somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্থানে অন্তর্ভুক্ত হলো যেভাবে : ইতিহাসের পথ ধরে একটি বিশ্লেষণের চেষ্টা

২১ শে আগস্ট, ২০০৯ দুপুর ২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রাক-কথন :

বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী শুরু থেকে অংশগ্রহণ করে এসেছে । শেষ দিকে এসে একদিকে হিন্দু ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদ প্রভাবান্বিত কংগ্রেসী আন্দোলন এবং অপরদিকে হিন্দু-মুসলিম দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম লীগের পাকিস্থান আন্দোলন দানা বাঁধতে লাগলো । পাহাড়ী জনগনের বেশীরবাগই বৌদ্ধ কিংবা প্রকৃতিপূজারী । তাদের পক্ষে আন্দোলনের এই ধারায় সামিল হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে । সেদিনের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস, দ্বি-জাতিতত্ত্ববাদী মুসলিম লীগ নেতৃত্ব, অথবা তৎকালীন কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব - কেউই এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবতে পারেনি ।

১৯১৫ সালে রামমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে চাকমা যুবক সমিতি গড়ে ওঠে এবং ১৯২৮ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ানের নেতৃত্বে চাকমা যুবক সংঘ তৈরী হয় । এগুলো তেমন স্থায়ীত্ব পায়নি । তবে ১৯২০ এর দশকে কামিনী মোহন দেওয়ান ও বীরেন্দ্র কিশোর ত্রিপুরার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি । এই সংগঠনকে ঘিরে পাহাড়ী জনগন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হলেও তারা মুসলিম লীগ কিংবা কংগ্রেসী ধারার কোনোটির সাথেই যুক্ত হতে পারছিল না । কামিনী মোহন দেওয়ানের সাথে কংগ্রেসী নেতা-কর্মীদের আলাপ- আলোচনা প্রসঙ্গের তাঁর লেখা থেকে আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারবো যে সেদিন কী পরিস্থিতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজ করছিল । তিনি লিখেছেন -

"....... আমি স্বাধীনতার জন্য তোমাদের দলে যোগ দিতে পারি বটে যদি তোমরা আমাকে আরও একটি প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর দিতে পারো । তাহা হইলো এই ভাবত স্বাধীন হইলো অর্থে ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু ও মুসলমানেরাই স্বাধীন হইলো বুঝিতে হইবে , কিন্তু সংখ্যালঘু অন্যান্য উপজাতি ও বাঙ্গালী বড়ুয়া প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশেষতঃ আমাদের চাকমা জাতির বেলায় কী নীতি অবলম্বিত হইবে বলিয়া তোমরা মনে কর ? তাহারা বলিল, স্বাধীনতা অর্থে জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে সমান অধিকার লাভে সমর্থ হইবে । ইহাতে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বলিয়া থাকিবে না । আমি বলিলাম, ইহা শুনিতে ও বইতে লিখিত বর্ণনা শ্রবণ করিতে শ্রুতিমধুর বটে, কিন্তু বাস্তব জীবনে কতটুকু কার্যকরী হয়, ইহা চিন্তা করিয়া দেখিবার বিষয় । আমি ইহাও বলিলাম, মনে করো তোমার পরিবারে শিশু-যুবা-বৃদ্ধ প্রভৃতি বিভিন্ন বয়সের লোক আছে । বাড়ির কর্তা যদি শিশু ও যুবাকে সমান অবস্থায় থাকিবার ব্যবস্থা করেন, তবে পক্ষপাত দোষ হইলো না বটে, তবে তখন শিশুদের অবস্থা কী হইবে বলিয়া মনে হয় ? মনে কর দৌড় প্রতিযোগিতায় বালক, বৃদ্ধ, যুবা প্রভ্বতি সকলকে একসঙ্গে অংশগ্রহনে বাধ্য করিলে ইহার পরিস্থিতি কী দাঁড়াইতে পারে তাহা ভাবিয়া দেখিবার বিষয় । আমরা হিন্দু-মুসলমান সভ্যতা গর্বে গর্বিত জাতির তুলনায় নাবালক শিশুমাত্র । আরও একটি বিষয় ভাবিয়া দেখিতে হয়, একদিন আমরা স্বাধীন ছিলাম । এখনও প্রায় অর্ধেক সায়ত্বশাসনের সুবিধা ভোগ করিয়া আসিতেছি । জাতীয় মোকর্দমাদি আমরা নিজেরা নিষ্পত্তি করিয়া থাকি । স্বাধীনভাবে যে কোন স্থানে স্থানান্তর ক্রমে বসবাস করিয়া থাকি । এই জন্য কোন জায়গা খরিদ বা বন্দোবস্ত গ্রহণ করিতে হয় না । পারিবারিক ব্যবহারের জন্য যে কোন বনজ সম্পদ বিনা বাঁধায় ব্যবহার করিতে পারি- ইত্যাদি বহুবিধ সুবিধা , একই আইন বা নিয়মের অধীন থাকিতে হইলে এইসব সুবিধা হইতে বঞ্চিত হইয়া পাহাড়ীরা কদাপি আত্মরক্ষা করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারিবে না । যেমন সভ্য জাতির সঙ্গে সংমিশ্রনে পৃথিবীর বহু উপজাতি বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে ।........তাহারা বলিল, নেতৃস্থানীয় লোক ভিন্ন ইহার বিষয়ে সঠিক উত্তর প্রদান সম্ভব নহে ।

বহু শীর্ষস্থানীয় নেতার মধ্যে ভারতের শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসাবে মহাত্মা গান্ধীকে মানিয়া লইতে বোধহয় কাহারো আপত্তি থাকিবে না । ........বোম্বে পৌছাইয়া গামদেবী রোড নামক রাস্তায় এক প্রকান্ড অট্টালিকায় তাহার সহিত দেখা করতঃ উক্ত প্রশ্নসমূহ জিজ্ঞাসা করিলাম । তিনি একটি উত্তরেই তৎক্ষনাৎ সর্ব প্রশ্নের উত্তর দিলেন । তিনি বলিলেন- " গণতান্ত্রিক রাস্ট্রের নিয়মে জনগন যেই প্রকার শাসন চাহে, তাহাই পাইবে ।".....

".....বৃটিশ গভর্নমেন্ট জনতার অনমনীয় প্রেরণা অস্ত্রবলে গতিরোধ করিবার সম্ভাবনা না দেখিয়া তাহার চিরাচরিত নীতি ও স্বভাব মতে ভারতে হিন্দু-মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির অঙ্গে পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ ও বিদ্বেষের বীজ বপন করিয়া অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানের কথা ঘোষনা করিল । এই ঘোষনার বাণী শুনিয়া এই পার্বত্য জাতিদের মনেও এক নতুন চিন্তা ও নতুন প্রেরণার ভাব জাগিয়া উঠিল । ভারত স্বাধীনতা লাভ করিলে আমরা হিন্দু-মুসলমান দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির অধীনে থাকিয়া, স্বীয় জাতির স্বাতন্ত্র রক্ষা করার সম্ভাবনা আছে কিনা তদ্বিষয়ে চিন্তা করিয়া কর্তব্য নির্ধারন করিবার সময় উপস্থিত হইলো । কাল প্রভাবে আমরা নগন্য সংখ্যায় পর্যবসি্ত হইলেও এক সময় আমরাও স্বাধীন ছিলাম । অতএব এই সুযোগে আমাদের পূর্ব গৌরব ও সংস্কৃতি রক্ষাকল্পে কিছুটা সায়ত্বশাসন লাভে সচেস্ট হওয়া প্রয়োজন । কিন্ু কী প্রকারের সায়ত্বশাসন আমাদের উপযোগী হইবে - ইহা লইয়া আমাদের মধ্যে তিন শ্রেণীর লোকের আবির্ভাব দেখা দিল ।

চীফেরা চাহেন রাজতন্ত্র প্রথানুরুপ শাসনপদ্ধতি । জনসমিতির এক পক্ষের লোক (স্নেহকুমার চাকমার পক্ষীয়) চাহেন জনগন কতৃক শাসন ক্ষমতার অধিকার লাভ । আমি ও আমার দলীয় লোকেরা চাই, সমাজের নেতা কিংবা রাজা হিসাবে এই পদকে নির্বিঘ্ন ও স্থায়ী করিবার জন্য এমন এক শাসন নীতি প্রবর্তন আবশ্যক, চীফ বা রাজারুপে যিনি থাকিবেন, তিনি সকলের শিরোমনি গণ্য হইয়াও স্বীয় খেয়ালের বশে কিংবা স্বার্থসুবিধার খাতিরে ইচ্ছে করিলেও যেন প্রজার ক্ষতি কিংবা উন্নতির বিঘ্ন করিবার উপায় না থাকে । "


এই লেখা থেকে দেখা যায়, প্রধান দুই ধর্মাবলম্বী হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারত বিভক্তিতে তাদের অংশগ্রহণ যেমন ছিল দুরূহ, তেমনি নিজেদের কর্মপন্থা নিয়েও তারা ছিল বিভক্ত । ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে সাম্প্রদায়িকতার জোয়ার যখন তুঙ্গে এবং দেশ ভাগাভাগির দেন দরবারে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ ব্যস্ত তখন জাতীয় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছে সরেজমিনে তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার জন্য কংগ্রেস নেতা এ.ভি. ঠক্করের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল রাঙ্গামাটি এসেছিলেন । ঐ আলোচনা সে মুহূর্তে পার্বত্য জনগনের কাছে ভারত কিংবা পাকিস্থান কোন অংশের সাথে তাদের ভাগ্য জড়িত হবে- এর বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিল না । পাকিস্থানের চে ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্তিতেই তারা আগ্রহী হবে - সেটাই স্বাভাবিক । কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব তাদের সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হন ।

অন্যদিকে তিনটি সার্কেলের রাজারা (শাসনকাজের সুবিধার জন্য বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে ঃ চাকমা। বোমাং ও মং । প্রতিটি সার্কেলে একজন রাজা নিযুক্ত হন । এটি করা হয় ১৮৬০ সালে । ) বৃটিশ , কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কাছে ধর্ণা দিয়ে দেশীয় রাজ্যের মর্যাদা ও তাদের প্রথাগত রাজকীয় ব্যবস্থা ভাল রাখার দাবী করেছিলেন । সেখানে তেমন সাড়া না পেয়ে পরবর্তীতে তিন সার্কেল, ত্রিপুরা, কুচবিহার ও খাসিয়া রাজ্যকে নিয়ে কেন্দ্র শাসিত কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব রাখেন । সেটাও ব্যর্থ হলে ১৯৪৬ সালে চাকমা রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ী সমিতি(hillman association) গড়ে ওঠে । সমিতির উদ্দেশ্য ছিল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া ও রাজন্য ব্যবস্থা বলবৎ রাখার জন্য তদবির করা ।

এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে ভারত ভাগ হয় । ভারতবর্ষ ও পাকিস্থান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে ।

(আগামী পর্বে সমাপ্য )
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০০৯ বিকাল ৪:২৯
১২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×