somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুবনাশ্বের সন্ধানে মান্ধাতা

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১. উত্থান

একদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। গ্রামে।

মাটির রাস্তার ওপরে পানি জমছিল। আলগা মাটি পানির স্রোতে মিশে পড়ছিল নিচু ক্ষেতে। রাস্তার এখানে ওখানে হাঁ করে ফাটল জানান দিচ্ছিল তার অস্তিত্ব। আকাশে বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। হা হা করে বাতাস বইছিল, তাতেই সব মহীরুহ গাছেরা মাথা নুইয়ে বসেছিল। কোথায় সূর্য লুকিয়েছিল কে জানে? সব পাখি বসেছিল খড়-কুটোর বাসায়। সব কিছু কেমন ভেজা আর ঘোলাটে লাগছিল।

তবু সেদিন দুই-চারজন করে ছেলেমেয়ে বেরোচ্ছিল। মাথা কচু পাতায় ঢাকা। ভেজা গা বেয়ে টপটপিয়ে পড়ছিল পানি। ঠাণ্ডা লাগবে, পা পিছলাবে, সাপে কামড়াবে - কত কিছু বলেই না তাঁদের ঘরে আটকে রাখার চেষ্টা করা হল। লাভ নেই। গাছের আম তাদের ডাকছে তো! এ গাছ থেকে ও গাছ, এর বাড়ি থেকে ওর বাড়ি ওরা আম কুড়িয়ে বেড়ায়। প্রতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁদের দল ভারি হয়। কোঁচড়ে আম নিয়ে আনন্দে ঝড়ো বাতাস, বিদ্যুৎচমক বা গায়ে বিঁধে বিঁধে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার পরোয়া না করে ঘুরে বেড়াতে থাকে। কোন জায়গায় হয়তো অল্প পানি জমেছে, সবাই মিলে সেখানে লাফাতে থাকে। কেউ হয়তো পিছলে পড়ে, তাতে না ঘাবড়ে সবাই হাসতে হাসতে তাঁকে টেনে তোলে। লাফাতে লাফাতে পানি উপচে বাইরে পড়ে, সেই নোংরা পানি শুষে নেয় মাটি। পড়ে থাকে শুধু নরম কাদামাটি।

দারুণ বাতাসে গাছেদের ডালপালা মড়মড়িয়ে ওঠে। টুপটাপ করে আম পড়ে। ছেলেমেয়ে এতে আরও উৎসাহিত হয়, তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী চোখে তারা আরো আম খোঁজে। কুড়াতে থাকে। হয়তো হঠাৎ দুহাত সামনে দিয়ে সড়সড়িয়ে চলে যায় কোন সাপ। আঁতকে ওঠে দলটি, হয়তো, কিন্তু তাতে চলা থামে না। ধীরে ধীরে দল বড় হয়, তা দেখে বৈরি প্রকৃতি একটু একটু করে হতাশ হতে শুরু করে। সুঠাম দেহের কিশোর কিশোরী, বা পেটফোলা রুগ্ন কোমরে ঘুনসি বাঁধা শিশু সবাই দলে যোগ দিতে থাকে। তাই দুরন্তপনাও বাড়ে। এই হাসি-ঠাট্টা, পাগলামির মাঝে পথের ধারে পড়ে থাকা পাথরে দুই একজনের পা যে ছড়ে যায় না, তা নয়। কিন্তু তারা ওই পথের ধারের দূর্বা চিবিয়েই লাগিয়ে দেয় ক্ষতে। সামান্য ক্ষত তাঁদের দমাতে পারে না। গ্রামের বড়রা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে তাঁদের ডাকে, সুযোগ থাকতে বাড়ি ফিরতে বলে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! দুরন্তের দল বধিরের ভান করে নিজেদের কাজ করে যায়, নিঃশব্দে।

একসময় বৃষ্টি থামে। সাপেরা ঢোকে গর্তে। মেঘলা আকাশ ঝকঝকে কাঁচের মত হয়ে দেখায়। জীবনানন্দের হংসী রোদ চারিদিক আলো করে ফেলে। নতুন আলোয় সূর্য ফোটে, অন্ধকার তাড়িয়ে দেয়। সে আলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিশোরের দল। আলো দেখে বড়রা জুতো পরে কাদা সামলে বেরোয়, কিশোরের দলকে ডাকে। বধির কিশোরেরা এমনকি ঘাড় ঘুরিয়েও দেখে না। তাঁদের দৃষ্টি ঐ ওপরে।


২. একটি সংলাপ, তার প্রেক্ষাপট

এখানে, শহরের খানিকটা অংশ,
──বিকালের বিদায়ী কমলা রোদ পড়ে পিঁপড়ের মতো ব্যস্ত

অভিমানী দেহের নিউরনের মতো
লাল নীল সংকেতে ব্যস্ত দুরন্ত চাকাগুলো

গোধূলির ভাপসা গন্ধে উড়ন্ত উলুর মতো
রঙবেরঙের মানুষের রাস্তা পারাপার,
অনিয়মিত হর্ন বাজে - হঠাৎ দুপুরে -
বেড়ে ওঠা দপদপ মাথাব্যথার মতো

ট্রাফিক পুলিশের ক্লান্ত হাত নড়ে যেন
হাওয়ায় সংকটাপন্ন মৃত বৃক্ষের নড়বড়ে ডাল,
দেশোদ্ধার হচ্ছে শতপায়ে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে আশেপাশে
ঝিঁঝিঁর মতো গুঞ্জনে কবলিত চারদিক।

ল্যাম্পপোস্টগুলো রক্ত কেড়ে নিতে জ্বলে উঠলো ক্রমে ক্রমে
রাক্ষসের দীর্ঘ ধারালো চকচকে দাঁতের মতো।
গোবরপুষ্প মিশ্রিত সত্ত্বার জানালায় ভেসে ওঠে
──দূরের পথের চিহ্ন║

এখন,

এখানে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা,
তাদের দেখা হল সারিবদ্ধ ছুটন্ত পিঁপড়ের মতো
──সে তাকে বলল : 'যেয়ো না',
──সে তাকে বলল : 'আবার তো দেখা হবে'।

এখন,

এখানে সন্ধ্যা,
──সবার সাথে সেও ছুটলো পঙ্গপালের মতো
──নির্বাক মূর্তির মতো সে হয়ে রইল স্থির║


৩. বই পড়ো জীবন গড়ো

একবার একটা মানুষ বেড়াতে গেল বনে। বনটা ছিল অনেক ঘন সবুজ, আর লম্বা লম্বা গাছের ছায়ায় সারা দিন রাত সেখানে অন্ধকারের সন্তানেরা বাস করত। আলোর অনুপ্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এমন জায়গায় সে বেড়াতে গেল কেন? মানুষটা সবুজ ভালবাসত, প্রকৃতি ভালবাসত, আর ভালবাসত একাকী বসে বই পড়তে- তাই।

ঘুরতে ঘুরতে সে পৌঁছল বনের মাঝখানে, সেখানে গিয়ে লম্বা লম্বা কিছু দেবদারু গাছের নিচে চাদর পাতল। সে কিছুক্ষণ উপভোগ করল প্রকৃতির সান্নিধ্য, শুনল বাতাসে মড়মড়িয়ে গাছের ডাল নড়ার শব্দ, ঝিরঝির করে পাতা ঝরে পড়ার শব্দ, অদৃশ্য কোন পোকার কীটকীট ডাক। তারপর সাথে আনা ব্যাগটা থেকে সে একটা বই বের করল। চাদরে উবু হয়ে শুয়ে পড়তে লাগল বইটা। বইয়ের পাতা যে গাছগুলোর মৃত সঙ্গীদের প্রতিনিধিত্ব করছিল, সেটা তার খেয়ালে ছিল না।

চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত তখন কোন মানুষ ছিল না। নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ পরিবেশ। আদিম রহস্য উন্মোচনের উপযুক্ত সময়। তাই চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেরা একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিল, তাঁদের হাজার বছরের জড়তা ভেঙে প্রতিশোধ নেবার সিদ্ধান্ত। মুহূর্তের মাঝে তাঁদের প্রাচীন ডালগুলো নখের মত বেঁকে এসে লোকটাকে মাটির সাথে চেপে ধরল, আর ছোট তীক্ষ্ণ ডালেরা চামড়ার ওপর দক্ষ সার্জনের মত আঁকিবুঁকি কাটতে শুরু করল। লোকটা আতংকে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করতে লাগল, কিন্তু যে চিৎকার কেউ শোনে না, তাকে আদৌ চিৎকার বলা যায় কি?

পরের দিন এক কাঠুরে কাঁধে কুঠার নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেই জায়গাটায় এল। সে অবাক হয়ে দেখল, জায়গাটার গাছগুলোকে অন্যান্য গাছ থেকে অনেকটা সতেজ দেখাচ্ছে। সতেজ, সজীব... আর কেমন যেন খুশি খুশি। কাঠুরে আরও এগুলো, তারপর সামনে সে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। মাটিতে নিখুঁত চারকোণা একটা কিছু পড়ে আছে। জিনিসটা বেশ বড়, প্রায় এক মানুষ সমান লম্বা। আরও ভালো করে তাকাতেই কাঠুরে বুঝতে পারল- জিনিসটা আসলে একটা বই! বইটার মলাট, পাতা সবই চামড়ার তৈরি, চামড়াটা কেমন কালচে বাদামী রঙের। আর বইটার মলাটের ঠিক মাঝখানটায় একটা ছোট্ট জিনিস নিয়মিত বিরতি দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে স্পন্দিত হচ্ছে। জিনিসটা চিনতে পেরে কাঠুরে ভয়ে দুই পা পিছিয়ে এল, এরপর সে দেখতে পেল- চারপাশের গাছগুলোর কান্ডের উপরাংশ বেঁকে এসেছে বইটার দিকে। দেখে মনে হচ্ছে গাছগুলো মাথা নুইয়ে বইটা পড়ার চেষ্টা করছে!

সে প্রচণ্ড ভয়ে সেখানেই কুঠার ফেলে পালিয়ে এল লোকালয়ে। আর হ্যাঁ, তারপর থেকেই রটে গেল চারিদিকে- বই পড়াটা উদ্ভিদ-মানুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই খুব খুব ভাল অভ্যাস।
৪৮টি মন্তব্য ৪৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×