এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলন আমাদের দেশীয় গণমাধ্যমের নতজানু এবং চাটুকারি চরিত্র উম্মোচনে সাহায্য করেছে। এই আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করার যে প্রবণতা গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তা সহসাই উদয় হয়েছে ভাবলে ভুল হবে; বরং এটা অতীতের বিভিন্ন অন্যায্য কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা মাত্র। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নিউজ ফেব্রিকেটেড করার যে বিষবৃক্ষ দেশীয় গণমাধ্যমে বেড়ে উঠেছে, তারই কুফল হচ্ছে এই সেলফ সেন্সরশিপ। ধারণা করি, শাপলা চত্বরে হেফাজতের উপর আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর ক্রাকডাউনের রাতে সরকারের তরফে গণমাধ্যমে তথ্যপ্রবাহে নিষেধাজ্ঞার যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল, চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে সেটাই এখন গণমতকে অস্বীকার করতে শেখাচ্ছে।
আপনাদের স্মরণে আছে, কিছু বছর আগে এই শাহবাগেই যে গণআন্দোলন হয়েছিল, আমাদের গণমাধ্যমগুলো সেখানে খুবই তড়িৎগতিতে পৌঁছে গিয়েছিল। অস্থায়ী-স্থায়ী বিভিন্ন মঞ্চ বানিয়ে ২৪ ঘন্টাই বিরতিহীন সম্প্রচারের মাধ্যমে ওই আন্দোলনকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিতে গণমাধ্যম প্রধানতম অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল। অথচ সেই একই গণমাধ্যম শাহবাগে যখন আরেকটি তারুণ্যের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তখন সেই আন্দোলনের খবরকে শুধু ব্লাকআউটই করছে না, বরং নস্যাৎের সুক্ষ্ণ অপচেষ্টা জারি রেখেছে। গত কয়েকদিনের গণমাধ্যম, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদপ্রবাহ খেয়াল করুন, দেখবেন তারুণ্যের এই আন্দোলনকে অসহযোগিতা করতে এরা কত ধরণের অপকৌশল ব্যবহার করছে।
ভুরি ভুরি উদাহরণ পাবেন। যেখানে আন্দোলনকারীরা বলছে কোটা সংস্কার, গণমাধ্যম বলছে কোটাবিরোধী। আন্দোলনকারীরা বলছে কোটা সীমিত করার কথা, গণমাধ্যম বলছে কোটা থাকবে কি থাকবে না। আন্দোলনকারীরা বলছে কোটার ন্যায্যতা, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা। আন্দোলনের ব্যাপকতা যখন দেশব্যাপী, গণমাধ্যম তখন শুধু ঢাকার আন্দোলনের উপর ফোকাস করছে... এ ধরণের আরো অনেক কিছুই বলা চলে।
বলাবাহুল্য যে আন্দোলনকারীরা, যাদের শতভাগ ছাত্র এবং তরুণ, তারা গণমাধ্যমের এই ভূমিকাকে নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে। একাত্তরের একটা ক্লিপিংস দেখলাম ইউটিউবে, একজন ছাত্র টেলিফোনে সরাসরি বলছে ‘আপনারা এই বলেছেন, সেই বলেছেন...’আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর বাইকে টিভির লোগো দেখে তিতুমীর কলেজের সামনে ছাত্ররা পাকড়াও করে যথাযথ কাভারেজ না দেওয়ায় তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
অফিসে আমার একজন সহকর্মী, যিনি একই সাথে একটি প্রথম শ্রেণীর টিভি স্টেশনের সংবাদ উপস্থাপক, তিনি জানালেন, আন্দোলনকারীরা সেতুমন্ত্রীর সাথে আলোচনা শেষে আন্দোলন সাময়িক স্থগিতের ঘোষণা এবং সে ঘোষণা প্রত্যাখান করে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে ওইদিন রাতের সংবাদে যখন শিরোনাম করা হলো “সেতুমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা প্রতিনিধিদের- প্রত্যাখান করে আন্দোলন বহাল রেখেছে একাংশ”, তখন চিফ নিউজ এডিটরের নির্দেশে “প্রত্যাখান করে আন্দোলন বহাল রেখেছে একাংশ” কথাটুকু তাৎক্ষণিকভাবে বাদ দেওয়া হয়। আমাদের গণমাধ্যম এভাবেই এই আন্দোলনকে হিউমিলিয়েট করার প্রক্রিয়া জারি রেখেছে।
গণমাধ্যম সমাজ নির্মাণ করে, সমাজের ভুলগুলোকে নিরুপণ করে। সবসময়ই এস্ট্যাবলিশমেন্টকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন অব্যাহত রাখে। এ জন্যই গণমাধ্যমকে ফোর্থ স্টেট বলা হয়। আমাদের গণমাধ্যমের ইতিহাসও একইরকমভাবে উজ্জল। স্বাধীনতার অব্যবহিতকাল পরে গণমাধ্যমের একটা অংশের মাধ্যমে নৈরাজ্যে ইন্ধন যোগানোর অভিযোগ বাদ দিলে মোটের উপর আমাদের গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়।
কিন্তু বর্তমান সময়ে কর্পোরেটগুলোর লেজুড়প্রতিষ্ঠান হওয়ার মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম সে চরিত্র হারিয়ে পুরোপুরিভাবে নতজানু এবং চাটুকার হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করতে সমর্থ হয়েছে। এই গণমাধ্যম আমাদের অত্যাচারী ক্ষমতাকে কোনো প্রশ্ন করার সাহস রাখে না, বরং নিয়ত স্তুতিবাক্যে তাকে অন্ধ করে রাখে। এই গণমাধ্যম নৈতিকতাকে উচ্চ করে না, বরং নিজেরাই ভণ্ডামীর চুড়ান্ত উদাহরণ তৈরী করে। এই গণমাধ্যম অন্যায়ের বিরোধিতা করে না, বরং নিজেরাই অন্যায়কে লালন করে। এই গণমাধ্যম এখন পর্যন্ত জোরালো প্রশ্ন তোলেনি যে ন্যায্য দাবিতে চলা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি আন্দোলনে কেন গুলি, টিয়ারশেল চালানো হলো।
গত শতকের শেষের দিকে যখন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সম্প্রচারে চলে আসে, তখন মূলধারার চ্যানেল বিটিভির কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের এলিটিয় অহম বিসর্জন দিয়ে নতুনের জোয়ারকে মানতে চায়নি। চ্যানেলগুলোর দিকে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়েছে। বোধকরি এখনও একই মনোভাবেই রয়ে গেছে বিটিভি। তাতে করে নতুন চ্যানেলগুলোর উন্নতিতে কোন বাঁধা সৃষ্টি হয়নি, বরং বিটিভিই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
এ সময়ের মুলধারার গণমাধ্যম এখন নিওমিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দিকে বিটিভির সেই এলিটিয় অহম নিয়ে তাকাচ্ছে। মুলধারার গণমাধ্যম সহায়তা ছাড়ায় যে এখন সমাজের অনেক কিছুই সম্ভব, এই বাস্তবতা বর্তমানের গণমাধ্যম মানতে পারছে না বলে আমার মনে হচ্ছে এবং এই দোটানার মধ্য দিয়ে গণমাধ্যম যে গণবিরোধী ভুমিকা পালন করছে, তা যদি জারি থাকে তবে এই গণমাধ্যমের নৈতিক পরাজয় খুব শীঘ্রই নিশ্চিত হবে। তবে আশার কথা হলো, গণমাধ্যমের এই ভূমিকায় পরিবর্তনের আভাস আসছে।
আক্ষেপের কথা হলো, সামহ্যোয়ার ইন এখন পর্যন্ত এই ন্যায্যদাবির পক্ষে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেনি, যেটা আরো আগেই হওয়া উচিৎ ছিল।