somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাগড়া শাকের ছালুন (রম্য গল্প)

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

ঢাকার চার দেয়ালে আটকে থাকা এক ঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৮ বছর পর ঢাকার অদূরে এক ছাত্রের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখায় ছাত্রের বাবার চিনতে দেরি হলো। না চেনার কারণও আছে। ষাটের কাছাকাছি বয়স। চুল, দাড়ি পেকে চোখের পাওয়ার কমে বুড়োর খাতায় নাম দিয়েছেন। এদিকে আমিও বয়সের কারণে চুল পেকে আধা বয়সি হয়েছি। এতদিন পর দেখা করতে আসবো এটা তার চিন্তায় ছিল না। কিন্তু ছাত্রের বাবার চিনতে দেরি হলেও ছাত্রের মায়ের চিনতে দেরি হলো না। প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরে চিল্লিয়ে উঠলেন, আরে স্যার আপনি!! আপনি কোইত্থিকা আইলেন?

তারা যখন ঢাকায় ছিল তখন তাদের বড় ছেলেকে তিন বছর পড়িয়েছি। একটা পর্যায়ে তারা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসে। আমার সেই ছাত্র এখন ঢাকায় চাকরী করে। বিয়ে শাদী করেছে। দীর্ঘদিন তাদের সাথে যোগাযোগ ছিল না। এতদিন পর দেখা করতে এসে দ্বিধা দ্বন্দে ছিলাম। যদি চিনতে না পারে তবে আহাম্মক হবো। কিন্তু ছেলের শিক্ষক হিসাবে এখনও যে আমাকে মনে রেখেছে সেইটা ভেবেই আমি খুব খুশি হলাম। হাসি হাসি মুখে বললাম, ঢাকা থেকে এসেছি।

ছাত্রের মায়ের কথায় ছাত্রের বাবার হুশ হলো। এবার তিনি চিনতে পেরে বারান্দার চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। উঠানে এসে আমার ডান হাত চেপে ধরে ঘন ঘন ঝাঁকিয়ে প্রথমে না চিনতে পারাটা যেন তার অপরাধ হয়েছে এমনই ভাব প্রকাশ করতে লাগলেন। ছাত্রের বাবার মনে অপরাধবোধ হওয়ার কারণও আছে। এই গ্রামে কিছু জমি কেনার সময় আমি তার সাথে ছিলাম। তিনি অল্প লেখাপড়া জানলেও জমি সংক্রান্ত মুহুরীদের হাতে লেখা দলিল পড়তে পারতেন না। তার এই বিষয়গুলো নিয়ে কাচারী পর্যন্ত গিয়েছিলাম। আমার এই অবদানের জন্য তিনি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত আদর করতেন।

ছাত্রের বাবা আমাকে উঠান থেকে এক টানে ঘরে নিয়ে বসতে দিলেন। ঘরে চোকির উপর বসতে না বসতেই ছাত্রের মা চিড়া, মুড়ি, গুড় খেতে দিলেন। সদ্য গাই দোয়ানো এক বাটি গরম দুধও পাতে ঢেলে দিলেন। গ্রামের সহজ সরল মানুষের এরকম আতিথেয়তার তুলনা হয় না। তারা সাধ্য অনুযায়ী যা খাওয়ায় তা অন্তর থেকেই খাওয়ায়। শহরের দামী খাবারের চেয়ে গ্রামের এইসব খাবারের স্বাদের তুলনা হয় না।

আমার সাথে ছাত্রের বাবাও খেতে বসলেন। চিড়া মুড়ি খেয়েই পেট ভরে গেল। এর পরে দুপুরে খাবারের প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু খাওয়া শেষে অনেক আলাপ আলোচনার পর ঢাকায় ফেরার জন্য বিদায় নেয়ার কথা বলতেই ছাত্রের বাবা ধমক দিয়ে উঠলেন, অনেক দিন পর আইছেন, ভাত না খায়া ক্যামতে যাইবেন?

ছেলেটিকে তিন বছর পড়িয়েছি। তখনও তারা আমাকে যথেষ্ঠ আদর করতো। মাঝে মাঝেই দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতো। সেই বাড়িতে এতদিন পর এসেছি-- আমাকে কি তারা ভাত না খাইয়ে বিদায় দিতে পারে? বিদায় নিতে চাইলেও উভয়ের চোখ রাঙানির চোটে বিদায় নেয়া সম্ভব হলো না। বুঝতে পেলাম ক্ষুধা লাগুক আর না লাগুক ভাত খেয়েই যেতে হবে।

মুরগী ধরার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। নিজেদের খোয়াড়ের মুরগী। মেহমান আসার অগ্রীম আভাস না থাকায় সকাল বেলা সব ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দেয়া মুরগী ধরা কষ্ট। সেই দিকে চিন্তা করে ছাত্রের মাকে লক্ষ্য করে বললাম, ভাবি-- মুরগী ধরা বন্ধ করেন, মুরগীর মাংসে আমার রুচি নাই, ঢাকা শহরে প্রতি সপ্তাহেই মুরগী খাই, যেই খাবার ঢাকা শহরে পাওয়া যায় না সেই সব খাবার খাওয়ান।
ছাত্রের মা চোখ কপালে তুলে বললেন, ঢাকা শহরে কি খাইতে পান না?
বললাম, টাটকা শাক-সব্জি পাই না, গাছ থেকে তুলে আনা টাটকা শাক-সব্জি রান্না করেন।
আমার বলার পরও অনেকক্ষণ মুরগী ধরার চেষ্টা করল কিন্তু ধরতে পারল না। অবশেষে আমার কথামত শাক সব্জিই রান্না করলো।
খাওয়ার সময় ছাত্রের বাবাও আমার সাথে খেতে বসলেন। ছাত্রের মা বলল, স্যার আপনার জন্যে দুগ্গা হাগড়া শাকের ছালুন রানছি। টাকি মাছ দিয়া রানছি, খায়া দ্যাহেন মজা পাইবেন।

জীবনে অনেক শাক খেয়েছি কিন্তু গ্রামের আগাছা এই হাগড়া শাক কোনদিন খাইনি। খুশি হয়েই বললাম, দেন।
আমার খুশি খুশি ভাব দেখে ছাত্রের মা পুরো দুই চামচ টাকি মাছের টুকরাসহ হাগড়া শাক আমার পাতে তুলে দিলেন। ভাতের সাথে হাগড়া শাক মিলিয়ে এক লোকমা মুখে দিতেই নাড়ি ভুড়ি উল্টে আসার অবস্থা। চোখ বন্ধ করে চিবিয়ে গিলে ফেললাম।

হাগড়া গাছকে আমি ছোট থেকেই চিনি। এটি একটি আগাছা। গ্রামের বাড়ির আশেপাশে বা খেত খামারে বন্যার পানি শুকিয়ে গেলে অযত্ন অবহেলায় এমনিতেই হয়। গাছটি বড়া হলে কাঁটাযুক্ত ফল ধরে। এই গাছের একটা বিদঘুটে গন্ধ আছে। সম্ভাবত গন্ধের কারণে গরু ছাগলেও এই গাছ খায় না। ভেবেছিলাম রান্নার পর হয়তো এর গন্ধ থাকে না। কিন্তু টাকি মাছ দিয়ে রান্নার পরও যে এটার বিদঘুটে গন্ধ থেকে যায় এটা আমার জানা ছিল না। যদি জানতাম তাহলে কি আর ছাত্রের মাকে খুশি হয়ে এই শাক দিতে বলি?

অর্ধেক শাক খাওয়ার পরে ছাত্রের মা আমাকে বলল, স্যার হাগড়া ছালুন কেমুন হইছে?
মনে মনে ভাবলাম-- যত বিদঘুটই লাগুক না কেন, ছাত্রের মায়ের সামনে এই শাকের বদনাম করা যাবে না। যেহেতু আমার জন্য তিনি স্পেশাল রান্না করেছেন, বদনাম করলে মনে কষ্ট পাবেন এবং তার পরিশ্রমটাই বৃথা মনে করবেন। তাই তাকে খুশি করার জন্য অন্তরের কথা অন্তরে চাপা রেখে মুখে খুশি খুশি ভাব এনে প্রশংসার সুরেই বললাম, খুব ভালো হয়েছে।
খুব ভালো হয়েছে কথাটি বলতে না বলতেই আরো দুই চামচ পাতে তুলে দিলেন। আমি এখন খাবো না কাঁদবো ভেবে পাচ্ছি না। যেটুকু খেয়েছি তাতেই আমার নাড়ি ভুড়ি উল্টে বমি আসার অবস্থা তারোপর আরো দুই চামচ। মনে মনে বললাম, বেক্কেলের মত কেন যে প্রশংসা করতে গেলাম।

এরপর চোখ বুঁজে অনুরোধে নয় অতি আদরে ঢেঁকি গেলার মত গিলতে লাগলাম। বহু কষ্টে ভাত খাওয়া শেষ করে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। পেটের ভিতর মোচর দিয়ে উঠল, গলা দিয়ে বমি ঠেলে আসতে লাগল। দৌড়ে বাড়ির দক্ষিণ পাশে তাল গাছের নিচে দাঁড়াতেই ওয়াক্ ওয়াক্ করে পুরো বমি করে দিলাম। ছাত্রের বাবা মা দৌড়ে এলো। কি হলো -- কি হলো- - ?
আমি নিজেকে সামাল দিয়ে বললাম, কিছু না। রৌদ্রের মধ্যে হেঁটে এসেছি তো এইজন্য পেটে মোচর দিয়েছে।
আমি যত খুশিভাব নিয়েই বলি না কেন তাদের মুখটা কালো হয়ে গেলো। আমাকে স্পেশাল রান্না করা খাবার খাওয়ায়ে খুশি করতে গিয়ে তারা যেন উল্টো বিপদেই পড়েছেন।

আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে বিদায় নিলাম। বিদায় নেয়ার সময় ছাত্রের মা বিষন্ন বদনে ঘরের বারান্দা থেকেই বিদায় দিলেন, বাড়ির বাইরে এলেন না, কিন্তু ছাত্রের বাবা রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।

ঢাকায় ফেরার সময় বার বার ছাত্রের মায়ের বিষন্ন বদনের ছবি চোখে ভাসতে লাগল। আহা! বেচারী আমাকে ভালো কিছু খাইয়ে খুশি করতে চেয়েছিল কিন্তু হাগড়া শাক খাওয়ার অনাভ্যাসের কারণে পেটে সহ্য হলো না। ছাত্রের বাবা তো ঠিকই হাপুরহুপুর করে খেল।
মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম, কেন যে বমি করতে গেলাম, বমিটা একটু কন্ট্রোল করতে পারলেই তো এই অবস্থা হতো না।

০০০ সমাপ্ত ০০০
(ছবি ইন্টারনেট)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৫১
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×