা হয় আর কি! কোন লেখা আর আসতে চাচ্ছে না। তুমুল সাধ্য সাধনার পরও লেখার কোন বিষয় খুঁজে পাচ্ছি না, বিষয় পেলেও কার্তিকের এই মরা রোদ্দুরে এমন অলসতা ভর করে যে নিজেকে বিএনপির কর্মী মনে হয়- আন্দোলনে বড় আলস্য।
যাই হোক, টিভি নিউজে দেখলাম যশোর রোডের প্রাচীন বৃক্ষগুলো কেটে ফেলা হবে। নিউজটা দেখার পর থেকেই ভাবছি কিছু একটা লিখব। কিন্তু সে আশাও বিফলে যাওয়ার উপক্রম! ব্লগের ফ্রান্ট পেইজে এই গাছগুলো নিয়ে এত বেশি পোস্ট, এত কবিতা আর আবেদন, ঘাবড়েই গেলাম, আমি আর কি লিখব?
তবুও মনে হচ্ছে কি যেন হারিয়ে ফেলছি। এই গাছগুলোর সাথে আমার কত স্মৃতি, কত ভালোবাসা... এই সবুজের মায়াতেই তো আমি বেড়ে উঠেছি। স্কুলে যাওয়া আসার পথে এই গাছগুলোই নিরন্তর ছাঁয়া দিয়ে আমাদের শৈশব, কৈশোর পার করিয়েছে। কত বর্ষায় এই গাছগুলোর তলে আশ্রয় নিয়ে না ভিজেই পার করে দিয়েছি খেকশিয়ালের বিয়ের বৃষ্টি। ঝাঁ চকচকে মহাসড়কের অভিভাবকই ছিল এই গাছগুলো।
এক চৈত্রের বিষন্ন মধ্যাহ্নে রসায়নের খটোমটো ক্লাস পাশ কাটিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম দু’জন লোক ঝিকরগাছার বি এম স্কুলের সাথের রাস্তার একটা গাছে চড়ে কিভাবে ওই গাছেরই বড় একটা ডাল কাটছে। বিশাল এক করাতের একতালে টান আর একঘেয়ে শব্দ সেদিন যতটা মনোযোগ কেড়েছিল, তার ভগ্নাংশও বুঝতে পারিনি গাছ কেটে ফেলার কি ভয়াবহতা। আজকের দিনে রাজধানীর কংক্রিটজঙ্গলে যখন নিঃশ্বাস আটকে আসতে চায়, তখন হিমুর সেই ময়ুরাক্ষী নদীর মত এই যশোর রোডের শতবর্ষী গাছগুলোও আমার কল্পনায় এসে ছায়া দিতে শুরু করে। আমি প্রশান্ত হয়ে যাই।
আজ প্রিয় সবুজের এই গাছগুলোই কেটে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র আর স্থানীয় হায়েনারা। অথচ কবির সুমন সেই কবেই গেয়ে গেছেন "আমি চাই গাছ কাটা হলে শোকসভা হবে বিধানসভায়-আমি চাই প্রতিবাদ হবে রক্তপলাশে, রক্তজবায়"
যশোর রোডের এই গাছগুলো শুধু দেশের ভেতরে না, দেশের গন্ডী পেরিয়ে ভারতেও এই সড়ক আর গাছগুলো কি সুন্দরভাবেই না দুই দেশের সংস্কৃতিকে একই সূত্রে গেঁথে রেখেছে। কবির সুমনের সুরে সুর মিলিয়ে ওরা সেই গাছগুলো সযতনে রেখে দিলেও আমরা লোভের কাছে আত্মসমর্পন করে ফেললাম।
জানি এই গাছ থাকবে না। শকুনোর নজরে পড়া আরো অনেক অনেক গাছের মত এই গাছগুলোও খেয়ে ফেলবে এই হায়েনার দল, যেমনভাবে খেয়েছে রাজধানীর সকল গাছ, সকল সবুজ। শেরাটন মোড়ের ঝাকড়াঁ নাগলিঙ্গম গাছটা আমি কোনভাবেই আমার স্মৃতি থেকে তাড়াতে পারি না। যে দেশে সুন্দরবনের মত উপকারী আত্মীয়েরই কোন মূল্য থাকেনা, সেই দেশে গাছ কাটা হবে দেদারছে, পথে ঘাটে প্রান্তরে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের দেশেই তো টিভি কমার্শিয়ালে শোনা যায় ‘কাটো গাছ-খাও মাছ।’
হয়ত এর পরেরবার যখন ঝিকরগাছা যাবো, সেই সবুজ আর পাবো না, পুলেরহাট পার হওয়ার পরপরই যে মাদল জাগানো ছাঁয়া আমাকে ভীষণ মমতায় আঁকড়ে ধরতো, সে ভালোবাসাও আর পাবো না। বৃথায় এখানে লেখা আর আকুতি জানানো।
তবুও, আমার প্রিয় এক শিক্ষকের কথা- ‘নিজের জন্মস্থানের মানুষ-মাটি-হাওয়া-বৃক্ষ-সবকিছুর কাছেই মানুষ আজীবন ঋণী থাকে, এরাই তাকে বড় করে।’ সেই ঋণ থেকেই ইচ্ছে হচ্ছে, যশোর চলে যাই, কর্তা-অধীকারীদের কাছে করজোড়ে মিনতি করি, মারবেন না এদের, এরাই আমাকে বড় করেছে, আমাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়েছে।
তার প্রতিদান এভাবে হতেই পারে না।
ছবিসূত্র:
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:৫৮