somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বেগুন বাড়ির পানি পড়া

৩১ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

হঠাৎ শরীর দুর্বল, খাদ্যে অরুচি, চোখ দু’টো হলুদ হলুদ ভাব। দু'দিন শরীরের দুর্বলতা নিয়েই অফিস করেছি। তৃতীয় দিন দুপুরে আনন্দ পত্রের ম্যানেজার খসরু ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলে আমার চেহারা দেখেই চমকে উঠলেন। তিনি নিজের থেকেই আমাকে বিকালে পুপুলার ডায়গনেস্টিক সেন্টারে তার বন্ধু ডাঃ মোস্তাফিজ-এর কাছে নিয়ে গেলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জন্ডিস ধরা পড়ল। ডাক্তার আমাকে সম্পুর্ণ বেড রেস্ট দিলেন। অফিসে ছুটি নিয়ে শুয়ে বসেই দিন কাটাচ্ছি। সাত দিন পার হওয়ার পর একটু সুস্থ্য সুস্থ্য মনে হচ্ছে। আমার পাশের রুমে থাকতেন পূবালী ব্যাংকের ডিপুটি কন্ট্রোলার। বড় ভাই বলে ডাকতাম। বয়স্ক মানুষ। কয়েক মাস পরেই রিটায়রমেন্টে চলে যাবেন।

ভদ্রলোক অফিস থেকে বিকেলে বাসায় ফিরে আমার রুমে এসে বললেন, প্রামানিক সাব, টাংগাইলের এক হুজুর পানিপড়া দেয়, তার পানিপড়া খেলে অনেক কঠিন রোগও নাকি ভাল হয়।
আমি চৌকির উপর শুয়ে ছিলাম। তার কথা শুনে শোয়া থেকে আড়মোড়া দিয়ে উঠে বিছানায় বসে বললাম, আপনি এ খবর পেলেন কই?
-- আমাদের অফিসের অনেক লোক সেখানে গিয়েছে এবং তারা পানিপড়া খেয়ে নাকি অনেক উপকার পেয়েছে।
-- আপনি কি যাবেন?
-- আমি আগামী কালকেই যাব। আপনি ইচ্ছা করলে আমার সাথে যেতে পারেন।
-- আপনি কি হুজুরের বাড়ির ঠিকানা জানেন?
উনি আমাকে সায় দিয়ে বললেন, আমাদের অফিসের যারা হুজুরের বাড়ি গিয়েছিলেন আমি তাদের কাছ থেকে ঠিকানা যোগাড় করে নিয়ে এসেছি।
উনার আগ্রহ আর হুজুরের প্রতি ভক্তি দেখে আমিও যেতে রাজী হলাম।

পরদিন সকাল বেলা উঠে হালকা নাস্তা করেই দুইজনে রওনা হলাম। ডাইরেক্ট টাঙ্গাইল গামী বাসে উঠে বসলাম। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারী মাসের শেষ দিকের ঘটনা। সেই সময়ে দূরের রাস্তা তো দূরের কথা ঢাকা শহরেও যানজট ছিল না। বেলা দশটার আগেই টাঙ্গাইল গিয়ে পৌঁছলাম। টাঙ্গাইলে বাস বদল করে কালিহাতি গিয়ে নামলাম। কালিহাতি নেমে লোকজনকে পানিপড়া হুজুরের বাড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এখান থেকে সোজা পশ্চিম দিকে ছয়/সাত মাইল হেঁটে যেতে হবে।

ছয়/সাত মাইল রাস্তা হাঁটার কথা শুনে আমি অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে আমার পক্ষে এত রাস্তা হাঁটা সম্ভব নয়। আমি ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেবকে বললাম, ভাই, আমার পক্ষে এতো রাস্তা হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি একাই যান, আমি ঢাকায় ফিরে যাবো।

আমার কথা শুনে ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেব কিছুটা বিমর্ষ হলেন। এতদূর এসে হুজুরের পানিপড়া না নিয়ে খালি হাতে ফিরে যাওয়া উচিৎ মনে করলেন না। তিনি আরো লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
রাস্তার পশের পানের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলল, আপনারা ভুল পথে এসেছেন। আপনারা এলেঙ্গা ফিরে যান। এলেঙ্গা থেকে ভুয়াপুরগামী বাসে উঠে পানিপড়ার কথা বললেই বাসওয়ালারা আপনাদেরকে পানিপড়া হুজুরের বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে যাবে।

পান দোকানদারের কথা শুনে আমরা দুইজন আবার পিছন ফিরে এলেঙ্গা চলে এলাম। এলেঙ্গা বাস স্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই টাঙ্গাইল থেকে ভুয়াপুরগামী একটি বাস চলে এলো। বাসটি এলেঙ্গা থামতেই হেলপার “পানিপড়া পানিপড়া” বলে চিল্লাতে লাগল। আমাদের আর বুঝতে বাকি রইল না এটাই পানিপড়া হুজুরের বাড়ি যাওয়ার বাস। বাসে উঠে বসার কিছুক্ষণ পরেই যাত্রী দিয়ে বাস ভরে গেল। আমি তখনও বুঝতে পারিনি আমার মত এই বাসের সকল যাত্রীই পানিপড়ার রুগী। একটু পরে বাস ছেড়ে দিলো। ভুয়াপুর যাওয়ার অনেক আগেই মাঠের মাঝখানে থেমে গেল। ড্রাইভার বলল, যারা পানিপড়া যাবেন তারা এইখানে নামেন।
আমরা দুইজন দরজার কাছেই ছিলাম, তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে গেলাম। আমরা নামার পরে দেখি আস্তে আস্তে সবাই নামছে। পুরো বাস খালি হয়ে গেল। বাসের ড্রাইভার, হেলপার এ অবস্থা দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসল। পুরো বাসের লোকজন পানিপড়ার যাত্রী। একটু পরে যাত্রী ছাড়াই বাস ভুয়াপুরের দিকে চলে গেল।

এইখানে রাস্তা পূর্ব পশ্চিম লম্বা। আমাদেরকে রাস্তার দক্ষিণ পার্শ্বে নামিয়ে দিয়েছে। রাস্তা পার হয়ে উত্তর পার্শ্বে চলে এলাম। ট্রাঙ্ক রোডের নিচে কয়েকটি রিক্সা এবং ভ্যান গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাকা রাস্তা থেকে একটি কাঁচা রাস্তা সোজা উত্তর দিকে চলে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে আরো তিন মাইল যেতে হবে। রিক্সা ষাট সত্তর টাকার নিচে যাবে না। ভ্যানওয়ালারা প্রতি জনে বিশ টাকা ভাড়ায় চারজন নিয়ে যাচ্ছে। আমরা দুইজনে একটি ভ্যানে উঠলাম। ফাঁকা মাঠের ভিতর দিয়ে মাটির রাস্তা। বর্ষার পানিতে তলিয়ে পুরো রাস্তাই নষ্ট হয়েছে। একটু পরপরই ভাঙ্গা। প্রত্যেকটা ভাঙ্গায় নামতে হচ্ছে। এবড়োথেবড়ো ভাঙা রাস্তায় ভ্যানে বসে থাকলেও চলন্ত অবস্থায় মাঝে মাঝে ভ্যানসহ উল্টে পড়ার অবস্থা হয়। কোথাও কোথাও পানির স্রোতে রাস্তা ভেঙ্গে দুই পাশেই খাড়া কাছাড় হয়ে আছে। এরকম জায়গায় ভ্যান থেকে শুধু নামতেই হয় না ভ্যান ওয়ালার সাথে যাত্রীদেরকেও ভ্যান ঠেলে রাস্তার উপরে তুলে দিতে হয়।

আমাদের অবস্থা এমন হলো “ঘোড়াতে চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিলাম”। আগে জানলে এ রাস্তায় ভ্যান রিক্সায় না চড়ে হেঁটেই রওনা হতাম। তিন মাইল রাস্তায় এক মাইলও ভ্যানে বসে থাকার সৌভাগ্য হলো না। যেটুকু ভ্যানে চড়ে গিয়েছি এ্যাবরো থ্যাবরো রাস্তার ঝাঁকুনির চোটে কোমরের বারোটা বেজে গেলো। এই অবস্থায় লটরপটর কোমর নিয়ে কখনও ভ্যানে চড়ে, কখনও ভ্যান ধাক্কিয়ে, কখনও পায়ে হেঁটে সোয়া বারোটার দিকে হুজুর বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম।

হুজুরের বাড়িতে এলাহী কান্ড। লোকে লোকারণ্য। বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বে ক্ষেতের ভিতর বাজার বসেছে। অন্যান্য হাট বাজারের মতই মাঝখানে অনেক জায়গা ফাঁকা রেখে চারদিক দিয়ে হোটেল-মোটেলসহ বিভিন্ন পসরা নিয়ে দোকান-পাট বসেছে। টিনের ছাপড়া দিয়ে হোটেল-মোটেল তৈরী। আবাসিক হোটেলের চেহারা দেখে এমনিতেই হাসি পেল। নয় দশ ফুট টিনের ছাপড়া। ছাপড়াগুলো চাটাই দিয়ে বেড়া দেয়া। ত্রিশ চল্লিশ ফুট লম্বা ছাপড়ার ভিতরে সাত আট ফুট পর পর খুপড়ি করে পার্টিশন দেয়া। বোর্ডারের আরামদায়ক ঘুমের জন্য মেঝেতে বিছানো হয়েছে ধানের নাড়া। ধানের নাড়ামার্কা রুমের ভাড়া খুব বেশি নয়। প্রতিদিন দশ টাকা। আরেকটু ভাল হোটেলে থাকতে চাইলে বাঁশের টংয়ের ব্যবস্থা আছে, ভাড়া একটু বেশি, বিশ টাকা। আরো ভাল হোটেলে থাকতে হলে চৌকির উপর কাঁথা বালিশসহ পঞ্চাশ টাকা। ভিআইপি ভাবে থাকতে চাইলে কাঠের চৌকির উপর লেপ তোষকের ব্যবস্থা আছে, ভাড়া এক শ’ থেকে দুই শ’ টাকা।

থাকার হোটেল যে ভাবেই তৈরী হোক না কেন, বোর্ডারের পরিমাণ খারাপ নয়। ভিআইপি রুমে লোকজন চোখে না পড়লেও ধানের নাড়া বিছানো খুপরিগুলিতে কিছু লোকজন চোখে পড়ল। অনেকেই ছিঁড়া কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে আছে। তাদের সাথে থাকা কঙ্কালসার রুগিগুলি দেখে খুব মায়া লাগল। এদের চেহারা বেশ ভুষা দেখেই বোঝা যায় এরা হত দরিদ্র। মেডিকেলে চিকিৎসার খরচ যোগাতে না পেরেই হয়তো সুচিকিৎসার আশায় হুজুরের বিনে পয়সার পানিপড়া খেতে এসেছে।

খাবারের হোটেলগুলোও মন্দ নয়। বাঁশের চাটাইয়ের তৈরী চাল, চাটাইয়ের বেড়া। কয়েকটি হোটেলের সামনে সাইন বোর্ডে লেখা আছে, ঢাকাই হোটেল, দিল্লী হোটেল, বোম্বাই হোটেল। খাবার আয়োজন খারাপ নয়, মাছ, মাংস, গরু, খাসিসহ অনেক পদের তরকারী হোটেলের সামনে টেবিলে সাজানো আছে।

ক্ষেতের পশ্চিম পাশে আর্মিদের একটি তাঁবু টানানো আছে। হুজুরের বাড়িতে আর্মিদের তাঁবু দেখে আশ্চার্যই হলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কোনো এক আর্মি অফিসারের স্ত্রী দীর্ঘ দিন থেকে অসুস্থ্য। অনেক চিকিৎসা করার পরও সুস্থ্য হচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেলের সব ডাক্তার ফেল। মেডিকেলের ডাক্তার ফেল হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য হুজুরের পানি পড়া খেতে নিয়ে এসেছেন। আর্মি অফিসারের স্ত্রীর সুচিকিৎসার সহযোগীতা করতে এসে এখানে ছোটখাটো একটি অস্থায়ী আর্মি ক্যাম্প তৈরী হয়েছে। বিষয়টি আমার কাছে কেমন মনে হলো। কৌতুহল বশতঃ এক ফাঁকে তাঁবুর কাছে গিয়ে মহিলাকে দেখে এলাম। খুব খারপ লাগল। মহিলা খুবই অসুস্থ্য। অসুখে অসুখে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আরেকজনের সাহায্য ছাড়া উঠতে বসতে পারে না। এই মহিলাকে তিন বেলা হুজুর এসে পানিপড়া খাওয়ানোর পাশাপাশি মন্ত্র পড়ে চোখে মুখে ফুঁ ফুঁ করে ঝাড়া দিয়ে যান। হুজুরের ঝাড়ায় মহিলা কতটুকু সুস্থ্যবোধ করছেন জানিনা, তবে মনের মধ্যে এতটুকুই সান্তনা খুঁজে পেলাম, স্বামী বেচারা স্ত্রীকে সুস্থ্য করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বাজারের মাঝখানে একটি বাঁশের খুঁটিতে মাইকের স্পীকার টাঙানো আছে। এই মাইক দিয়েই চিকিৎসার জন্য আগত মানুষ জনের উপচে পড়া ভির নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রয়োজনে হুজুর মাইক দিয়েই তেলপড়া, পানিপড়াসহ নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

দিনটি ছিল শুক্রবার। আমরা বাজার ও বাজারের আকর্ষণীয় হোটেল মোটেল ঘুরে পানিপড়ার জন্য হুজুরের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। হুজুরের লোকজন উঠানেই দাঁড়ানো ছিল। তাদের জিজ্ঞেস করতেই বলল, হুজুর জুমার নামায না পড়ে পানিপড়া দিবেন না।

বাড়িটি জমি থেকে বেশ উঁচু। এলাকাটি নিচু এলাকা। বন্যার কারণেই হয়তো বাড়িটি মাটি কেটে জমি থেকে অনেক উঁচু করেছে। শুধু এই বাড়িটিই নয় ঐ এলাকার সব বাড়িই জমি থেকে প্রায় পাঁচ ছয় ফুট উঁচু। হুজুরের বাড়িটি দক্ষিণমুখী। বাড়ির সামনে পূর্ব পশ্চিম লম্বা দু’টি পুরানো টিনের ঘর। দুই ঘরের মাঝখানে তিন চার হাত ফাঁক। দুই ঘরের মাঝের এই ফাঁক দিয়েই বাড়ির ভিতরে ঢুকতে হয়। দুইজন আনসার বাড়ির ভিতরে ঢোকার রাস্তায় লাঠি নিয়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। হুজুরের নিজস্ব লোকজন ছাড়া বাইরের কাউকেই বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয় না।

বাহির বাড়ির উঠানে মধ্য বয়স্ক একজন গ্রামের কৃষক দাঁড়ানো ছিল। পরনে লুঙ্গি, গায়ে কোড়া গেঞ্জি, ঘাড়ে গমছা। তাকে দেখে মনে হলো এই এলাকারই লোক হবে। জিজ্ঞেস করে উত্তর পেলামও তাই। লোকটিকে হুজুরের পানিপড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি যে বর্ননা দিলেন তা হলো এই-- হুজুর ছোট থেকেই ইসলামীভাবাপন্ন লোক। বিনা কারণে নামায রোযা কাযা করেন না। তবে তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন নাই, স্কুল কলেজেই লেখাপড়া করেছেন। বিএ পড়ার সময় পাশের বাড়ির এক বয়স্ক মহিলা পেটের ব্যাথায় চিল্লাচিল্লি করতে ছিল। তার চিল্লাচিল্লি দেখে উপযাচক হয়েই তিনি এক গ্লাস পানিতে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে খেতে দেন। পানিপড়া খেয়ে মহিলার পেটের ব্যাথা সেরে যায়। ঘটনাটি মুহুর্তেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে তাদের সমস্যা নিয়ে আসে। তাদেরকেও পানিপড়া দেন। তার পানিপড়া খেয়ে অনেকেই সুস্থ্যবোধ করে। এই খবর আস্তে আস্তে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিনই বিনে পয়সায় পানিপড়া নিতে দূরদূর থেকে লোকজন আসতে থাকে। এক সময় ট্ঙ্গাাইলের ডিসির কানেও খবরটি চলে যায়, সেও তার সমস্যা নিয়ে আসেন। তার পানিপড়া খেয়ে নাকি তিনিও সুস্থ্য হন। হুজুরের পানিপড়ায় উপকার পেয়ে ডিসি সাহেব খুশি হয়ে তড়িঘড়ি হুজুরের বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দেন। পরবর্তীতে হুজুরের বাড়িতে আগত লোকজনের ভির সামাল দেয়ার জন্য আনসারের ব্যবস্থাও নাকি তিনিই করে দিয়েছেন।

লোকটির বর্ননা অনুযায়ী কথার কিছু নমুনাও পেলাম। বাড়ির উঠানেই বিদ্যুতের খুঁটি লাগানো আছে। সেই সময়ে গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ ব্যাবস্থা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু অখ্যাত গ্রামের এই বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। সামনের বাজারসহ পুরো বাড়িই বিদ্যুতের আলোতে আলোকিত। তার বর্ননা আর বিদ্যুতের বিশেষ ব্যাবস্থা দেখে হুজুরের প্রতি কিছুটা বিশ্বাস স্থাপন হলো। তার কারণও আছে, পানিপড়ার বিনিময়ে তিনি কোনো টাকা পয়সা নেন না। বিনে পয়সায় পানিপড়া দেন। টাকা পয়সা কামানোর ধান্দাবাজি নেই। দু’টাকা করে নিলেও হাজার হাজার টাকা রোজগার করতে পারেন কিন্তু এধরনের কোনো কিছু চোখে পড়ল না। তবে মনে হলো হুজুরের উত্থান খুব বেশি দিন আগে নয়। বিদ্যুতের খুঁটি, সামনের বাজার, মানুষ জনের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, সব কিছুতেই নতুনত্ব ভাব অনুমিত হলো।

আমরা লোকটির সাথে কথা বলার কিছুক্ষণ পরেই হুজুর বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে এলেন। বয়স খুব বেশি নয় ২৫/২৬ বছরের যুবক। মুখে দাড়ি আছে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে সাধারন পাঞ্জাবী। চারজন আনসারের সাথে আরো চার পাঁচ জন লোক তাকে ঘিরে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। হুজুরের কাছে কেউ ভিরতে পারছে না। তাকে এভাবে পাহারা দিতে দেখে মনের ভিতরে প্রশ্ন দেখা দিল। হুজুরকে যদি আনসার দিয়ে এভাবে পাহারা দেয়া হয়, তাহলে মানুষ হুজুরের নিকট যাবে কি ভাবে এবং পানিপড়া নিবে কি ভাবে?

কিন্তু পরক্ষণই আমার ভুল ভাঙল। মুহুর্তেই পানিপড়ার জন্য লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মানুষের ঠেলা ধাক্কায় আনসারসহ আট দশজন পাহারাদার কখনও কাত হয়ে কখনও চিৎ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন। পাহারাদারদের সাথে সাথে মাঝে মাঝে হুজুরও কাত চিৎ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন। মানুষের ঠেলাধাক্কা আর পাহারাদারসহ হুজুরের দুর্দশা দেখে পানিপড়া নেয়ার কথা ভুলেই গেলাম। ধাক্কাধাক্কি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কিছুটা দূরে সরে গেলাম। দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে লাগলাম। ঠেলাঠেলি করতে গিয়ে মাঝে মাঝে পানিপড়া নিতে আসা লোকজনও চিৎ হয়ে পড়ে যাচ্ছে। মানুষের চিৎ কাত হওয়া দেখে হাসি আটকাতে পারছিলাম না। হাসির মাঝেও ভাবতে লাগলাম, পানিপড়া নিতে এসে মানুষ যদি এইরকম ঠেলাঠেলি করে তাহলে অসুস্থ্য রুগীকে সুস্থ্য করতে গিয়ে শেষে হুজুরকেই না চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়।

হুজুর পানিপড়ায় কতটুকু আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেছেন জানি না তবে তার ধৈর্য্যর নমুনা দেখে অবাকই হলাম। তাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া আর ধাক্কাধাক্কি দেখে আমারই মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছিল, অথচ এত নাস্তানাবুদ হওয়ার পরও তিনি কারো প্রতি এতটুকু রাগ দেখালেন না। একজন রক্তমাংসের মানুষের পাহাড়সম সহশীলতা এর আগে আমার চোখে কখনও পড়ে নাই। আমার মনে হয় এই ধৈর্য্যই তাকে পানি পড়ায় খ্যাতির শীর্ষে পৌছে দিয়েছে।

এই অবস্থার মধ্যেই হুজুর মসজিদে রওনা হলেন। ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি করতে করতে আমরাও তার সাথি হলাম। হুজুর আগে আগে আমরা পাঁচ ছয় শ’ লোক তার পিছনে পিছনে। মসজিদ খুব দূরে নয়। গ্রামের মসজিদ। টিনের চাল টিনের বেড়া। অনেক ঠেলাঠেলি করেও মসজিদের ভিতরে ঢোকা সম্ভব হলো না। বাইরেও নামাজের বিছানা পাওয়া গেল না। মসজিদ ঘরের সামনের কর্তন করা ধান ক্ষেতে নেমে গেলাম। ধান ক্ষেতের আধা ভেজা মাটির উপরই নামায পড়তে হলো।

গ্রামের মসজিদ আর কত বড় হয়? প্রতি শুক্রবারে হয়তো বিশ পঞ্চাশজন লোকে নামায পড়তো। সেখানে হঠাৎ করে পাঁচশ’ হাজার লোক বেড়ে যাওয়ায় মসজিদের ভিতরে তো দূরের কথা মসজিদের সামনের মাঠেও সংকুলান হচ্ছে না, যে কারণে সামনের ধান ক্ষেতে নামতে হয়েছে।

নামায শেষে মোনাজাত করে হুজুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। মসজিদে আসার পথে যত না ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি করেছি ফেরার পথে তার চেয়ে দ্বিগুন ধাক্কাধাক্কি করতে হলো। কারণ কার আগে কে হুজুরের সাথে যাবে এইটা নিয়ে তুমুল ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। অনেকেই পারলে হুজুরের গায়ের উপর উপ্পুর হয়ে পড়ে যায়। ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি করতে করতে কোনরকমে হুজুর বাড়ি পৌছিলেন। বাড়ি পৌঁছেই সামনের উঠানের দক্ষিণ পার্শ্বের শেষ প্রান্তের একটি উঁচু জায়গায় দক্ষিণ মুখ করে দাঁড়ালেন। মাইক আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। হুজুর হাতে মাইক নিয়ে সবাইকে বাড়ির নিচে জমিনে লাইন ধরে উত্তর মুখ করে দাঁড়াতে বললেন। সবার হাতেই তিন চারটি করে বোতল। কোন বোতলে পানি কোন বোতলে তেল। কয়েকটি বোতলের দোকানও বাজারে বসেছে। খালি বোতল দুই টাকা, তেলসহ বোতল পাঁচ টাকা। আমিও দু’টি বোতল কিনেছি। ডেপুটি কন্ট্রোলার সাহেব পাঁচটি বোতল কিনেছেন। নিজের জন্য দু’টি, বাড়ির গিন্নিসহ ছেলে মেয়েদের জন্য আরো তিনটি। সামনের লাইনে দাঁড়িয়েছি। আমার পাশেই ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেব দাঁড়িয়েছেন। কয়েক হাজার মানুষ। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে গেল। সবাই সামনের লাইনে দাঁড়ানোর জন্য ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিয়েছে। ধাক্কার চোটে উল্টে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। বহু কষ্টে দুই হাতে দু’টি বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হুজুর সবাইকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বোতলের মুখ খুলতে বললেন। হুজুরের নির্দেশ অনুযায়ী আমিও বোতল দু’টির মুখ খুলে মাইকের দিকে বোতলের উদাম মুখ ধরে রাখলাম।

কিছুক্ষণ পরেই হুজুর মাইকে তেলপড়া দিতে লাগলেন। তিনি যে কি বলছেন তা কিছুই বোঝা গেল না। উর্দু, আরবী, ফারসী, নাগরী না পাহাড়ী ভাষায় মন্ত্র পড়লেন বোঝার শক্তি কারোরই হলো না। অসংলগ্ন ভাষায় কিছুক্ষণ মন্ত্র পড়ে তিনবার মাইকে ফুঁ দিলেন। অবশেষে তেলপড়া ও পানিপড়ার নিয়ম কানুন বলে দিলেন। তেলপড়া মাথাসহ শরীরে মালিশ করতে বললেন এবং পানিপড়া তিন বেলা খেতে বললেন। পানিপড়া ও তেলপড়া শেষ হওয়ার আগেই পানির ভিতর পানি আর তেলের ভিতর তেল দিয়ে সাত দিন পর্যন্ত খেতে নিতে বললেন। তেলপড়া ও পানিপড়ার নিয়ম কানুন বলে দেয়ার পরই তিনি মাইক ছেড়ে দিলেন। মাইক ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথেই মানুষজন লাইন ভেঙে হুজুরের দিকে হুমড়ি খেয়ে ছুটলো। বোতলের মুখ আটকাতে না আটকাতেই ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। মানুষের ধাক্কায় বোতল থেকে অর্ধেক পানি ছিটকে পড়ে গেল। বহু কষ্টে বোতলের মুখ লাগিয়ে প্যান্টের দুই পকেটে ভরে হুজুরের কাছে যাওয়ার জন্য ক্ষেত থেকে বাড়ির উপরে উঠার চেষ্টা করতে লাগলাম। জমি থেকে বাড়ি অনেক উঁচু এবং খাড়া হলেও উঠতে বেগ পেতে হলো না। পিছনের মানুষের ঠেলার চোটেই তিড়িং করে বাড়ির উপরে উঠে গেলাম। সবাই হুজুরের মুখের সরাসরি ঝাড়া নেয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আমিও কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে বার বার ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিলাম। অনেক চেষ্টার পর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হুজুরের কাছে গিয়েও কথা বলার সুযোগ হলো না। হাজার কণ্ঠের চিল্লাচিল্লিতে কারো কথা কেউ বুঝতে পারে না। হাত ইশারায় নিজেকে দেখাতেই হুজুর ঠাস করে ঘাড়ে একটি থাপ্পর দিয়ে বলল, নাই নাই, রোগ নাই।

আমার কি রোগ হয়েছে আর উনি কি রোগের থাপ্পর দিলেন কিছুই বুঝতে পেলাম না। তবে থাপ্পরের চোটে কোঁকড়া লেগে গেলাম। একে দুর্বল শরীর তারোপর হুজুরের বলিষ্ঠ থাপ্পর খেয়ে চোখে সরিষার ফুল দেখতে লাগলাম। কোন রকমে তাল সামলে ফাঁকে এসে চোখ বন্ধ করে মাটিতে বসে পড়লাম। থাপ্পরের ব্যাথায় মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। মনে মনে ভাবলাম, রোগ ভাল হোক বা না হোক দ্বিতীয়বার আর ওই হুজুরের কাছে যাওয়ার চিন্তাও করবো না।

অনেকক্ষণ পর উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে দেখি আমার পাশেই এক ভদ্রলোক মেয়ে নিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন। ভদ্রলোক টয়োটা গাড়ি নিয়ে ঢাকা থেকে এসেছেন। সেই সময়ে অবস্থাপন্ন লোকজন ছাড়া প্রাইভেট গাড়ি চড়ার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের ছিল না। মেয়েটি আধুনিকা। সুস্থ্যই মনে হলো। তারপরেও কি কারণে যে মেয়েকে নিয়ে হুজুরের কাছে এসেছেন আমার বোধগম্য হলো না। মেয়েকে নিয়ে হুজুরের কাছে যাওয়ার জন্য ভদ্রলোক খুব চেষ্টা করছেন। মানুষের ভিরে কাছে যেতে পারছেন না। মেয়ের বাবা ভির ঠেলে হুজুরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মেয়ের তেমন আগ্রহ নেই। মেয়েটি নাক সিটকাচ্ছে। অর্থৎ হুজুরের প্রতি তার বাবার ভক্তি হলেও মেয়ের বিশ্বাস ভক্তি কিছুই নেই। হয়তো বাবার কথা ফেলতে পারছে না-- তাই অনিচ্ছা সত্বেও নাক সিটকাতে সিটকাতে বাবার সাথে এসেছে।

বেলা তখন তিনটা পার হয়েছে। হুড়োহুড়ি ধাক্কাধাক্কির ঠেলায় খুব খিদে পেয়েছে। ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেবকে খুঁজতে লাগলাম। তাকে পেতে বেশি সময় লাগল না। তিনিও হুজুরের মুখের সরাসরি ঝাড়া নেয়ার জন্য খুব চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জোয়ানদের ঠেলা ধাক্কার কাছে কুলিয়ে উঠতে পারেন নাই। বয়স্ক মানুষ, অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ফাঁকে এসে কলাগাছের নিচে বসে হাপাচ্ছেন। কাছে গিয়ে বড় ভাই বলে ডাক দিতেই মুখ তুলে তাকালেন। তাকিয়ে দেখি উনার মুখ শুকিয়ে গেছে। একে ক্ষুধার্ত তারোপরে হুজুরের কাছে যাওয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি করতে করতে যেমনি ক্লান্ত হয়েছেন তেমনি দুর্বল হয়েছেন। তার অবস্থা দেখে মনে হলো-- হুজুরের মুখের ফুঁ দেয়া ঝাড়ার চেয়ে এখন জান বাঁচানো ফরজ।

ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেবকে ভাত খাওয়ার প্রস্তাব দিতেই রাজী হয়ে গেলেন। আমি উনাকে সাথে নিয়ে খাবার হোটেলে গেলাম। দুপুরের সময়। সব হোটেলেই প্রচন্ড ভির। ভিরবাট্টা ঠেলে দিল্লী হোটেলে খেতে বসলাম। টিনের প্লেট ভরে মোটা চালের ভাত দিল। মাছ, মাংস, ডিমসহ কয়েক পদের তরকারী আছে। ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেব শিং মাছ আর বেগুন পছন্দ করলেন। আমিও উনার সাথে সায় দিলাম। কারণ বেগুন বাড়ি এসে বেগুন না খেলে এ এলাকার বেগুনের স্বাদ বুঝবো কেমন করে?

প্রথমেই বেগুনের তরকারী পাতে ঢেলে মুখে দিলাম। তরকারী খেয়ে মুখ উল্টে আসার অবস্থা। মনে হলো লবন, মরিচ, হলূদ আর পানি দিয়ে শুধু আগুনে জ্বাল দিয়েছে। একটুও স্বাদ হয়নি। অর্ধেক ভাত খেয়েই দুইজন চুয়াল্লিশ টাকা বিল দিয়ে চলে এলাম। আসার সময় কোনো রিক্সা ভ্যান না নিয়ে হেঁটেই রওনা হলাম। কারণ আসার সময় ভ্যানে চড়ে যে শাস্তি পেয়েছি সেটা তো আর ভোলা যায় না।

ট্রাঙ্ক রোডে এসে দেখি রাস্তার পাশে অস্থায়ী বাজার বসেছে। এই বাজার অন্য সময় বসে না। শুধু হুজুরের বাড়িতে পানি পড়া নিতে আসা লোকজনের জন্যই এই বাজার। ঢাকা শহরসহ অনেক জায়গার লোকজনই এখন হুজুরের পানি পড়া নিতে আসে। শহরের লোকজন এখান থেকে টাটকা শাক-সব্জি সস্তায় পেয়ে কিনে নিয়ে যায়। ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেব পঁচিশ টাকা দিয়ে বড় একটি ষোল মাছ কিনলেন। আমিও তাকে অনুসরণ করে অনেকগুলি মাগুর মাছ পঁয়ত্রিশ টাকা দিয়ে কিনে নিলাম। সব্জির বাজারে গিয়ে তাজা শাক সব্জি দেখে মন মানলো না। কচি লাউ জাংলা থেকে একটু আগেই কেটে এনেছে। দুইজনে দু’টি কচি লাউ ১২ টাকা দিয়ে কিনে নিলাম। আমাদের দেখাদেখি আরো অনেক লোক কেনাকাটা করল। বিক্রেতারা খুব খুশি। স্থানীয় বাজারের চেয়ে অনেক বেশি দামেই বিক্রি করেছে। তবে আমরা যারা ঢাকা থেকে এসেছি তারাও জিতেছি। তাজা মাছ আর টাটকা শাক-সব্জি যে দামে কিনেছি ঢাকার তুলনায় অনেক সস্তা।

কিছুক্ষণ পর ভুয়াপুর থেকে ঢকাগামী বাস চলে এলো। আমি আর ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেব প্রথমেই বাসে উঠে সিট দখল করে বসলাম। মূহুর্তেই বাস ভরে গেল। যাত্রী ভরে যাওয়ায় বাস তাড়াতাড়িই ছেড়ে দিল।

রাস্তায় খুব একটা দেরি করল না। ঢাকার যাত্রী দিয়ে বাস ভরা। বাস দ্রুত চলতে লাগল। অন্যান্য বাসের তুলনায় অনেক আগেই আমরা ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় যখন পৌছলাম তখন রাত নয়টা। বাসায় ফিরে শরীর ম্যাজ ম্যাজ করতে লাগল। মনে হলো গায়ে জ্বর আসবে। পরক্ষণেই মনে হলো হুজুরের পানিপড়া আর তেলপড়া আছে, এগুলোর সদব্যবহার করলে জ্বর কাছেও ভিরতে পারবে না। হুজুরের দেয়া নিয়ম অনুযায়ী রাতে পানিপড়া খেয়ে শরীরে তেল মালিস করে ঘুমালাম।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই কোঁকড়া লেগে গেলাম। পুরো শরীরে ব্যাথা। ব্যাথার চোটে নড়তে পারছি না। মনে হলো সারা শরীর যেন কেউ সাপ পিটানোর মত করে পিটিয়ে দিয়েছে। পাশের রুমে গিয়ে দেখি ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেবও শুয়ে আছেন। কোমরের ব্যাথায় কোকাচ্ছেন। কাছে গিয়ে বললাম, বড় ভাই কোকাচ্ছেন কেন? তাড়াতাড়ি তেল মালিশ করেন আর পানিপড়া খান-- সেরে যাবে।

আমার কথা শুনে ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেব বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলেন, কোনো কথা বললেন না। আমি তার কোকানো দেখে নিজের শরীরের ব্যাথা থাকার পরও হাসি আটকাতে পারলাম না-- হো হো করে হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
অফিস টাইম পার হওয়ার পরও দেখি তিনি শুয়ে আছেন। কোমরের ব্যাথার চোটে আর অফিসেই গেলেন না। পরপর তিনদিন অফিস কামাই করে আমার মতই বিছনায় শুয়ে শুয়ে দিন পার করলেন।

ডিপুটি কন্ট্রোলার সাহেবের অবস্থা দেখে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজে নিজেই হাসতে লাগলাম। যে লোকটি সুস্থ্য অবস্থায় পানিপড়া খেতে বেগুন বাড়ি গেল, সেই লোক পানি পড়া খেয়ে সুস্থ্য হওয়া তো দূরের কথা উল্টো আরো অসুস্থ্য হয়ে বিছনায় পড়ে কোকাচ্ছেন। হায়রে বেগুন বাড়ির পানি পড়া, আশা করলেন কি আর হলো কি?

(সমাপ্ত)

(ছবিঃ ইন্টারনেট, সংশোধিত রিপোষ্ট)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৯
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×