somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আধ পাগল কোবাদ ভাই এবং রাজাকারের পেটন

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

কোবাদ ভাই আমার বড় ফুফুর ছেলে। আধ পাগল মানুষ। যেমনি সহজ সরল তেমনি বুদ্ধিসুদ্ধিও কম। চালাক চতুর না হওয়ার কারণে আর্থিক দিক দিয়েও দুর্বল। পোষাক আশাকেও তেমন জৌলুস ছিল না।

একাত্তুর সালে যুদ্ধের সময় (সম্ভাবত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি) কোবাদ ভাই কোন এক কাজে ভরতখালী গিয়েছিল (এলাকাটি গাইবান্ধা জেলার অন্তর্গত সাঘাটা থানা) । গায়ে প্রচন্ড জ্বর থাকায় কাজ না করেই বাড়ি ফিরে আসে। সেই সময়ে রিক্সা গাড়ি তেমন একটা ছিল না তারোপর যুদ্ধের কারণে যানবাহনও বন্ধ ছিল। জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিল। গায়ে একটি আধাছেঁড়া পুরানো চাঁদর। ফুলছড়ি থানা সদরের বাজারের উপর দিয়ে ফিরতে হয়। ফুলছড়ি বাজারের পশ্চিম পাশ্বেই ব্রীজ। ব্রিজটি সেই সময় রাজাকারদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কয়েকজন রাজাকার সবসময় পাহারা দিত। ব্রীজ থেকে অল্প দূরেই ফুলছড়ি হেড কোয়ার্টর আর এই হেড কোয়ার্টারেই ছিল কুখ্যাত খান সেনাদের ক্যাম্প।

বর্ষাকাল থাকায় এই রাস্তা ছাড়া অন্য কোন রাস্তায় বড়ি ফেরার উপায় ছিল না। পাক সেনা ও রাজাকারদের ভয় থাকার পরও ঐ রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফিরছিল। গরমের দিনে গায়ে চাদর জড়ানো অবস্থায় ব্রিজের কাছে আসতেই রাজকাররা তাকে আটকিয়ে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধা মনে করে কিছু বলার আগেই তার হাত বেঁধে ফেলে। গায়ের চাদর হেঁচকা টানে খুলে দূরে ছুঁড়ে দেয়। গায়ের চাদর শরীর থেকে খুলে নেয়ায় অসুস্থ্য কোবাদ ভাই বিপদে পরে যায়। জ্বরে কাঁপতে থাকে। জ্বরের কথা বলেও লাভ হয় না উল্টো তাকে পরনের লুঙি ছাড়া গায়ের সব জামা কাপড় খুলে উদাম করে রাখে।

উদাম অবস্থায় পুরো শরীর চেক করে। অস্ত্রসস্ত্র কিছু না পেয়ে টাকা পয়সা দাবী করে বসে। তার কাছে কোন টাকা পয়সা ছিল না। টাকা পয়সা না পেয়ে বাপ মা তুলে গালি দেয়। খামাখাই অনেকক্ষণ আটকিয়ে রাখে। একটা পর্যায়ে হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে চলে যেতে বলে। কিন্তু চলে যাওয়ার কথা বলেই পিছন থেকে একজন রাইফেলের বাট দিয়ে কোমরে আঘাত করে। আচমকা আঘাত করায় তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে রাস্তার ওপরে পড়ে যায়। রাইফেলের আঘাতে কোমরের হাড্ডি ভেঙে যাওয়ার অবস্থা। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু দাঁড়াতে পারে না। কোমরের ব্যাথায় টলকে পড়ে যায়। রাস্তার সাইডে বসে পড়ে। তাকে বসতে দেখে আরেকজন রাজাকার এগিয়ে এসে আবারও লাথি মারে। লাথি খেয়ে গড়িয়ে রাস্তার নিচে পড়ে যায়। অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তার উপরে উঠলে আবারও রাজাকার তেড়ে আসে। রাজাকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভাঙা কোমর নিয়েই দৌড়ে পালাতে থাকে। এই অবস্থায় অনেক কষ্টে অবশেষে বাড়ি ফিরে আসে।

বাড়ি ফিরে কোমরের ব্যাথায় মরার অবস্থা। দীর্ঘ দিন বিছানায় পড়ে থাকে। সাধ্যমত চিকিৎসা করেও পুরোপুরি সুস্থ্য হয় না। কোমরের ব্যাথা থেকেই যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই ব্যাথায়ই ভুগেছেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন পরে তিনি বাজারে যাওয়ার পথে দেখে সেই রাজাকারকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কোবাদ ভাই রাজাকারকে দেখেই চিনে ফেলে। তাড়াতাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়ে বলে, ভাই আমার একটা বিচার আছে।
মুক্তিযোদ্ধারা বলল, কি বিচার?
কোবাদ ভাই আঙুল দিয়ে রাজাকারকে দেখিয়ে বলল, এই রাজাকার আমার কোমরে রাইফেলের বাট দিয়া বাড়ি মাইরা কোমর ভাইঙা দিছে, আমি সেই থাইকা ভাঙা কোমর নিয়া খুব কষ্ট পাইতেছি। আপনারা এইটার বিচার করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকজন ছিল, তাদের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এলো। নিজের হাতের লাঠি কোবাদ ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, এই শালা রাজাকার আপনার উপর যে অত্যাচার করেছে, সে বিচার আপনি নিজের হাতেই করেন।

মুক্তিযোদ্ধারা তার হাতে লাঠি ধরিয়ে দেয়ায় কোবাদ ভাইয়ের মেজাজ তখন তুঙ্গে। পাগল হলেও তার ভিতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেছে। এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা উচিৎ হবে না। মনে মনে ভাবে ও যেমনভাবে আমার কোমরে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটন দিয়েছে আমিও তেমন ভাবেই ওকে পেটাবো। ও আমার কোমর ভেঙে দিয়েছে আমিও ওর কোমর ভেঙে দিব। এই মনে করে লাঠি হাতে নিয়ে রাজাকারকে যেই পেটন দিতে যাবে অমনি রাজাকার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। রাজাকারের কান্না শুনে থমকে যায়। মুখের দিকে চাইতেই মায়া লাগে। রাজাকারের চোখের পানি দেখে মনটা নরম হয়ে যায়। নরম দিলের সহজ সরল মানুষ হওয়ায় আর পেটাতে পারে না। হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে বলে ওঠে, মুক্তিযোদ্ধা ভাই, আমার পক্ষে রাজাকার পেটানো সম্ভব হইলো না। ওর চোখের দিকে চায়া আমার মহব্বত লাগছে। আমার বিচারটা আপনারাই কইরেন।

মুক্তিযোদ্ধারা তার সরলতা দেখে রেগে যায়, ধমক দিয়ে বলে উঠে, আরে ভাই আপনি যে মহব্বত করতেছেন ও যখন আপনাকে পিটাইছে তখন কি ও আপনাকে মহব্বত করেছিল?
রাজাকারের মহব্বতের কথা শুনে কোবাদ ভাই কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বলে উঠে-- না ভাই, মহব্বত তো করেই নাই, উপরন্ত আরো আমারে লাত্থি দিয়া রাস্তার নিচে ফালায়া দিছে।
লাত্থি মেরে রাস্তার নিচে ফেলে দেয়ার কথা শুনে একজন রেগে গিয়ে বলে--আরে বেকুব লোক, লাত্থি খাওয়ার পরও মহব্বত লাগলো? ওর ভিতরে যেইখানে মহব্বত নাই সেইখানে আপনার মহব্বত করার দরকার কি? ধরেন-- লাঠি হাতে নেন, বলেই তিনি আবার তার হাতে লাঠি তুলে দেয়।

কিন্তু কোবাদ ভাইয়ের নরম দিল আর শক্ত হয় না। লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পিটাতে গিয়েও আর পিটাতে পারে না। তাকে থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষেপে যায়। তারা তাকে তিরস্কার করতে থাকে। কিন্তু তাদের শত তিরস্কারেও তিনি প্রতিশোধ না নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকেন। তার থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে পাগল ভেবে ক্যাম্পে চলে যায়।

বিনা কারণে রাজাকারের হাতে পেটন খাওয়া সেই আধ পাগল ভাইটি গত ১১ ডিসেম্বর (২০১৭ইং) বিজয়ের মাসে মারা গেছেন (ইন্না- - রাজেউন)। তার মৃত্যুর খবর শুনে মর্মাহত হলাম। এই পাগল ভাইটি বাড়ি গেলেই এসে দেখা করে যেত। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কত যে দোয়া করতো। তার সরলতার আদরমাখা হাত বুলানোতে বিগলিত হতাম। খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। অসুস্থ্য অবস্থায়ও পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তেন। এমন মানুষ খুব কমই চোখে পড়ে। আমি তার মাগফেরাত কামনা করি। আপনারাও দোয়া করবেন, পাগল ভাইটি যেন জান্নাতবাসী হয়।

(রাজাকারের অত্যাচারের কাহিনীটি তার মুখেই শোনা। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে সেই ঘটনা বার বার মনে পড়ছিল। আজকের এই বিজয় দিবসে পাগল ভাইটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ঘটনাটি তুলে ধরলাম।)

(ছবি ঃ ইন্টারনেট)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:১৬
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×