somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জলের বন রাতারগুল ও জলের স্বর্গ টাঙ্গুয়ারে ভ্রমন

২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৪:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুক্রবার অফিস শেষ করে বাসায় আসতে আসতে রাত নয়টা বেজে গেল। তখনো ক্যামেরার ব্যাটারীতে, মোবাইলে চার্জ দেয়া হয়নি, ব্যাগ গুছানো নাই, দাড়ি গোফ এর জঙ্গল হয়ে আছে, কাকে ছেড়ে কাকে ধরি করতে করতেই সাড়ে দশটা বাজে। নাকে মুখে কিছু গুঁজে কিছু কাপড় ক্যামেরার ব্যাগে আর কিছু হাতে নিয়েই চলে এলাম রেলগেইট, এখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল বাবু, রাসেল আর শিমুল।

মাসের আজ ২৮ তারিখে আমার কাছে টাকা আছে ৫০০, এটা দোষের কিছু না। দোষের হচ্ছে মাসের ২৮ তারিখে আমি ঢাকার বাইরে যাচ্ছি, কাজেই শাওন ভাই - ২০০০/= , মতিয়ার ভাই - ১০০০/= আর রাসেল ২০০০/= এই হচ্ছে আমার ট্যুরের বাজেট।

সোয়া এগারটায় যখন ফকিরাপুল কাউন্টারে আসলাম বাস ছাড়তে তখনো ৪৫ মিনিট বাকি। বাস ছাড়ার পর দেখা গেলো বাসের যাত্রি আমরা ছাড়া আরো ৩ জন। এক পাশে আমি আর রাসেল বসে যখন মোবাইলে ব্যস্ত, বাবু আর শিমুল তখন ব্যস্ত গান শোনা নিয়ে। কিছুক্ষন পরে মনে হলো, অনেক হইছে এবার ঘুমানো দরকার। আমি আর বাবু পিছনে গিয়ে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত এক পাশের ২ সিটে, হাটু আর পা আরেক পাশের সিটে রেখে ঘুম, মাঝে শুধু একবার উঠলাম উজান-ভাটি তে খাবার জন্য।

আমাদের বাস থেকে নামিয়ে দিল ফজরের আযানের পর পরই, দুইটা রিক্সা নিয়ে চলে আসলাম গোল্ডেন সিটি হোটেলে, আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখা রুমে (বুকিং দেয়া ছিল ২ জনের জন্য) ৪ জন ঢুকেই বিছানায় চিৎ ।

নয়টার দিকে উঠে গেলাম পানশী রেস্তোরায় নাস্তা করার জন্য। এখানে বাবু-র কিছু সহকর্মীর সাথে দেখা করে বের হবার সময় গেলাম পানশী রেস্তোরায় ঢুকার মুখেই অবস্থিত রাজা-স মিউজিয়ামে। হাসন রাজা এবং তার পূর্ব ও উত্তর পুরুষদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য-ই এই মিউজিয়াম। এখান থেকে বের হবার আগেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টি-র কারনেই আমাদের খাদিমনগর হয়ে রাতারগুল যাওয়া হলো না। এলাকার লোকজনের ভাষ্যমতে গত দুইদিন বৃষ্টি হওয়াতে খাদিমনগরের ভিতর দিয়ে এখন যাওয়া সম্ভব না। বৃষ্টি-র মধ্যেই এক সি,এন,জি চড়ে রওয়ানা দিলাম শালুটিকর বাজারের দিকে, শহরের ছেড়ে বের হবার আগেই একটা ধাক্কা খেলাম, শহরের একপ্রান্ত যখন বৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে, আরেক প্রান্তের রাস্তার ধুলোতে তখন সকালের সোনা রোদ পড়ে চকচক করছে।

বিমানবন্দরের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে আমরা চলে এলাম শালুটিকর। শালুটিকর বাজারের পাশেই অদ্ভুত সুন্দর চেঙ্গি খাল, সাদাটে নীল পানিতে সারি সারি নৌকা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ঢেও এর দোলায় দোল খাচ্ছে, খালের অপর পাশে টুকরো টুকরো বাড়ি। এক দিকে খালের উপর শুয়ে আছে বিশাল এক ব্রীজ যেখান থেকে পুরো শালুটিকরকে এক নজরেই দেখে ফেলা যায়, আরেক দিকে খালের বাঁকের সাথেই তাল মিলিয়ে একে বেঁকে বয়ে চলছে পাল তোলা নৌকা। নৌকা নিয়েই গোয়াইনঘাটের দিকে যাব কিনা ভাবতে ভাবতেই এক টেম্পুতে চড়ে বসলাম। নৌকাতে না উঠার পিছনে বড় ২ টা কারন; সময় এবং অর্থের পরিমান। ২০০০ টাকা নৌকা ভাড়া, টেম্পুতে লাগলো ১৪০ টাকা।

অদ্ভুত সুন্দর এই রাস্তা, কিছুদুর পর্যন্ত আমাদের মায়া ছাড়তে পারলো না বলে চেঙ্গি চললো আমাদের সমান্তরালেই তার পর তার রূপ বদল করে হয়ে গেল কোথাও বিল, কোথাও চারন ভূমি, কোথাও বা চাষের জমি। চারনভূমি গুলোতে চড়ে বেরাচ্ছে বিশালাকার মহিষের দল, বাংলাদেশের আর কোথাও এখন পর্যন্ত এতো বড় আকারের মহিষ দেখিনি। চলতে চলতেই চারণভূমি একটু একটু করে জলাভূমি হতে থাকলো, বিশালাকার মহিষগুলো এবার আস্তে আস্তে জলে ডুবতে থাকলো আর আমরাও মহিষের সম্রাজ্য পার করে এসে পরলাম জলের সম্রাজ্যে। রাস্তার একপাশে আকাশ আর জলের নীল মিলে মিশে একাকার, তার মাঝে মেঘের ছায়া, অপর পাশে পাহাড়ের কোলে শুয়ে আছে ছোট ছোট গ্রাম। এভাবে চলতে চলতেই একসময় পৌছে গেলাম গোয়াইনঘাট। এখান থেকেই ৭০০ টাকা দিয়ে এক ট্রলার রিজার্ভ করলাম রাতারগুল যাবার জন্য। খাবার জন্য নিলাম বড় এক প্যাকের বিস্কিট আর এক বোতল পানি, কত বড় বোকামি করলাম সেটা পরে বুঝলাম যখন সারাদিন পার করতে হলো এই এক প্যাকেট বিস্কিট দিয়েই।

ছই দেয়া নৌকার মাচার উপরে বসে আয়েশ করে দুই তীরের লোকজনের কোলাহল দেখতে দেখতে এগুতে লাগলাম। কিছুদুর গিয়ে মাঝি তার কাজে এক ঘাটে নৌকা ভিড়ালে তীরে দিগম্বর হয়ে মোরগ লড়াই খেলতে থাকা কিছু বালক আমাদের ট্রলারেই উঠে এলো ট্রলারের ছাদ থেকে পানিতে ঝাঁপ দেবে বলে।


মোরগ লড়াই


তীর থেকে পানিতে ঝাঁপ

নৌকায় বসে রাসেলের সুফী আর ছ্যাকা খাওয়া গান, মাছ ধরার নৌকার মাঝিদের কোলাহল, তীরে আছড়ে পরা ঢেউ এর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, একটু পর পর নদীর বাঁক, গোলাপী জামা পরা স্কুলফেরত কিশোরীদের উচ্ছ্বাস, পারে বসে ঢেকি শাক চিবুতে থাকা মহিষের নির্লিপ্ত আয়েশ আর দুষ্ট বালকদের পানিতে দাপাদাপি দেখতে দেখতেই সামনে এগুতে লাগলাম। “কাশ ফুলের মালা পড়াব তোমার অঙ্গে, দেখিব তোমায় আমি সাদা পরীর ঢঙ্গে; কথা দাও সখী আমায় যাইবা না ছাড়িয়া” আর “দুরবিদেশি বন্ধু তুমি রইলা কত দুরে, নয়ন জলে গেঁথে মালা পড়াব তোমা-রে ” এই দুইটা গান এই টুরে আমাদের কমপক্ষে ২০০০ বার শুনতে হইছে। একসময় বাবু চিৎকার করে বলে, “বাড়িতে সমন্ত মেয়ে আছে, ভুল বুইঝেন না আমি ঘটক”!!!! কপাল ভালো লাঠি সোটা নিয়ে কেউ তাড়া করেনি।


নদীতে


নদীতীরে

চলতে চলতেই এক সময় পৌছে গেলাম রাতারগুলের পাড়ে, আগে থেকে না জানলে কোনভাবেই অনুমান করা সম্ভব না এইদিকে রাতারগুল হতে পারে। পাড়ে নেমে এক ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করলাম ৩০০ টাকা দিয়ে।
রাতারগুল, বনে ঢুকার সাথে সাথে আমাদের সবার মুখ থেকে কথা উধাও হয়ে গেল। চোখের সামনে বাকরুদ্ধ করে দেয়া সবুজের হাতছানি, গাছের পাতাদের পানির সাথে লুকোচুরি খেলা, কাকচক্ষুর মতো টলটলে পানি এক গাছের গা ছুঁয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আরেক গাছের দিকে, বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শন শন শব্দের সাথে পানিতে বৈঠা পড়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ মিলে তৈরী করেছে শব্দের মায়াজাল, এই মায়াজাল ভেঙ্গে কথা বলে প্রকৃতিকে বিরক্ত করার মতো দুঃসাহস আমরা দেখাতে পারিনি। নৌকা এগুচ্ছে গাছের গা ছুঁয়ে, কখনো কখনো নিজেদের বাঁচানোর জন্য আমরা নৌকাতেই শুয়ে পড়ছি। হিজল, তমাল আর করচ গাছগুলো এখানে অনেকটা এঁকে বেঁকে বেড়ে উঠেছে। ঘন বনের ভিতর গেলে আকাশটাও ঢাকা পড়ে যায় গাছের আড়ালে। গাছের সবুজ আর পানিতে সেই সবুজের প্রতিবিম্ব সবমিলিয়ে এখানে সবুজ কথা বলে, সবুজে কথা বলে। এক জায়গায় এসে আমরা নৌকা প্রায় ২০ মিনিট স্থির করে থামিয়ে রাখলাম পানিতে গাছের প্রতিবিম্বের ছবি তুলবো বলে। আবাক লাগে সেই সাথে রাগ ও লাগে যখন দেখি আমাদের-ই কোন এক সভ্য বন্ধুর রেখে যাওয়া চিপস আর চানাচুরের প্যাকেট গাছের ঢালে নির্লজ্জের মতো ঝুলে আছে। ২ টা প্যাকেট আমরা নৌকাতে করে নিয়েও এলাম। আরও কিছুদুর সামনে গিয়ে দেখি দুই গাছের মধ্যে দড়ি বেঁধে মাছ ধরার বড়শি পাতা, কয়েকটা মাছ ধরাও পড়েছে সেই সাথে বড়শিতে আটকে আছে প্রায় দুই হাত লম্বা এক সাপ। দড়ি ধরে ঝটপট সাপের কিছু ছবি তুলে ফেললাম, সাপকে তো আর বড়শি থেকে ছাড়ানো যায়না, তাই বাবু লাইটার দিয়ে বড়শীর সুতো পুড়িয়ে বড়শীসহ-ই সাপকে মুক্তি দিলো।


রাতারগুলে ঢুকার সময়


স্বচ্ছ জলের নিচে লতা পাতা



















রাতারগুল জলাবন বা Ratargul Swamp Forest বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন বা সোয়াম্প ফরেস্ট এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর, আর এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে, গুয়াইন নদীর দক্ষিণে এই বনের অবস্থান। বনের দক্ষিণ দিকে আবার রয়েছে দুটি হাওর: শিমুল বিল হাওর ও নেওয়া বিল হাওর। সিলেট শহর থেকে এর দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। বিশাল এ বনে রয়েছে জারুল (Giant Crape-myrtle), করচ, কদম (Neolamarckia cadamba), বরুণ, পিটালি, হিজল (Barringtonia acutangula), অর্জুন, জালি বেত ও মুর্তা বেতসহ পানিসহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। পাখির মধ্যে রয়েছে সাদা বক (Haron), কানা বক (Paddybird), মাছরাঙা (kingfisher), টিয়া (Parrot), বুলবুলি (Red-vented Bulbul), পানকৌড়ি (Cormorant), ঢুপি (Spotted Dove), ঘুঘু (Dove), চিল (Kite), শঙ্খ চিল (Brahminy Kite) , বাজ (Mountain Hawk-Eagle), শকুন (Vulture), বালিহাঁস (Cotton Pygmy Goose) প্রভৃতি। সাপের মধ্যে রয়েছে অজগর (python), গোসাপ (Monitor Lizard), গোখরা (Cobra), শঙ্খচূড় (King Cobra), কেউটে (Monocled Cobra), জলধুড়াসহ বিষাক্ত অনেক প্রজাতি। বর্ষায় বনের ভেতর পানি ঢুকলে এসব সাপ গাছের ওপর ওঠে। বনেও দাবিয়ে বেড়ায় মেছোবাঘ (Fishing Cat), কাঠবিড়ালি (Squirrel), বানর (Monkey), ভোঁদড় (Otter), শিয়াল (Jackal) সহ নানা প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। টেংরা , খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া , আইড়, কালবাউস, রুইসহ আরও অনেক জাতের মাছ পাওয়া যায় এখানে।

ফেরার পথে আবার সেই নদীতে ফিরতি পথে যাত্রা, তবে এবার যতটা না নদীপাড়ের সৌন্দর্য দেখলাম তার চেয়ে বেশি কাটালাম নৌকার ছইয়ের উপর শুয়ে। যখন গোয়াইনঘাটে এসে পৌছালাম তখন প্রায় সন্ধ্যা, খাবার হোটেলে কিছু নাই, দুপুরের ভোজ সারলাম সন্ধ্যায় একটা পাউরুটি আর ছয় চামচ দই দিয়ে। আসার পথে গোয়াইনঘাট থেকে সি,এন,জি নিয়ে সরাসরি সিলেট শহরেই চলে আসলাম।

রাতে খাবার জন্য গেলাম বিখ্যাত পাঁচ ভাই রেস্তোরায়, খাবার অর্ডার করার আগেই ১০/১২ রকমের সবজি আর ভাজি চলে আসলো, সাথে নিলাম ওদের চাষ করা ঘুঘু পাখি। সারাদিন না খাওয়া; হাত, চামচ, প্লেট সব চেটেপুটে খেয়ে তারপর উঠলাম। রাতে এক বিছানায় রাসেল আর বাবু, আরেকটায় আমি আর শিমুল। বাবু আর রাসেল শোয়ামাত্র ই ঘুম, আমি আর শিমুল কথা শেষ করে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন চারটা বাজে। ছয়টা থেকে বাবু শুরু করলো ডাকাডাকি, উঠতে উঠতে আটটা।

হোটেল থেকে বের হয়ে ২ পা আগানোর আগেই বৃষ্টি শুরু হলো। সময় কাটানোর জন্য এক হোটেলে ঢুকে নাসতা করতে লাগালাম প্রায় ঘন্টাখানেক তবুও বৃষ্টি থামার কোন লক্ষন না দেখে বৃষ্টি-র মধ্যেই রওয়ানা দিলাম খাদিমনগরের দিকে, আজকে যত বৃষ্টি-ই থাকুক আর রাস্তা যত খারাপ-ই হোক আজকে পণ করলাম খাদিমনগরে ঘুরবোই। কাদার মধ্যে দিয়ে যাবে না বলে মাঝে একবার সি,এন,জি ও পাল্টাতে হলো খাদিমনগরে আসার জন্য। খাদিমনগর এসে পৌছাতে পৌছাতে বৃষ্টি কমে গেলেও আকাশ তখনো মেঘলা, এদিকে অফিস থেকে ঝাড়ি খেয়ে রাসেলের মুখ ও মেঘলা।


খাদিমনগর


বনের ভিতরে

খাদিমনগরে ঢুকে প্রায় ঘন্টা খানেকের মতো পার করার পর রাস্তা হারিয়ে ফেললাম, এরপর চলতে লাগলাম চা বাগানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বড় রাস্তা ধরে। এক সময় বাবু কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলে আমার ছবি তোল। বাবু আর সামনে থেকে আসতে থাকা তিনটা গরু, চারজনের একি ফ্রেমে চমৎকার সহাবস্থান। চারজনের-ই প্রায় একি রকম স্বাস্থ্য ছবির কম্পোজিশনে চমৎকার ব্যালেন্স নিয়ে আসছে। খাদিম চা বাগানের পাশ দিয়ে হাটতে হাটতেই এক সময় আমরা প্রধান সড়কে এসে উঠলাম। এতোক্ষন হেটে এসে রিক্সা পেলাম মাত্র ১ টা, বাবু আর শিমুলকে তুলে দিয়ে আমি আর রাসেল আরো মিনিট দশেক হেটে তারপর রিক্সা পেলাম।


খাদিম চা বাগানের প্রধান সড়কে

দুপুরের খাবার খেলাম আবার পাঁচ ভাই রেস্তোরায়, খাবার টেবিলে বসার জন্য এখানে যারা খাচ্ছে তাদের পিছনে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। খাবারের পর ই চলে গেলাম সুনামগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে। ছোট লোকাল বাসে হাত পা আটকে বসে থাকলাম, এখানকার নিয়ম হচ্ছে সিটে বসার পর আর নড়া যাবেনা, বাস থেকে নামার সময় পাশের জন টেনে সিট থেকে তুলবে।
সুনামগঞ্জ গিয়ে উঠলাম জেলা প্রশাসকের গেস্ট হাউজে, আগে থেকেই রাসেল সব ঠিক করে রেখেছিল (আমাদের মরা রাসেল না, বাবু-র জুনিয়র কলিগ সুনামগঞ্জের জেলা প্রতিনিধি রাসেল। এখন থেকে বোঝার সুবিধার্থে আমাদের রাসেলকে মরা নামেই লিখবো।) কিছুক্ষন বিশ্রাম নেবার পর রাসেল আবার আসলো আমাদের নিয়ে বাইরে যাবে বলে, ইতিমধ্যে সে দুইজন বাউল ও যোগার করে রেখেছে গান গাওয়ার জন্য। লঞ্চ ঘাটের পাশে সুরমার তীরে এক পাড় বাধানো ঘাটে এসে আমরা বসলাম, কিছুক্ষন পর বাউল ও এসে হাজির, সেই সাথে সুনামগঞ্জের মেয়র ও চলে এসেছে গান শুনার জন্য। পূর্নিমা রাত, ল্যাম্পপোস্ট সব নিভানো, নদীতীরে বসে একের পর এক হাসন রাজা, লালন শাহ, আব্দুল করিম, রাধা রমনের গান। বাউল গান হবে তার সাথে আমাদের মরা কি গলা না মিলিয়ে পারে????

রাতে খেতে গেলাম লঞ্চঘাটে, খেয়ে দেয়ে পাড়ে ভিড়ানো এক লঞ্চের ছাদে উঠে আরো ঘন্টা খানেক আড্ডা দিয়ে হোটেলে আসলাম। আজকে আমি আর বাবু এক বিছানায়, মরা আর শিমুল আরেক বিছানায়।

সকালে নাস্তা করে (এখানকার মিষ্টি টা খেতে অসাধারন, আকারে ও অনেক বড়) গেলাম হাসন রাজার বাড়ির পাশের সাহেববাড়ি ঘাটে । শিমুলের জানি কি হইছে রাস্তায় যাই দেখে তাই খাইতে চায়, গত দুই দিনে বাদাম, চানাচুর, পান, আচার, পানিফল খেয়ে ফেরীঘাটে এসে বায়না ধরছে শুকনা বড়ই খাবে। মাথাপিছু দশটাকা করে দিয়ে নৌকা থেকে মুনিপুরি ঘাটে নামা মাত্র ২০/২৫ জন মোটর সাইকেল চালক এসে আমাদের ঘিরে ধরলো।


সুরমা নদী পার হবার সময়

রাসেল থাকাতে এই যাত্রা বেঁচে গেলাম, সেই আমাদের ২ টা মোটর সাইকেল ঠিক করে দিল। এখানকার প্রধান বাহন হচ্ছে মোটর সাইকেল, একেকটা মোটর সাইকেলে চালক সহ তিনজন বসে। একটায় বাবু আর শিমুল আরেকটায় আমি আর মরা রওয়ানা দিলাম। রাসেল এখান থেকেই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিল। যাবার পথে আমরা সরাসরি তাহিরপুর না গিয়ে রওয়ানা দিলাম বারিক্কী টিলার দিকে। আট দশ কিঃ মিঃ যাবার পর-ই শুরু হলো বৃষ্টি, বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশের এক দোকানের ভিতর আশ্রয় নিলাম। আধাঘন্টা পর বৃষ্টি থামলে রওয়ানা দিয়ে পৌছালাম নদীর তীরে। ডান দিকে তাকালেই চোখে পড়বে চার চারটি পাহাড়, উচু উচু পাহাড়ের মাথায় উড়াউড়ি করছে শরতের দুধ সাদা মেঘ, কেউ কেউ আবার ক্যানভাসে আঁকা ছবি হয়ে আটকে আছে সবুজ পাহাড়ের গায়ে। পাহাড়ের বুক চিড়ে নেমে এসেছে স্বচ্ছ নদী, নদীতে ডুব দিয়ে বালু তোলায় ব্যাস্ত শত শত মানুষ, এক পাশে বিস্তীর্ন বালুচর, অন্যপাশে খাড়া উঠে যাওয়া বারিক্কী টিলা (বারেক টিলা নামেও পরিচিত)। এই নদীতীরেই একসময় প্রাচীন লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল, এলাকার নাম এখনো লাউড়ের গড়। লাউড়ের গড় গ্রামে আছে শাহ আরেফিন (রহঃ) এর মাজার, আর গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে নদীতীরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। প্রতি বছর মাঘ মাসে প্রায় একই সময়ে মাজারে উরশ আর নদীতে পুণ্যস্নান শুরু হয়। নয়ানাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ করা এই নদীটির নাম শুনেও মুগ্ধ হতে হবে, “যাদুকাটা”।


যাদুকাটা নদী


নদীতীর


বিস্তীর্ন বালুচর


মাঝি একাই তিনটা নৌকা নিয়ে যাচ্ছে


বালু তোলায় ব্যাস্ত নৌকা

যাদুকাটা নদী পার করেই উঠতে হবে বারিক্কী টিলার খাড়া পথ দিয়ে। সবুজে ভরপুর এই টিলার মাঝখান দিয়ে ছোট্ট একটা পাকা সড়ক চলে গেছে, টিলার উপর দাড়ালে পাহাড় গুলোকে আরো অনেক কাছের মনে হয়। উঠার পথে নিচে তাকালে দেখা যায় আঁকা বাঁকা নদী। টিলায় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকালে সাদা ফিতার মতো ঝর্ণা দেখা যায়। আফসোস লাগে, যখন দেখি এতো উচু উচু পাহাড় গুলো সব ভারতের আর আমাদের এদিকে ছোট ছোট কয়েকটা টিলা।


সীমান্তের কাটা তার


পাহাড়ের ভাজে মেঘ

বারিক্কী টিলা পার হয়ে গেলাম চারাগাও শুল্ক বন্দর ও ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পে। খনি প্রকল্পটা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেলেও এখনো রয়ে গেছে প্রকল্পের জন্য বসানো রেললাইনের পাত। এ পথ দিয়েই আরো কিছুটা এগিয়ে চলে আসলাম ডাম্পের বাজারে। এখান থেকে মোটরসাইকেল ছেড়ে দিয়ে ৩ টাকা দিয়ে খেয়া পার হয়ে অপর পাড় থেকে তাহিরপুর যাবার নৌকাতে উঠলাম।
সরকারী হিসাবে সুনামগঞ্জে নাকি হাওড় আছে ১৩৯ টি (সুত্রঃ জেলা প্রতিনিধি রাসেল), হাওড়ের সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন প্রমান না থাকলেও ২৫ টি নদী, ৯৯৭ টি বদ্ধ জলমহাল, ৭৩ টি উন্মুক্ত জলমহাল আর ১২৪ টি খেয়াঘাটের সুনামগঞ্জকে জলের রাজ্য বলাই যায়। এক সহযাত্রীর ভাষ্যমতে তাহিরপুর পর্যন্ত যেতে যেতে আমরা ৭/৮ টা হাওড় পার করেছি যদিও সবগুলো হাওড়ের নাম-ই এখন ভুলে গেছি। ২ থেকে ২.৫ ঘন্টার এই যাত্রায় পার করে আসতে হবে অনেক দ্বীপ গ্রাম, কাছ থেকে দেখবেন তাদের জীবন যাত্রা। আমাদের নৌকার পাশাপাশি একটা বিয়ের নৌকা ও যাচ্ছিল। নৌকার সামনে ২ টা কলাগাছ বসিয়ে তাতে লাল, নীল, হলুদ রঙের কাগজ লাগিয়ে রাঙ্গানো হয়েছে। বর বসে আছে নৌকার মাচার উপরে চেয়ারে আর কনে বসে আছে মাচার ভিতরে জানালার পাশে। আত্মীয় স্বজনদের আনন্দ উল্লাস আর মাইকে ভেসে আসা গানের শব্দে চলতে চলতে একসময় নৌকা অন্য দিকে মোড় নিয়ে চলে যায়। হাওড় এলাকায় যাতায়াতের সুবিধার জন্য হাওড়ের লোকজন মুলত পানির সময়টাকেই বেছে নেয় বিবাহ বা এই সংক্রান্ত উৎসবের জন্য। শিমুলের খুব শখ ছিলো এই এলাকার কোন একটা উপস্থিত থাকার, এবার হলোনা, দেখা যাক পরের বার কি হয়?


মাছ ধরায় ব্যস্ত দুই কিশোরী


মক্তব যাত্রা


খেয়ার জন্য প্রতীক্ষা


বিয়ের নৌকা


জল মানব


তাহিরপুরের আগে শেষ গ্রাম

এখানে সূর্যোদয় তার আগমনী বার্তা জানায় জলের বুকে চুমু খেয়ে, মধ্য দুপুরের রূপালী রোদে চকমক করতে থাকে পুরোটা হাওড়, শেষ বিকেলে সূর্যাস্তের সোনালী আভার রঙে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় ছন্দবদ্ধ ঢেও। দিকে দিকে ছুটে চলে বড় বড় মহাজনি নাও, ছোট ছোট নাইওরি নৌকা আর মাছ ধরায় ব্যস্ত মাঝিদের হৈ-হুল্লোড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে কচুরিপানার বিশাল মিছিল। শম্বুক গতিতে স্রোতের টানে বয়ে চলে বাঁশের চাইল, দূরন্ত কিশোরেরা কলাগাছের ভেলা নিয়ে উদ্দাম হাওড়ের বুকে চালায় নৌকা গাড়ী। আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘ আর তার ছায়া নিয়ে জলের উপরে ভেসে বেড়ায় বুনো ফুল, পানিফল, রঙিন শাপলা। কখনো কখনো হাওড়ের বুকে নেমে আসে নিরব নিস্তব্ধতা, কখনোবা ঘুম ভেঙ্গে রুদ্র রোষে জেগে উঠে আফাল তার প্রলয়ঙ্করী তান্ডবে আর বিরামহীন হুঙ্কারে তটস্থ করে রাখে হাওড়বাসীকে। হাওড়বাসীদের নিত্যদিনের আলাপ চারিতার একটা অংশ হয়ে থাকে আফালের মাঝে পড়ে সংগ্রাম করে বেঁচে আসার গল্প ।

বিকেলের মধ্যেই আমরা তাহিরপুর পৌছে গেলাম। উপজেলা পরিষদের রেষ্ট হাউজে থাকার ব্যাবস্থা রাসেল আগে থেকেই করে রেখেছে। কোন রকমে গোসল সেড়েই ছুটলাম পেট পুজা করার জন্য। বাজারে কয়েকটা হোটেল থাকলেও আমরা খুঁজে বের করলাম একটু ভিতরের দিকের রতনের হোটেল। সন্ধ্যাটা পার করলাম শনির হাওড়ের পাড়ে বসে।

তাহিরপুর উপজেলার সামনে মাটির হাওড় (আমরা যে ঘাটে এসে নামলাম), পিছনে শনির হাওড় আর বা দিকে একটু দুরে টাঙ্গুয়ার হাওড়। আমরা যে রুমটাতে আছি তা একেবারে শনির হাওড়ের গা ঘেষে। হাওড়ের পাড় ধরে লম্বালম্বি পাথুরে দেয়াল দিয়ে হয়েছে উপজেলা পরিষদকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। দেয়ালের গা ঘেষে হাওড়ের জলে কিছু করচ গাছ, তারপর যতদুর চোখ যায় শুধু দিগন্ত জোড়া হাওড়ের জল। রাতে আমাদের মাঝি (জুয়েল, একেও রাসেল ঠিক করে রেখেছিলো )আসলে তার সাথে কথা বলে ঠিক হলো আগামীকাল সকাল সাতটার মধ্যে আমরা বেরিয়ে পরবো।


শনির হাওড়ের পাড়ে উপজেলা পরিষদ


শনির হাওড়

রাতের অনেকটা সময় পার করলাম হাওড়ের পাড়ে বসে, আকাশে মেঘ করে প্রায় ২০ মিনিটের জন্য ঘুমোট হয়ে ছিল এর পর-ই শুরু হলো প্রলয়ঙ্করী বাতাস, হাওড়ের পানি এসময় পাথুরে দেয়ালো আছড়ে পরে বোমা ফাটানোর মতো শব্দ করছিল। মাত্র অল্প কিছুক্ষন এরপর-ই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। বাবু আর শিমুল ততক্ষনে ভিতরের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে, আমি আর রাসেল বৃষ্টি-র মধ্যেই বারান্দায় বসে কথা বলতে বলতে রাত তিনটা বাজিয়ে ফেললাম।

পরদিন সকালে উঠেই বেরিয়ে পড়লাম টাঙ্গুয়ারে যাবার জন্য। নাস্তা করার সময় দেখলাম এক লোক পাতার বিড়ি খাচ্ছে, আমরাও হোটেল থেকে বের হয়ে ২৫ টাকা দিয়ে এক প্যাকেট পাতার বিড়ি কিনে নিলাম। নৌকায় উঠেই সবাই চলে গেলাম নৌকার মাচার উপরে। বাম পাশে শনির হাওড়কে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম মাটির হাওড় দিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওড়ের দিকে। আকাশ জুড়ে তখনো মেঘ, মেঘের ছায়া পড়ে ঘোলাটে রঙের পানি তখন পুকুরের পানির মতোই শান্ত। এদিক সেদিকে ছুটে চলা কিছু নৌকা, হাটু পানিতে মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলে আর দুরে মেঘালয়ের পাহাড়ের চুড়ায় জমাটবাধা মেঘ দেখতে দেখতেই বৌলাই নদী পার হয়ে চলে আসলাম টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। এখানে যে কোনটা নদী আর কোনটা হাওড়, কোন হাওড়ের শুরু কোথায় আর শেষ কোথায় তা বোঝার সাধ্য আমাদের নাই।


মাটির হাওড়


হাওড়ের বুকে জেগে থাকা গাছ


জেলেরা মাছ ধরছে হাটু জলে


বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ঘরবাড়ি


টাঙ্গুয়ারের কাছাকাছি, দুরে মেঘালয়ের পাহাড়


টাঙ্গুয়ার হাওড়

টাঙ্গুয়ার আমাদের অভ্যর্থনা জানাল বৃষ্টি দিয়ে, বৃষ্টি শুরু হওয়া মাত্র হুড়মুড় করে সবাই নৌকার ছই এর ভিতরে ঢুকলাম, কিন্তু প্রকৃতির এই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে দুরে থাকাটাও আমাদের জন্য সম্ভব হলোনা, এক সময় একে একে সবাই বের হয়ে আসলাম বৃষ্টিতে ভিজবো বলে। হাওড়ে তখন এক অপার্থিব রূপ। বৃষ্টি-র জন্য বেশিদূর দেখা যায়না, আবছা আবছা বোঝা যায় ঐ হয়তো একটা নৌকা চলে গেল বা এইতো একটা পানকৌড়ি জলে মুখ লুকালো। একনাগাড়ে কিছুক্ষন বৃষ্টি-তে ভেজার পর জুয়েল ভাই (মাঝি) নৌকা নিয়ে চললো এক ফরেষ্টের দিকে। ফরেষ্ট হচ্ছে পানির মধ্যে হিজল, করচ, বরুন, বনতুলশী-র ছোট ছোট বন, স্থানীয় লোকের কাছে ফরেষ্ট নামেই পরিচিত। ফরেষ্টে এসে নৌকাকে নোঙর করা মাত্র-ই বাবু, রাসেল আর শিমুল পানিতে নেমে গেল গোসলের জন্য। সাতার না জানার কারনে আমি হতভাগা তখন নৌকাতে বসে পানিতে ওদের দাপাদাপি দেখছি। আমাকে এভাবে বেকুবের মতো বসে থাকতে দেখেই জুয়েল ভাই দয়াপরবশত নৌকা ছেড়ে দিল এবং আরেকটা ফরেষ্টে এনে নৌকা নোঙর করলো যেখানে আমার বুক সমান পানি হবে, আর কি নৌকায় বসে থাকা যায় ?


হাওড়ের বুকে বৃষ্টি


হাওড়ে স্নান


হাওড় থেকে সরাসরি উঠতে না পেরে গাছ বেয়ে নৌকায় উঠার চেষ্টা

পানিতে প্রায় ঘন্টাখানেক দাপাদাপি করে ক্লান্ত হয়েই একসময় নৌকাতে উঠলাম, নৌকা এবার টাঙ্গুয়ারের বুক চিড়ে চলতে লাগলো মেঘালয়ের পাহাড়ের দিকে। টাঙ্গুয়ার হাওড়, যেখানে টলমলে জল প্রতিনিয়ত চুরি করে আকাশের রং, পাহাড়ের ভাজে মুখ লুকিয়ে ঘুমায় পেঁজা মেঘের দল, সারি সারি গাছ প্রতিনিয়ত স্নান করে জলের বুকে,যেখানে সূর্য উঁকি দেয় সোনালী স্বপ্ন নিয়ে, চাঁদ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে তার নিজের প্রতিবিম্বের দিকে, তারারা ঘুমায় জল কল্লোল শুনতে শুনতে, মেঘেরা জল ছোয়ার লোভ নিয়ে উড়ে যায় অনেক নিচ দিয়ে। যেখানে স্বচ্ছ টলমলে জলের নিচে সাপুড়ের বীনার সুরে দুলতে থাকা সাপের মতো দুলতে থাকে ঘাস, গাছ আর লতাপাতা; যেখানে বাতাস কখনো থমকে দাঁড়ায় না।

বলা হয় ‘৬ কুড়ি কান্দা আর ৯ কুড়ি বিল’ নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই হাওড়। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরণা) এসে মিশেছে এই হাওরে। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯,৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ গ্রামগঞ্জ ও কৃষিজমি। একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে 'রামসার স্থান' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন।
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় বাংলাদেশী জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর। এ হাওরে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওড়ে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, শঙ্খচিল, জলকুক্কুট ইত্যাদি পাখির নিয়মিত বিচরণ এই হাওরে। এছাড়া আছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ুল (বাংলাদেশে এর নমুনাসংখ্যা ১০০টির মতো)। ২০১১'র পাখিশুমারীতে এই হাওরে চটাইন্নার বিল ও তার খাল, রোয়া বিল, লেচুয়ামারা বিল, রুপাবই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না ও আন্না বিলে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮,৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয়। এই শুমারিতে অন্যান্য পাখির পাশাপাশি নজরে আসে কুট, মরিচা ভুতিহাঁস, পিয়ংহাস; সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, লেনজা, ডুবুরি, পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখিও।
এছাড়াও ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর বাস, এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর।
টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম হলো জলজ উদ্ভিদ। এছাড়া আছে হিজল, করচ, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলশী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া ইত্যাদি জাতের উদ্ভিদও।

আসার আগে জুয়েল ভাই আমাদের নিয়ে গেল পানির মাঝে ভাসমান এক কালভার্টে (শীতকালে switch গেইটের কাজ করে), এখানে কিছু ছবি তুলে ফিরে চললাম তাহিরপুরের দিকে, ফিরে যাবার পথে আধা ঘন্টা নৌকাও চালালাম (নৌকা চালানো বলতে হাল ধরে বসে থাকা)।


মেঘালয়ের পাহাড়


কালভার্ট


কালভার্ট


তাহিরপুরে ফিরে এসে কিছুক্ষনের মধ্যেই সুনামগঞ্জ শহরের দিকে রওয়ানা দিয়ে দিলাম, এবার আর কোনদিকে না ঘুরে তাহিরপুর বাজার থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে সরাসরি সুনামগঞ্জ। ভাড়া লাগলো মাথাপিছু ১০০ টাকা করে। সন্ধ্যাটা হাসন রাজার বাড়িতে কাটিয়ে সেই রাতেই রওয়ানা দিলাম প্রিয় যানজটের শহর ঢাকার দিকে।

পরবর্তী ভ্রমন ঃ রাজকান্দী ফরেষ্ট ও হামহাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:০৫
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×