জীবনে কখনো সুখের অনুভুতি পাইনি।তাই বলতেও পারছি না সুখের অনুভুতি কেমন।তবে......অন্যরা যখন আনন্দ করে,হাসি মস্করা করে......তখন বুঝি....আসলেই সুখের অনুভুতি গুলো অসাধারন।তবে দুখের মধ্যেও যে একরকম পৈশাচিক আনন্দ আছে,তা হয়তো অনেকের অজানা।
আমি এখন যেখানে বসে আছি তার অদুরেই একদল টোকাই কাগজ টোকাচ্ছে।কিন্তু তারপরো ওদের কোনো আফসোস দেখছি না।আমার লাইফটাও ওদের মতই হওয়া উচিত ছিল।
এখানে বসার উদ্দেশ্য এটা না।আমি অপেক্ষা করছি একজনের জন্য।সে আসবে,একগাদা কথা শোনাবে,কতক্ষন ফুপিয়ে কাদবে,তারপর যাওয়ার সময় টাকার একটা খাম হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যাবে।মাঝে মাঝে আবেগ বেশি হলে জড়িয়ে ধরবে,তখন আর কিছুতেই ছাড়তে চাইবে না।এই হয়ে আসছে আজ পাচ বছর ধরে।
অইতো সে আসছে।তবে আজকে মুখটা বিষম গম্ভীর।
-কতক্ষন ধরে এসেছো.....?
-ঘড়ি নাই।
-আনুমানিক সময়....?
-বলতে পারলাম না।
অন্যসময় হলে হয়তো বাম গালে স্পশ পেতাম।আজকে কিছুই হল না।
-তোমার কি টাকার দরকার.....?
-কিছুটা....
-কি করবে.....?
-মফিজের মার অসুখ।হাসপাতালে নিতে হবে।
-ও.....এই নাও টাকা।আগামী মাস থেকে আমি আসতে পারবো না।আমার বাসায় গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে।যদি তোমার প্রয়োজন হয়।
-তুমি কোথায় যাবে.....?
-সেটা তোমার না জানলেও চলবে....
-আচ্ছা.....
-আমি যাই
আমি স্বাভাবিকভাবেই আবার ওই টোকাইদের কাজ দেখতে লাগলাম।মেয়েটা কিছু দুর গিয়ে আবার আমার কাছে ফিরে আসলো
-তুমি কখনোই আমার ওপর অধিকার করতে পারলে না।আর পারতেও হবে না।আগামি মাসে আমার বিয়ে।ভাল থেকো।
বলেই চলে গেল।
হাহ!!!!!মেয়েটির কথায় আমি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ও করিনি।এটা মেয়েও জানে।
ভাল মানুষদের নাকি আল্লাহ বেশি দিন দুনিয়ায় রাখেন না।আমি মনে হয় খুবই খারাপ।যার কারনে এখনো আমাকে বেচে রেখেছেন।কিন্তু কিভাবে এই মেয়েটা আমার খপ্পরে পড়লো তা আজো আমার অজানা।
যখন বয়স ৫ তখন বাবা মারা যায় রোড এক্সিডেন্টে।তখন বুঝলাম অভাব কাকে বলে।যেই বয়সে আমার স্কুলে থাকার কথা,সেই বয়সেই নেমে গেলাম কাজের দুনিয়ায়।কারন টাকা না থাকলে আমার মা,আর ভাই না খেয়ে থাকবে।কিন্তু আমি ছাড়ি নি।সারাদিন কাজ করার পর রাতে পড়তাম।স্যারদের অনুরোধ করলাম শুধুমাত্র স্কুলের পরীক্ষা গুলোতে অংশগ্রহন করাতে।তারা রাজী হল।এভাবেই মেট্রিক পাশ করে কলেজ উঠলাম।
মার শরির ভয়াবহ খারাপ।টিউমার।অপারেশন করাতে অনেক টাকার প্রয়োজন।মাকে বল্লাম বিষয়টা।মা বলল চিন্তা না করতে।ধৈয ধরার জন্য।হ্যা.....আমি ধরেছিলাম।মা মারা যাওয়ার পর এক ফোটা চোখের পানিও পড়ে নি।সবাই অবাক হয়ে গেছে আমার এঈ আচরনে।
তারপর থেকেই আমি এরকম স্বাভাবিক হয়ে গেলাম।অতি অস্বাভাবিকের মধ্যেও স্বাভাবিক।
অনাসে থাকাকালীন আমার এক প্রিয় বন্ধু আমার সামনেই ছাদ থেকে আত্নহত্যা করে।আমি তখনো স্বাভাবিক ছিলাম।তার আত্নহত্যার কারন সে একটা অপদার্থ।টাকা ইনকাম করার কোনো রাস্তাই তার জানা নাই।তার শেষ কিছু কথা এরকম ছিল
"দোস্ত,এই দুনিয়াটা বড়ই কঠিন।টাকা না থাকলে কেউ তোর আপন না।আর সবচেয়ে বড় পাপ হচ্ছে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে জন্ম নেওয়া।তাই আজ জীবন দিয়ে তার শোধ দিচ্ছি।তুই ভাল থাকিস....."
বলেই ৫ তলা থেকে লাফ দিল।আমি রেলিং এর সামনে গিয়ে দেখলাম আমার বন্ধুটা পরম নিশ্চিন্তে ঘমিয়ে পড়েছে।
এভাবেই চলছিল দিন।পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলাম।আমার ভাই ও এস.এস.সি তে পাশ করল।আমাকে খবর দিল।আমি শুধু হুম বল্লাম,যেন কিছুই হয়নি।
২য় ইয়ারে উঠে খেয়াল করলাম একটা মেয়ে প্রায় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমার ওই বন্ধুর সুইসাইডের পর আর কারো সাথে ফ্রেন্ডশিপ করিনি।আবার কারে আল্লায় টাগেট করে....!!!!!
তো আমি প্রতিদিনের মতই ক্লাস শেষে বাসায় চলে আসতাম।তারপর টিউশনিতে চলে যেতাম।এটাই ছিল আমার এখন কার পেশা।তো গেট থেকে যখন বের হলাম তখনি মেয়েটা আমাকে ডাক দিল
-এই যে.....
আমি দাড়ালাম
-তোমার সাথে কিছু কথা বলতে পারি.....
-বলেন.......?
-আপনি করে বলতেছো কেন....!!!!!আমরা একই ইয়ারে পড়ি।
-ও আচ্ছা
-তোমার নামটা কি....?
-নাম নাই।কারন আকীকা দেওয়া হয় নাই।
-আরে.....সেটাই শুনি....
-আরেকদিন।
বলেই চলে আসলাম।টিউশনির দেরি হয়ে যাচ্ছে।
পরদিন ক্যাম্পাসে ঢুকতেই দেখলাম মেয়েটা হনহন করে আমার নিকট আসতে থাকলো।চোখে মুখে ভীষন রাগের আভা
-কাল তুমি আমাকে অপমান করলে কেন......
-কিভাবে.....!!!
-এই যে হুট করে চলে গেলে....নাকি আমি সেধে তোমার সাথে কথা বলায় ভাব বেড়ে গেছে......
-আচ্ছা,আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বলেই চলে যেতে থাকলাম।মেয়েটা অসম্ভব বিরক্ত করছে।
আজ পকেটে টাকাও নাই।কি খাব ভাবতেছি।অবশ্য কারো কাছে চাইলেই দিবে।কারন সবাই আমার অবস্থা টা বুঝে।
ক্যান্টিনের কোনায় বসে আছি।পেটে প্রচুর ক্ষিদে কিন্তু সাহস করে কিছু নিতে পারছি না।মার কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল।হঠাৎ মেয়েটার ডাক
-অই....তুমি আমার সিটে কি করছো....?
-সরি.....
-আরে বাবা,.....ফান করছিলাম।তুমি দেখি ফানও বুঝো না (হাসতে হাসতে)
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলাম।
-আমাকে ফুসকা খাওয়াবা.....?
-না.....
-কিহহহহহ!!!!!!!কেন!!!!
-কোনো কারন নাই।
-ভাব না।দেখবা....আমি চাইলেই কত ছেলে আমাকে ফুসকা খাওয়াবে.....?
-না
-তারপরো আমি দেখাবো
ধ্যাত!!!!!!মেয়েটার আচরন বিরক্ত লাগছে।আমি উঠে চলে আসলাম।
রাস্তা দিয়ে হাটতেছি....হঠাৎ এক প্রাইভেট কার এসে ঢাক্কা দিল।কিছুই হয়নি এমন ভাবে উঠে দাড়ালাম।গাড়ির ভেতর থেকে এক লোক আসল
-বাবা,তোমার কোথাও লাগেনি তো....
-না....
-আমি খুব দুঃখিত.!......আমার সাথে চল।
-কোথায়..?
-হাসপাতালে.....
-তার দরকার নাই।আমি আসি
কষ্টের পরিমান হয়তো এতই হয়ে গেছে,যার কারনে কষ্ট আর কষ্ট মনে হয় না।ভাল লাগা সময় গুলোও কষ্টের দেয়ালে আটকা পড়ে একই অনুভুতি হয়ে গেছে।সেদিন আমার ভাই কাচুমাচু ভাবে বলে সে নাকি একটা মেয়েকে পচ্ছন্দ করে আর আমার অমতে নাকি সে রিলেশন করবে না।আমি মেয়েটাকে দেখলাম।খুবই ভাল,সুন্দর।আমি সায় দিয়ে দিলাম।আমার কষ্টের অনুভুতি যাতে ওকে না পায় তারই ব্যবস্থা।
পরে জানতে পারি আমার ভাই যার সাথে রিলেশন করে সে নাকি অই মেয়ের ছোট বোন,মানে আমাকে যে বিরক্ত করে।মেয়েটার নাম টা মনে হয় লামিয়া।খেয়াল থাকে না।
তারপরের থেকেই মেয়েটা আমার বাসায় আসা শুরু করে।কখন ওর বোনের সাথে,কখনো একা।আমাকে পিক করে নিয়ে যায়।মানে ফ্রেন্ডশিপের মত একটা অবস্থা।
আমার যে খুব একটা ভাল লাগত বা খারাপ লাগত তা না।তবে ভাল লাগার মত কিছু অনুভুতি মনে হয় আমার মনে ইন্সটল হওয়া শুরু হয়।যতক্ষন থাকত আমার সাথে কথা বলে,হাসি তামাশা করে মাতিয়ে রাখত।কিন্তু আমার মুখ থেকে কখনো হাসি বের করতে পারে নাই।
এই মেয়েই আমাকে প্রপোজ করে।প্রথমে তার বোন কে দিয়ে,তারপর আমার ভাই কে দিয়ে।আমি কিছুই বলিনি।এরপরে সে নিজেই.....
-নিজেকে হিরো মনে করো.....!!!
-না....
-তাহলে.....আমি কি দেখতে খারাপ....অসুন্দর.....?
-আসল কথা বল.....
-আমার প্রপোজের উত্তর কই.....!!!!!
-কোনো উত্তর নাই।
-আমি তাহলে কোনটা ধরে নেব.....!!!!?
-যেইটা ইচ্ছা....
-তুমি এমন কেন.....
-আমি এরকমই......
চলে যেতেই মেয়েটা আমার হাত ধরে থামালো আর বাম গালে একটা চড় বসিয়ে দিল
-তোমারে আমি এমনে এমনেই ছেড়ে দিব ভাবছো...!??কখনোই না
বলতে বলতেই চোখের পানি ছেড়ে দিল।আমার অনুভুতি আগের মতই রয়ে গেল।কিন্তু মেয়েটার চোখের পানিটা ঠিক মানালো না তার কোমল চেহারায়।তাই ভাবলাম সাময়িক ভাললাগা উপহার দেই
-আমি হ্যা বল্লে কি হবে.....!!!!!
-তোমার মাথা।
-আমার মাথা হলে আর দরকার নাই।
-প্লিজ,বল না.....?
-কি...?
-ভালবাসো....?
-বাসলে কি হবে....?
-তোমার এই ভাব কমে যাবে.....
-আচ্ছা.....
-কি আচ্ছা....?(অনেক খুশি হয়ে)
-ভালবাসি....
মেয়েটার সেদিন আনন্দ দেখে কে.....আনন্দের অতিসীমায় আমাকে জরিয়ে ধরে।ওর আনন্দ দেখে আমারো সেদিন খুব ভাল লেগেছিল আর এইভাবেই একটি অনিশ্চিত রিলেশনের সুত্রপাত।
তারপর থেকে ওর যোগাযোগের পরিমান টা আরো বেড়ে যায়।ওর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হত।ওর সব ফ্রেন্ডদের সাথে আমাকে পরিচয় করে দিল ওর বিএফ হিসেবে।কিন্তু কেউ হয়তো বিশ্বাস করত না।আর তাছাড়া আমার আচরনে এমন কিছু ছিল না যাতে কেউ বিশ্বাস করবে আমাদের রিলেশন।
কিন্তু মেয়েটা যাতে কষ্টের বেড়াজালে না পড়ে তাই আর কি........
সেই থেকে এই ৫ বছর এমনেই চলে গেল।মেয়েও বুঝতে পেরেছে ওর প্রতি হয়তো আমার আলাদা কোনো টান নাই।কিন্তু আমি চাই না কোনো মায়ায় জড়াতে।কারন কখন আবার ওকেও হারাতে হয়।
.
লামিয়ার বিয়ে আগামি সপ্তাহ।ও বলেছিল ওর টাকার দরকার হলে যেন ওর বাসায় গিয়ে নিয়ে আসি।কিন্তু আমি তা করবো না।তাই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে ফেল্লাম।বিয়ের আগের দিন আমার সাথে দেখা করল
-কেমন আছো....?
-অলটাইম আগেত মত।
-আমার কাল বিয়ে।
-হু।
-তোমার কিছু বলার আছে....?
-অতীত তা ভুলে যাবে,নতুন করে সব শুরু করবে।২ সন্তানের জননি হবে।তোমার ছেলে বা মেয়ে যখন বড় হবে লাইক....২ বা ৩ বছরের হবে তখন আমার সাথে দেখা করবে।তার আগে নয়
-আর কিছু.....
-এইটা আমার নাম্বার।তোমার জন্য সবসময় চালু থাকবে।কিন্তু ফোন রিসিভ করব আমার বলা কথার মত।
-আর....??
-আর কিছু না।
-আমার টা শোনবে না.....!!!!
-সেইদিন না হয় শুনি....!!!!
-তাহলে এতটুকু বল...সেদিন কেন আমার প্রপোজ গ্রহন করেছিলে.....?
-দেখ....জিবনটা খুব কঠিন।তোমার আর আমার মাঝে অনেক তফাত।সেদিন আমি গ্রহন না করলে তুমি সিরিয়াস একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলতে.....বা দেখা গেল সেই দিন থেকে আজ অবধি কষ্ট পেতে থাকলে।তাই তোমার সাময়িক আনন্দ দেওয়ার জন্য আমার এই পরিকল্পনা।
-তার মানে তুমি এতদিন অভিনয় করলে....!!!!আমাকে একটুকুও ভালবাসো নি....!!!!
-এইটাও না হয় আরেকদিন জেনে নিলে.....
ঠাশ.....।আবারো বাম গালে হাতের স্পশ পেলাম।
-যেই কষ্ট কারো সাথে যদি শেয়ারই করতে না পারো...তাহলে কিসের এই রিলেশন!!!!!!!তোমার কষ্ট পেয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে।
চলে গেল।আমার লাইফ থেকেই মেয়েটা চলে গেল।এতদিন অনুভুতি না হলেও আজ বুঝলাম জীবনের যেই সামান্য সম্বল ছিল,তাও আজ হারালাম।এভাবেই আমাকে চলতে হবে,আমি আর আমার কষ্ট গুলো নিয়ে....
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৬ রাত ৯:৪২