খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে চলে যাই। ট্রেনের দুলুনিতে বসে বসে আম্মুর মোবাইলে sms পাঠাই। বাংলাদেশে তখন ভোর ৪ টা।
ammu, ami ekhon class a jacchi. accha, tumi to onjon dotter oi gaanta sunso tai na? oi je 'bosey achi station a tey'? otar ekta line chilo, ‘trainer dolate roj dupurey, mayer koler sei dolata jai mone porey jai amar.’ Jano, amaro ekhon tomar koler dulunir kotha mone porse. sorry mamoni, tomakey ghum theke jagabar jonno. nao, abar protidin sms pabar thela samlao. Lol. tumi ghumao.
প্রায় সাথে সাথেই রিপ্লাই আসে।
'sabdhaney thakis kintu, toder train to khub jorey chole, seater sathey valokore setey bosbi. hatol ba lohar rod thakle valo kore chepe dhore rakbi. mone jeno thake. onjoner oi gaanta to sunsi, amar tokhon tor nanur kotha money porto, lol, assa, oi gaanta ekhon koi re? amito sedin onek khujeo pelam na. amakey janash.'
এই হল আমার আম্মু। মনে মনে আমি হাসি। আমি স্বান্তনার স্বরে লিখি,
tumi ekdom chinta korona mamoni, ami handle khub sokto kore dhore bose achi. train er babaro saddho nei amakey seat theke ek chul norai. gaanta niye chinta koro na, ami mail a attach kore pathaboni tomakey.
ক্লাসের পর ক্যাম্পাসে বসে ল্যাপটপ থেকে আম্মুকে মেইল করি। hi mam, i'm in campus now, just class have been finished and going to work now, talk to u later on at tonight.bye. অন্জনের গানটা হার্ডডিস্কে না থাকায় সেদিন আর এ্যাটাচ্ করা হয়নি। পরে তাঁকে ডাউনলোড লিঙ্ক দিয়েছিলাম। আমার গানের নেশার পুরোটাই আম্মুর কাছ থেকে পাওয়া।
প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে প্রতি রাতে বাসায় ফিরে দেশে ফোন দিতে হয়। সারাদিন কি করলাম সেগুলোর খুটিনাটি বর্ননা দিতে হয়। প্রতিবারই ফোন রাখার আগে কড়া করে ধমক খাই 'খবরদার একদম রাত জাগবি না, নিশাচর কোথাকার।'
এস এস সি পরীক্ষার জন্য রাত জাগার বদ্যাভাস হয়েছিলো। সেই তখন থেকে আমাকে মাঝে মাঝে 'নিশাচর' বলে ডাকা হয়। আম্মু, তুমি তো জাননা, পড়ার চাপে আর তোমার দেয়া নামের অবদানে তোমার নিশাচরকে এখন সারারাত অনলাইনে থাকতে হয়।
অস্ট্রেলিয়ান এ্যামবাসি যখন আমার আবেদন নাকোচ করে দিলো, বাসায় এসে তখন মামনিকে ধরে সে কি কান্না আমার! বল্ল, 'ধুর পাগল, এত ছোট একটা কারনে এভাবে কাঁদতে হয় নাকি?' দ্বিতীয়বারে যখন ভিসা পেয়ে গেলাম, সেদিন মামনি আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। বল্লাম, 'ধুর পাগলী, এত ছোট একটা কারনে এভাবে কাঁদতে হয় নাকি?' মামনি কান্না মাখা হেসে বল্ল, 'আমার কথা আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিলি?'
তুমি নিজের হাতে আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিলে। তুমি জানতে যে মাথার বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারি কিন্তু কোলবালিশ ছাড়া কখনই আমার ঘুম হয় না। তাই আমার সু্টকেসে আমার কোলবালিশটা ভরে দিলে। কেউ কোনদিন কোলবালিশ সাথে নিয়ে বিদেশে গিয়েছে কিনা জানিনা তবে সিডনি এয়ারপোর্টের কাস্টমস অফিসার যখন আমার ব্যাগ চেক করছিল, আমার কোলবালিশটা দেখে সে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। তখন তাকে বলেছিলাম 'this is my lap pillow, i cant sleep without it, that's why my mom gave it along with me, u can check it out.' মহিলাটার মুখ দেখে মনে হল জীবনে এর আগে কোনদিন তিনি এমন অভিæতার মুখোমুখি হননি। পরে মামনিকে এই ঘটনা বল্লে মামনি তো হাসতে হাসতে শেষ।
যেদিন দেশ ছেড়ে আসি, দেখলাম আমার মেয়েটার লাল মুখ কাঁদতে কাঁদতে আরো লাল হয়ে গেছে। আমিও যে সেদিন কাঁদব তা আমি সপ্নেও ভাবিনি।
জানতেন, একটা চশমা আমার কয়েকমাসের বেশী যায় না। ভেঙে ফেলি। তাই আম্মু বুদ্ধি করে আমার ব্যাগের ভেতর কয়েকটি চশমা দিয়ে দিয়েছিলেন। এখন বুঝি, মাম আমার কত্ত বড় উপকার করে ছিলেন। এখানে চশমার যা দাম, চশমা কিনতেই আমার সেমিস্টার ফি'র অর্ধেক চলে যেত। আম্মু প্রায়ই মজা করে বলতেন, তোর চোখ আর চশমার পেছনে যতটাকা খরচ করেছি, সেই টাকা দিয়ে আমি তোর মত আরেকটা ছেলে পালতে পারতাম।
অথচ আমার চোখের এই দুরবস্থার জন্য কিন্তু মামনিই দায়ী ছিলেন। সেই ক্লাস টু তে তিনি আমার হাতে সত্যজিৎ রায় তুলে দিয়েছিলেন। সেই যে শুরু হল। তারপর একে একে তাঁর সবগুলো প্রিয় লেখকের প্রায় সবগুলো বই আমাকে দিয়ে গলাধঃকরন করানো হল। সেই সাথে তারঁ ব্যাক্তিগত লাইব্রেরির সব বই! উফ! যেন আমাকে সাহিত্য বিশারদ বানাতে চেয়েছিলে আম্মু! মানুষের মারা তাদের ছেলেদেরকে কতকিছু উপহার দেয়। সে শুধু দিতো বই। কোন জন্মদিন বা কোন অকেশনে আমার মনে পড়ে না আম্মুর কাছ থেকে আমি বই ছাড়া অন্যকিছু পেয়েছি। শেষে আমার বইয়ের এমন নেশা হল যে আব্বুর ভয়ে কতদিন কম্বলের নীচে র্টচ লাইট জালিয়ে বই পড়েছি! এর পরও চোখ বাবাজি যে এখনও সাথে আছে এই তো বেশী। তবে আম্মুর প্রচেষ্টা হয়ত কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছিলো। তাইতো, মিঠু আন্টি একদিন বল্ল-' আপা, আপনার ছেলেটি তো বই ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।' আম্মু মুচকি হেসে বল্লে, 'হুমম, পরে 'ই' এর জাগায় 'উ' না হলেই হয়।' আমি তো প্রথমে বুঝতেই পারিনি, পরে যখন বুঝলাম, তখন খুবই মজা পেয়েছিলাম আম্মুর কথায়।
মামনির রসবোধ আমাকে সবসময়ই মুগ্ধ করেছে।
সেদিন আম্মুকে ফোনে লরেলের কথা বলতেই আমাকে বলে, 'দেখিস, বিদেশী মেয়েদের সাথে আবার কোন সর্ম্পকে জড়াস না যেন। ওদের চরিত্রে বিশাল বিশাল সমস্যা থাকে।' আমি তো হাসতে হাসতে শেষ।
মামনি তোমার সেই দিনটির কথা মনে আছে, চশমার দোকানের ওয়েটিং রুমে হঠাৎ লিনুর সাথে দেখা হবার পর যেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে,' তুই কি সাইকেল নিয়ে এদিকেই আসিস নাকি?' আমি সেদিনও হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়েছিলাম। কারন তুমি হয়ত ভেবেছিলে, আমি প্রতিদিন বিকালে ওর সাথে ডেট করতেই সাইকেল নিয়ে বের হই। আম্মু, আমার অবুঝ মেয়ে, একজন মানুষ আমার জীবনে আসবে, আর আমি সেটা তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখব, সেটা কি কখনো হয়?
আম্মুর গানের গলা খুবই চমৎকার ছিলো। সেসব দিনের কথা এখনো মনে পড়ে ভীষন, খুব ছোট বেলায় আমার যখন জ্বর হত তখন মামনি আমাকে নিয়ে রাতের বেলা আমাদের বাসার ছাদে বসে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত আর আমাকে গান শুনাতো। মামনির কাঁধে মাথা রেখে খুব মন দিয়ে তাঁর গান শুনতাম। মোমের পুতুল মোমের দেশে, আমরা সবাই রাজা, আমাদের দেশটা সপ্নপুরী, বাবা বলে গেলো আর কোনদিন গান করনা, বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে----এইগান গুলো মামনির মুখ থেকে শুনে শুনে সব মুখস্ত করে ফেলেছি। শিশুতোষ সেই গানগুলো আমার কাছে ছিলো ঘুম পাড়ানি গান। মামনি, আমার যদি কখনো একটা দুষ্ট বুড়ি হয়, আমি তোমার কাছে ওকে গান শিখতে দিবো। তুমি তোমার জানা সব গান ওকে শিখাবে। তারপর তুমি যখন আকাশের তারা হয়ে যাবে, তখন ওই বুড়িটা তার এই বুড়ো ছেলেটাকে তোমার শেখানো ওই গানগুলো গেয়ে তামার মত করেই ঘুম পাড়াবে।
মা, তোমার খুব শখ ছিলো মা ডাক শোনার, কিন্তু জীবনে খুব কমই তোমার এই শখটা পূরন করতে পেরেছি। বন্ধুরা যখন মা বলে ডাকত, তখন মনে হত মা বুঝি খুব ভিন্ন কিছু, সে আমার চিরচেনা 'আম্মু' নন। প্রথম প্রথম কেমন যেন লজ্জা করত। তাই মামনি ডাকতাম। আরেকটু বড় হলে 'আম্মু।' এখন মা বলে ডাকতে ইচ্ছে হয় খুব, কিন্তু মা, আমার কি সেই যোগ্যতা আছে?
কতদিন রাতে ঘুমাই না। মা, আমার মা, এখন সারারাত নির্ঘুম কাটলেও কেউ আর আমাকে ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে শোনায় না।
প্লিজ তুমি এই লেখাটি পড়ো না মামনি, খুব কষ্ট পাবে। আর যদি কোন বকাঝকা দিতে ইচ্ছে করে তাহলে প্রিয়তিকে দিও। সেটা ওর প্রাপ্য। ওর কবিতাটা পড়েই তোমাকে নিয়ে খুব লিখতে ইচ্ছে করল।
লরার এই গানটি এখন শুনতে ইচ্ছে করছে খুব।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০০৮ রাত ১১:৫৪