যে সব কারণে আমি ফেসবুককে অপছন্দ করি, তার মধ্যে অন্যতম হলো, ফেসবুক মানুষের ঔচিত্যবোধ নষ্ট করে ফেলে। কোথায়, কোন পরিস্থিতিতে কি বলতে হয়, সেই সুক্ষ রুচিটাই লোপ পেয়ে যায়। অথচ আবহমান কাল ধরে বাঙালির গর্ব করার মত এই রুচিবোধ সহজাত হিসেবেই ছিলো। ফেসবুক এই যায়গাটা এমনভাবে ধ্বংস করেছে যে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে ভারতকে হারানোর বিমলানন্দে একটা ব্যাংকের পঞ্চান্নোর্দ্ধ অত্যন্ত মান্যবর এক অতি উর্দ্ধতন নির্বাহী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ফেললেন “দিলাম বাঁশ ভইরা!”.... । একবারও ভাবলেন না যে এই রকম একটা বক্তব্য তাঁর বয়স, অবস্থান এবং সামাজিক মর্যাদার সাথে যায় কি না।
এটা সামান্য একটা উদাহরণ মাত্র। আপনারা সবাই এ রকম স্ট্যাটাস অহরহই দেখে থাকবেন।
তবুও রক্ষে ছিলো যে এই বুদ্ধিনাশা ব্যাপারটা শুধু ভার্চুয়াল জগতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু সে বাঁধ ভাঙার আওয়াজ খুব জোরালোভাবে শোনা যাচ্ছে ইদানিং। সহসায় হয়তো সব বাঁধা অতিক্রম করে ফেলবো আমরা। আজকের প্রথম আলোয় দেখলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় বলেছেন জীবদ্দশায় একবার হলেও তিনি সাবেক বিচারপতি এস কে সিনহাকে পেটাতে চান!!!!আহা, মধু মধু... এই না হলে হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র উপাচার্য। ক্যাথলিক মোর দ্যান দ্য পোপ!!! সূর্যের ’চে বালি গরম। শুধু গরম না, তেতে পুরো অঙ্গার হয়ে গেছে।
আমি হতভম্ভ। আক্ষরিক অর্থেই এটা পড়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। মোবাইল ফোনে একবার দেখলাম। মিনিট দশেক পর এই নিউজের প্রতিক্রিয়ায় কি মন্তব্য এসেছে দেখার জন্য আবার প্রথম আলোর সাইটে ঢুকে ওই নিউজটা পাচ্ছিলাম না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম হয়তো ভূলভাল কিছু একটা হয়েছিলো। অথবা জাতীয় স্বার্থে নিউজটা উইথড্র করেছে প্রথম আলো (আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ ধরণের নিউজ জাতীয় জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে)। কিন্তু হা হাতোম্মি! সকালে আবার একই নিউজ!
একজন উপাচার্য শোক দিবসে আলোচনা করবেন, এতে খারাপ কিছু নেই। বরং ইন এ সেন্স, এটা তাঁর দায়িত্বই। কিন্তু মুখের এ কি হাল আমাদের উপাচার্য মহোদয়ের? সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজের ভঙ্গুর ব্যক্তিত্ব দিয়ে নিজেকে বিশ্ববেহায়া এরশাদের পর্যায়ে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও ভালোই পারফর্ম করছেন। তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উপাচার্য আর পিছিয়ে থাকবেন কেনো? এটাতো তার অধিকার। ভিসিরাও মানুষ!
অযথাই আমরা প্রশ্নফাঁস জেনারেশন, ইন্টারনেট আসক্ত জেনারেশন, ঘরকুণো প্রজন্ম ইত্যাদি ইত্যাদি বলে আক্ষেপ করি। আরে, ওরাই তো ভালো। ভাগ্যবান। ভাগ্যিস প্রশ্নফাঁসের সুযোগ ছিলো! নইলে ওরা ভালো করে পড়তো, আরো বেশি জানতো, তাতে করে না চাইলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষায় উৎরে গিয়ে ভর্তি হতো। তার ভর্তি হলেইতো এই সব মেনিমুখো অমানুষদের হাতেই পড়তো।
আহা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আমার মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা আর ইংরেজি টিচারের জন্য। ক্লাস নাইনের বাংলা পরিক্ষার হলে হঠাৎই বিদ্রোহ করে বসলাম, পরিক্ষা দেবো না। এই স্যার আমাদের ঠিক মত পড়াননি। আমার সাথে সাথে বেশিরভাগ স্টুডেন্টও আমার সমর্থনে খাতা কলম রেখে উঠে দাঁড়ালো। পুরো পরিক্ষার হল স্তব্ধ, টিচাররা হতভম্ভ। মফস্বলের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ রকম কিছু যে হতে পারে, তাঁদের দুরতম কল্পনাতেও তা ছিলো না। এর একদিন পর ইংরেজি পরিক্ষা। সেদিন আবার আরেক পক্ষ উঠে গেল যে ইংরেজির স্যারও ঠিক মত পড়াননি। উনি আবার ভাইস প্রিন্সিপাল। পুরো এলাকায় একটা আলোড়ন পড়ে গেলো। রাস্তা দিয়ে হাটলে লোকজন আঙুল তুলে দেখাত লাগলো।
স্যারেরা প্রথমে ধমক ধামক, তারপর পিঠে হাত বুলিয়েও আমাদেরকে আর পরিক্ষায় বসাতে না পেরে গণভাবে সবার গার্জিয়ানদের সাথে যোগাযোগ করলেন। শেষমেষ একটা ক্ষমা চাওয়ার পর্বের মাধ্যমে এই অচলাবস্থার অবসান হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এই বক্তব্য পড়ার পর নিজেকে খুবই হীন মনে হচ্ছে। অপরাধী লাগছে। মনে মনে খুবই অনুতাপ হচ্ছে, আহা, আমার ওই শিক্ষকেরাতো আর এ ধরণের অমানুষ ছিলেন না। তাঁরা আমাদের ঠিকমত পড়াতে পারেননি, কারণ তাঁদের সীমাবদ্ধতা ছিলো। ক্লাস শেষ করে উনাদেরকে হয় মাঠে ধান চাঁষ করতে যেতে হতো, নয়তো স্বল্প আয়ের হোমিওপ্যাথির ডাক্তারি করতে হতো অথবা টুপি/তসবিহ বিক্রির দোকানের মত দোকান চালিয়ে সংসারের ভার লাঘবের চিন্তা করতে হতো। যে কারণে ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারতেন না।
উনারা দুর্বল ছিলেন, দালাল ছিলেন না। দরিদ্র ছিলেন কিন্তু লোভী ছিলেন না। ভাবছি এবার ছুটিতে বাড়ি গেলে ওই স্যারকে খুঁজে সত্যিকার ক্ষমা চেয়ে আসবো।
ছোটবেলার পাঠ্য বইয়ে “শিক্ষকের মর্যাদা” শিরোনামে একটা কবিতা পড়েছিলাম, কবি কাজী কাদের নেওয়াজ এর লেখা। শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা, দৃঢ়চেতা মনোভাব এই কবিতায় বর্ণনা করা হয়েছে। শিক্ষকতো এমনই হবেন। হওয়ারই কথা। পড়ুন কবিতাটা একবার-
বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।
তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, “শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা ¯স্বয়ং সকাল বেলা”
শিক্ষক কন-“জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?”
বাদশাহ্ কহেন, “সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়াইয়া সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
“আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।”
অথচ আজ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সবোচ্চ পর্যায়ে এমন কিছু অশিক্ষক, নূজ্জ্ব্য, চাটুকার, স্বার্থলোভী লোকেরা জেঁকে বসেছে যে এদের মুখ দিয়ে জ্ঞানের কথা নয়, গরল বের হয়। এদের আচরন দেখলে সম্মান নয়, করুণা আসে। এদের কাছ থেকে কিছুই শেখার নেই।
আজকে এই উপাচার্য যে কথাটা বললেন, একবারও ভাবলেন না এই কথাটা তাঁর মান মর্যাদা, পেশা, সামাজিকতার সাথে যায় কি না। উপরন্তু উনি যাঁর সম্পর্কে এই কথাগুলো বললেন, সেই এস কে সিনহার গ্রহণযোগ্যতা, প্রখর ব্যক্তিত্ব, কোনো কিছুর ধারে কাছে কি তিনি পৌঁছুতে পারবেন? উনি জানেন না যে এস কে সিনহাকেই “সুবোধ” হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিলো?
আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, যে দীর্ঘদিন এই ক্যাম্পাসে শিবিরের একক রাজত্ব ছিলো, উনার ভূমিকা তখন কি ছিলো? নাকি উনার নিজেরই বলা কথা “এখন অনেককেই দেখছি, যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জীবনে একটা লেখা লিখেনি, বঙ্গবন্ধুর জন্য একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। আজ তারা বঙ্গবন্ধুর বিশাল সৈনিক।” আসলে উনার জীবনেরই কথা? মাননীয় উপাচার্য, আপনাকে দেখে আজ মনে হচ্ছে বাংলা ভাষার দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য প্রবাদটা সার্থক।
হযরত আলীর একটা বাণী আছে, তিনি বলেছেন বলেছেন: যখন দেখবে দরিদ্ররা ধৈর্যহারা হয়ে গেছে, ধনীরা কৃপণ হয়ে গেছে, মুর্খরা মঞ্চে বসে আছে আর জ্ঞানীরা পালিয়ে যাচ্ছে এবং শাসকেরা মিথ্যা কথা বলছে, তখন বুঝবে যে ওই দেশ ও সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে। এই সব উপাচার্যদের দেখে আজ মনে হচ্ছে হযরত আলী আমাদের দেশের কথা মাথায় রেখেই এই কথা বলেছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩৫