মাস ছয়েক আগের অসহ্য একটা একাকী
দুপুর:
আবার সিদ্ধান্তটা ঝালিয়ে নেয় রোজা অথবা রোজ। এবারে একটা হেস্তনেস্ত হবেই। নিজের নিদ্ধান্তটা পাকা এবারে একদম, আর পিছটান নেই কোন।
থাকবেই বা কেনো? কমতো ভুগেনি সে। একটা ছোট্ট ভুলের এত বড় সাজা পাবার কোন মানে হয় না। প্রেম করে ফেলেছিলো ছাগলটার সাথে, বাসায় পাত্র আর ঘটকের আগমনে তোড়ে হঠাৎ করেই পালিয়ে বিয়ে করে ফেলা।
মা বাবা মেনে নিয়েছিলেন সাথে সাথেই - দুপক্ষেরই। দুপাশেরই একমাত্র সন্তান ও আর ওর বর। বিয়ের পরও বছরটাক ঠিক ছিলো সব কিছু, দারুন ভালোবাসার। গোল বাধলো তারপর।
চাকরী তলাশে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে বর। আর রোজ একা একা বাসায় বোর। আর আশেপাশের মানুষ গুলোর যেনো নিজের কোন কাজ নেই, কেবলই বেকার স্বামীর খুঁত খুঁজে বের করা। তখন রাগ হতো, এখন মনে হচ্ছে ঠিকই তো ছিলো সব।
যেদিন থেকে ব্যাবসা শুরু করেছে ওমনি পাখা গজিয়েছে জানোয়ারটার।
জানোয়ার, হ্যাঁ জানোয়ারই তো! সকাল সাতটায় ঘুম ঘুম চোখে ডাকা ডাকি শুরু করে দেবে ঘুমের বারটা বাজিয়ে, সাহেব বাইক টেনে দেবেন ভোঁ দৌড়, ফিরবেন রাত নটা থেকে এগারোটা - কোন ঠিক নেই।
এতক্ষন বাসায় একা একা বসে জীবনটার মানে সব অর্থহীন লাগে। নিজেকে মনে হতে থাকে ওর হাতের পুতুল। তা কেন হবে? বিয়েটা কেন করা? ওকে সবসময় কাছে পাবে বলেই তো, নাকি? তাই যখন নেই, দুপুরের ভয়াবহ মন খারাপ করা সময়টায় ফোন করলে প্রায়ই দু'মিনিটের বেশি সময় দেয় না, কি নাকি ক্লায়েন্টের সাথে থাকে রোজই।
"হুম, ওর আসলে আমাকে আর দরকার নেই," নিজের মনেই ভাবে রোজ, "এবারই বাপের বাড়ি গিয়ে তালাক দিয়ে দেবো। আমার জন্যে যার সময় নেই তাকে আমার দরকার নেই।"
স্বামীর কাছে অনুযোগ করেছিলো এসব নিয়ে আগে, অনেক বার, হেসে বলে দেয়, "তোমার জন্যেই তো খাটি, আজ বাদে কাল ছেলে-মেয়ে হবে, ওদের জন্যে তৈরী হতে হবে না?"
গাল ফোলালে, কাছে টানে ও, আদর করে বলে, "তুমিও একটা কিছু শুরু করে দাও, চাকরী-বাকরী, দেখো সময় কেটে যাবে ঠিক।"
"দায় ঠেকেছে", প্রায় ফুঁসে ওঠে রোজ, নিজের সাথেই, "চাকরী করলে আর বিয়ে করেছি কেনো?"
"নাহ! এবারে ঠিক ঠিক তালাক দিয়ে দেবো" - মানসিক ভাবে অনেক হাল্কা লাগে নিজেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরে, চোখে ঘুম নামে দুপুরের।
আজকের কর্মব্যাস্ত বিকেলটা:
নিজের বুটিকটা আজ বিকেলের পরপরই বন্ধ করে দেবে আজকের মতন, ভাবে রোজ, সন্ধে বেলা ডেট আছে -মনে হতেই ভালোবাসার আমেজ চোখ দুটো স্বপ্নালু হয়ে ওঠে।
তাড়াতাড়ি ক্যাশটা মিলিয়ে নেয়, মাত্র এক ঘন্টা আছে, উফ! এতো কাজ!
মনটা একটু খারাপ হয়ে ওঠে, ছমাস আগের কথা মনে করে, একটু লজ্জাও লাগে। মানুষটা কত খাটতো বুঝে উঠতে পারেনি বলে নিজেরই ওপরে রাগও হয় খানিকটা। এখন বোঝে ও সবই। নিজের দোকানটা চালু হবার পরে। নিজের একটা আলাদা পরিচয়, প্রতিষ্ঠা, নিজস্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠা - এসবের মাঝে ভালোলাগা খুঁজে পেয়ে বেশ আত্মতৃপ্তি পায়।
ছেলেটা আজো লেট করে অন্যান্য দিনের মতন, তবু প্রিয়মানুষের অপেক্ষায় ভালোলাগা থাকে্।
তড়িঘড়ি করে টেবিলে এসে পৌঁছানো ছেলেটার ঘামে ভরা মুখটা চট করে মুছেদেয় রোজ হাতব্যাগ থেকে রুমাল বের করে।
"ইশ! এত প্রেম সেদিন কোথায় ছিলো?" - টিপ্পনি কাটে ছেলেটা।
"আরে দুর!, তখন বোকা ছিলাম" - রোজ এক কথায় শেষ করে দেয় খোঁচাটা।
"আচ্ছা!," যেন আকাশ থেকে পড়ে ছেলেটা, "তা আবার কবে ডিভোর্স দিচ্ছো আমাকে?"
"তুমি শালা ইতর একটা! আবার বলো, এবারে সত্যি দিয়ে ফেলবো" - শাসায় বৌ, অবশ্য মিষ্টি হেসে, চোখে প্রশ্রয়ের হাসি হেনে।
আজকের দিনটাতে প্রথম জানিয়েছিলো ছেলেটা ওকে, ভালোবাসি, চার চারটে বছর আগে, শেষ বছর সেটা ওদের দুজনার ভার্সিটিতে।
মেয়েটা বাবাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানায়, সেই পাগলামি করে ডিভোর্স দেবার সময়টাতে বাবা না ঠেকালে মানুষটাকে হারাতো ও।
আবার সিদ্ধান্ত নেয় নিজেই, খুব খারাপ হতো সেটা।
"দোকানটা দেবার পরথেকে বৌটা বেশ বদলে গেছে," ভাবে ছেলেটা, "ছটফটানি-চাপল্য আর হুটহাট পাগলামিটা ঠিকই আছে, শুধু বাস্তববোধটা আর দায়িত্ববোধ বেড়েছে অনেক, ভালোই।"
দুজনে আবছা স্বরে এলোমেলো কথা বলতে বলতে স্যুপের বাটিতে চামচ ডোবায়।
বাইরে আকাশটা অনেক সুন্দর আজ। তারাভরা, মেঘ হীন।
মূল পোষ্ট