শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
সে অনেক দিন আগের কথা। নূহ (আ) জামানায় একবার মহাপ্লাবন হয়। মহাপ্লাবন থেকে সকল প্রাণীকুলকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ তায়ালা নূহ (আ) কে জাহাজ নির্মাণের নির্দেশ দিলেন এবং সেই জাহাজে মহাপ্লাবনের পূর্ব মুহুর্তে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকুলের এক জোড়া করে প্রাণী উঠাতে নির্দেশ দিলেন।
আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মত নূহ (আ) প্রত্যেক প্রাণী এক জোড়া করে জাহাজে উঠাতে লাগলেন। অবশেষে বাধ সাধল গাধা। গাধাকে জাহাজে উঠাতে গিয়ে গাধা শিড়ির মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে গেল। আর নড়াচড়া করছে না। নুহ নবী গাধার রশি ধরে অনেক টানাটানির পরও যখন গাধা উঠাতে পারছেন না তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, “এই শয়তান উঠছিস না কেন? উঠ!”। নূহ (আ)-এর এই কথা বলার সাথে সাথে গাধা জাহাজে উঠে এলো।
সমস্ত প্রাণী জাহাজে উঠানোর কিছুক্ষণ পরেই ঝড় বৃষ্টিসহ মহাপ্লাবন শুরু হলো। এই মহাপ্লাবনে পৃথিবীর সমস্ত ঘর-বাড়ি, গাছ-গাছালি এমন কি পাহাড়-পর্বত পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেল। কোথাও এতটুকু উঁচু জায়গা থাকল না যে সেখানে কেউ আশ্রয় নেবে। কাজেই উপায়ন্তর না পেয়ে জাহাজে আশ্রয় নেয়া মানুষ, গরু-ছাগলসহ সকল প্রাণী জাহাজের ভিতরই মল-মূত্র ত্যাগ করতে লাগল। কয়েকদিনে মানুষ, গরু, ছাগলসহ বিভিন্ন প্রাণী ও পশুপাখিদের মল-মূত্র ময়লা একাকার হয়ে এমন দুর্গন্ধ শুরু হলো যে মানুষের সেখানে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে গেল।
এমতোবস্থায় জাহাজের সমস্ত লোক এসে নূহ (আ)-এর কাছে এসে এই দুরাবস্থার কথা জানাল, নূহ (আ) নিরুপায় হয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন, “হে আল্লাহ মল-মূত্রের দুর্গন্ধে টিকে থাক মুশকিল হয়ে যাচ্ছে, একটা উপায় বের করে দাও, তা না হলে তোমার সৃষ্টি প্রাণীকুল ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়ে যাচ্ছে”।
আল্লাহ তায়লা নূহ (আ)-এর এই ফরিয়াদ কবুল করে নেন এবং নূহ (আঃ) কে জানিয়ে দেন, “হে নূহ, তুমি হাতীর কপালে তোমার হাত ঘষে দাও”।
নূহ (আ) আল্লাহ তায়লার নির্দেশ মত হাতীর কপালে হাত ঘষে দেয়ার সাথে সাথে হাতীর নাক দিয়ে এক জোড়া শুকুরের জন্ম হলো। শুকর জন্ম নিয়েই ঘোঁত ঘোঁত শব্দ তুলে সমস্ত মল-মূত্র খেয়ে সাবাড় করে দিল। ইহাতে জাহাজের সব মল-মূত্র পরিষ্কার হয়ে গেল এবং লোকজনের বসবাসের পরিবেশ ফিরে এলো।
কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরেই নতুন সমস্যা দেখা দিল। জাহাজের তলা ছিদ্র হয়ে পানি উঠতে লাগল। নূহ (আ) এটা দেখার পর খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন। জাহাজের তলা ছিদ্র হলো কি করে? জাহাজের তলা তো ছিদ্র হওয়ার কথা নয়? ভাল করে খেয়াল করে দেখেন ছোট ছোট কিছু প্রাণী কুট কুট করে কাঠ কেটে জাহাজের তলা ছিদ্রি করছে। এই ঘটনা দেখে নূহ (আ) আশ্চার্য হয়ে গেলেন। তিনি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন, এমন প্রাণী তো আমি জাহাজে উঠাই নাই, এগুলো এলো কি করে? বিষয়টির রহস্য উদঘাটন করার জন্য পুরো জাহাজ তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। এই ছোট ছোট কাঠ কাটা প্রাণী কে নিয়ে এলো? একসময় সেই রহস্যের আবিষ্কারককে পেয়েও গেলেন। দেখেন জাহাজের এক কোনে শয়তান চুপ করে জড়সড় হয়ে বসে আছে। শয়তানকে দেখেই নূহ (আ) রেগে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন, “এই শয়তান, তোকে তো আমি উঠতে বলি নাই, তুই উঠলি কি করে? কার হুকুমে উঠেছিস”?
শয়তান কাঁচুমাঁচু করে জবাব দিল, “হুজুর আমি আপনার হুকুম নিয়েই জাহাজে উঠেছি। আপনার বিনা হুকুমে উঠি নাই”।
নূহ (আ) শয়তানের এ কথায় খুব রেগে গিয়ে বললেন “এই শয়তান, আমি তোকে কখন উঠতে বললাম? মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাস না”।
শয়তান অনুনয় বিনুনয় করে বলল, “না হজুর, আপনার হুকুম ছাড়া আমি উঠি নাই, আপনি হুকুম দেয়ার পরেই জাহাজে উঠেছি”।
নূহ (আ) আরও রেগে গেলেন এবং বললেন, “এই শয়তান, আমি তোকে কখন জহাজে উঠতে বললাম”?
শয়তান বলল, “হুজুর আপনি যখন গাধাকে জাহাজে উঠানোর জন্য টানাটানি করতে ছিলেন, তখন আমি গাধার লেজ ধরে বসে ছিলাম। গাধা কোন ক্রমেই আর উঠতে পারছিল না। এমতোবস্থায় বিরক্ত হয়ে আপনি গাধাকে বললেন, “এই শয়তান উঠ”। সাথে সাথেই আমি গাধার লেজ ছেড়ে দিয়ে জাহাজে উঠে আসি এবং গাধার লেজ মুক্ত হলে গাধাও উঠে আসে।
শয়তানের নিকট থেকে বিষয়টি অবগত হলে নূহ (আ) তার ভুলের জন্য খুব অনুতপ্ত হলেন। আসলেই তিনি গাধা উঠানোর সময় মনের অজান্তেই এই ভুলটি করেছেন। তখন নূহ (আঃ) শয়তানকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে শয়তান! তা না হয় তোকে জাহাজে উঠতে বলেছি কিন্তু ইঁদুর কিভাবে সৃষ্টি হলো”?
শয়তান তখন নূহ (আ) কে বলল, “হুজুর, যখন সমস্ত প্রাণীকুলের মল-মূত্রের গন্ধে আপনারা কষ্ট পাচ্ছিলেন আমি তখন খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আপনি হাতীর কপালে হাত ঘষলে শুকুরের জন্ম হয়। শুকুর জন্ম নিয়েই সব মল-মূত্র খেয়ে সাবাড় করে জাহাজ দুর্গন্ধ মুক্ত করলে আমার আনন্দ মুহুর্তের জন্য ভাটা পড়ে যায়। তখন আমি আপনাদের কষ্ট দেয়ার জন্য শয়তানি বুদ্ধি খুঁজতে থাকি এবং আপনার দেখাদেখি শুকুরের কপালে হাত ঘষে দেই, হাত ঘষে দেয়ার সাথে সাথেই এক জোড়া ইঁদুরের জন্ম হয়। ইঁদুর জন্ম নিয়েই জাহাজের কাঠ কেটে ছিদ্র করতে থাকে”।
শয়তানের কাছ থেকে ইঁদুর জন্মের কাহিনী অবগত হয়ে নূহ (আ) খুব অনুতপ্ত হলেন এবং শয়তানের তৈরী ইঁদুর থেকে কিভাবে নিস্তার পাওয়া যায় তার জন্য আল্লাহর কাছে আবার ফরিয়াদ করলেন, “হে আল্লাহ আমার ভুলের জন্য শয়তান জাহাজে উঠেছে এবং ইঁদুরের জন্ম দিয়েছে। আপনি এই শয়তান এবং ইঁদুর থেকে আমাদের রক্ষার ব্যবস্থা না করলে জাহাজ ছিদ্র হয়ে পানিতে তলিয়ে যাবে এবং সমস্ত প্রাণীকুলসহ আমরা ধ্বংস হয়ে যাব”।
নূহ (আ)-এর ফরিয়াদ আল্লাহ তায়ালা কবুল করলেন এবং নূহ (আ) কে নির্দেশ দিলেন, “হে নূহ, বাঘের কপালে হাত ঘষে দাও”।
নূহ (আ) আল্লাহ পাকের নির্দেশ অনুযায়ী বাঘের কপালে হাত ঘষে দেয়ার সাথে সাথে বাঘের নাক দিয়ে এক জোড়া বিড়ালের জন্ম হলো।
বিড়াল জন্ম নিয়েই ইঁদুর তাড়া করতে লাগল। বিড়ালের তাড়া খেয়ে ইঁদুর আর কাঠ কাটার সুযোগ পেল না। নিজের জান বাঁচাতে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। বিড়াল জন্ম থেকেই ইঁদুর তাড়ানোর কাজে ন্যাস্ত এবং বর্তমানেও বিড়ালদের এই চরিত্র নষ্ট হয় নাই।
বিঃ দ্রঃ হাতী থেকে শুকুরের জন্ম, শুকুর থেকে ইঁদুরের জন্ম এবং বাঘ থেকে বিড়ালের জন্ম হওয়ার কারণে হাতীর সাথে শুকুরের এবং শুকুরের সাথে ইঁদুরের চেহারার যেমন মিল আছে তেমনি বাঘের সাথেও বিড়ালের চেহারের মিল আছে।
(কাহিনী সূত্রঃ কাসাসুল আম্বিয়া এবং ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রকাশিত সোনালী দিনের কাহিনী থেকে সংগৃহিত)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:২৪