somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আঁচল

০৬ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক।
কিন্তু মা সবাই শাড়ি পরবে। ভার্সিটির প্রথম পহেলা বৈশাখ। তুমি প্লিজ একটা শাড়ি পাঠাও না। অয়নীর কথা শুনে রাহেলা বেগম ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন। শান্ত কন্ঠে বললেন, মাগো সবাই শাড়ি পরবে আর তোরও পরতে হবে এমন কোন কথা আছে? এ বছরই তোর বাবা মারা গেলেন। অনেক কষ্টে তোকে পড়া খরচ পাঠাই। একটু বোঝার চেষ্টা কর।
মায়ের কথা শুনে অয়নীর কান্না এল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,তোমার পুরনো কোন শাড়িও কি নেই? আসলে ডিপার্টমেন্টের ম্যাডাম বলছিলেন ভাসির্টির প্রথম বর্ষবরণে যেন সবাই শাড়ি পরি।
রাহেলা বেগম বললেন, জানি মা। তোর এ সময়টাতো আমিও পার করেছি। কিন্তু মা রে মধ্যবিত্ত পরিবারটা খুব খারাপ। কারো কাছে হাত পাতাও যায় না আবার কাউকে বলাও যায় না। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার কাছে আমরা খুব বেশি অসহায়।
মনখারাপ ভাব ঢেকে অয়নী বলল, লাগবে না। রাখি মা। ভাত খেতে যাবো। মুঠোফোন রাখার পর হঠাত্‍ করে ও লক্ষ্য করলো চোখের পাতা ক্রমশ ভিজে যাচ্ছে। কিছু কিছু মেয়ে আছে মন্দভাগ্য নিয়ে জন্মায়। হয়তো অয়নীও তাই। তা না হলে হুট করে ওর বাবাও বা কেন মারা যাবে। আর পরিবারের এই দুরবস্থাও বা কেন হবে। আজ অনেকদিন পর অয়নীর খুব বাবাকে মনে পড়ল। বাবার অনেক আদরের মেয়ে ছিল অয়নী। যা চাইতো তাই দেয়ার চেষ্টা করতো। যদিও অয়নীর আব্দারও ছিল অল্প। বাবার ছোট একটা সরকারি চাকরি। মাস শেষে অপর্যাপ্ত টাকা। এই দিয়ে চারজনের সংসার। গরীবের সাধ আহ্লাদ খুব কম। আর মধ্যবিত্তের যাও প্রত্যাশা থাকে তাও অর্থের অভাবে বিলীন হয়ে যায়। প্রাপ্তির আনন্দ যেখানে অল্প। এরমাঝেও রহমান সাহেব পরিবারের সবার মন রক্ষার চেষ্টা করতেন। অয়নীর মনে পড়ে ছোট কালে ওর একটা সাইকেলের ইচ্ছে ছিল। পাড়ার সবার একটা করে সাইকেল ছিল। সরকারি কলোনির পেছনের মাঠটায় প্রতি বিকেলে সাইকেল রেস হতো। অয়নী প্রতিদিন একা দাঁড়িয়ে থাকতো। খুব ইচ্ছে হতো সাইকেলে চড়তে। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারতো না। মাঝেমাঝে তৌফিক এসে বলতো, কিরে, চড়বি নাকি সাইকেলে? আয় আয়। তৌফিক অয়নীর সাথেই পড়ে। ও পাড়ায় থাকে। খুব ইচ্ছে হত তৌফিকের পেছনে সাইকেলে ঘুরতে। কিন্তু কোথাও যেন একটা বাঁধা কাজ করতো।
একবার মুখ ফুটে বাবাকে বলেই ফেললো একটা সাইকেলের কথা। রহমান সাহেব মেয়ের কথা রেখেছিলেন। পরের জন্মদিনে মেয়েকে সাইকেল কিনে দিলেন। দুই চাকার ছোট্ট সে জিনিসটি পেয়ে অয়নীর মনে হয়েছিল, সমস্ত পৃথিবীকে ও হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছে। এরপর কলোনির সেই মাঠে অয়নী প্রায়ই সাইকেল নিয়ে যেত। ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ার সময়। নতুন সাইকেল দেখে তৌফিক বলতো, কিরে টুনটুনি নতুন সাইকেল কিনলি মনে হয়? ভাব দ্যাখো মেয়েটার। এত করে বললাম আয় আমার সাইকেলে চড়। তা করবি না। ঢং! তৌফিকের কথা শুনে অয়নী হাসতো। বলতো, এই আমাকে শিখিয়ে দে না, কিভাবে চালাতে হয়। তৌফিক বলতো, একটা শর্ত আছে। বল রাজি?
-রাজি
-ও মা শর্ত না জেনেই?
-আমি যে কোন শর্তে রাজি। বলে ফেল না।
তৌফিক মুচকি হেসে বলতো, শোন আমি সাইকেল চালাবো। তুই আমার কোমর ধরে পেছনে বসবি। দেখিস নি সিনেমায় নায়ক যেভাবে নায়িকাকে নিয়ে বাইক চালায়।
-তুই সিনেমার নায়ক নাকি?
-হুম। আমি সালমান খান। তুই ঐশ্বরিয়া। আয় আয়। তাড়াতাড়ি কর না। একটু পরেই আজান দেবে। দেরি হলে মা বকবে।
অয়নী দ্বিধা না করেই শর্তে রাজি হয়ে গেল। তৌফিকের কোমর ধরে পেছনে বসে পড়ল আর তৌফিক এক প্রকার টেনে টুনে কিছু দূর যাওয়ার পরই ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে। সেবার অয়নীর হাঁটুতে খুব কেটেছিল। ফিনকি দিয়ে পড়া রক্তের ধারা যখন কলোনির মাঠের মখমল ঘাসকে মেখে দিচ্ছে তখন তৌফিক এক প্রকার অপরাধীর সুরেই বলল, এই সরিরে, বাসায় আবার বলিস না। মা জানতে পারলে আমাকে মারবে। অয়নী তৌফিকের কথা রেখেছিল। হাঁটুর ওপর দাগটার কথা ও কখনো কাউকে বলেনি। মাঝেমাঝে গোসলের সময় কাটা দাগটা দেখে তৌফিক কে খুব মনে পড়ে। বাসা বদলের সাথে সাথে তৌফিকও হারিয়ে যায় জীবনের নিয়মে। অয়নীর নতুন খেলার সাথী হয়। মাঝেমাঝে ভুলে যাওয়া স্মৃতি মনে পড়ে। মনে পড়ে কলোনির মাঠ, সেই পুরাতন সাইকেল, দুরন্ত তৌফিক, একটি কাটা দাগ আর একঘেয়ে সন্ধ্যা নেমে আসা মুহূর্ত। সময়ের পরিক্রমায় যার অনেকটাই ধুসর। অনেক কিছু ভেবে অয়নীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। স্মৃতি হচ্ছে ঘুমন্ত অতীত যা বর্তমানকে জীবন্ত করে। অয়নীর চোখ থেকে মনের অজান্তেই কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অয়নী অগভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে তাকিয়ে দেখল নাবিলা দাঁড়িয়ে আছে। অয়নী জোর করে হাসলো। নাবিলা এসে অয়নীর পিঠে হাত রাখলো। অয়নী মলিন হেসে বলল,কি রে, কিছু বলবি?
নাবিলা বলল,তোর কী মন খারাপ?
- কই না তো। কে বললো তোকে?
-না এম্নি মনে হোল। হঠাত্‍ করেই। নাবিলা পাশ কাটিয়ে গেল। ওদের রুমটা অনেক চাপা। তাই যে কারো ব্যক্তিগত কথা একটু কান পাতলেই শোনা যায়। নাবিলা অয়নীকে কিছুই বুঝতে দিল না। যদিও ও সবই এতক্ষন শুনেছে। নাবিলা বললো, আয় খাবি। রাত তো অনেক হয়েছে। অয়নী বলল, খেতে ইচ্ছে করছে নারে। ভালো লাগছে না। নাবিলা বলল, সে কী কথা। শোন আজ বুয়া আসে নি। আমি রান্না করেছি। চিংড়ি মাছ দিয়ে চিচিঙ্গা। তুই মুখ ধুয়ে আয় আমি খাইয়ে দেব তোকে। নাবিলার কথা শুনে অয়নীর বেশ ভালো লাগলো। হঠাত্‍ মনে হোল ছোট্ট এ জীবনে ও যাঁদের ভালোবাসা পেয়েছে তাঁরা সবাই আকাশের মত বিশাল। কিছু কিছু মানুষ এক পৃথিবীর বিশালতা নিয়ে জন্মায়। ওর চারপাশের মানুষগুলোও হয়তো তাই।
দুই।
আজ ক্লাস খুব তাড়াতাড়ি শেষ হোল। বিকেলে ল্যাব হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হয় নি। ক্লাস শেষে অয়নী ক্যাফেটেরিয়ার দিকে গেল। কিছু একটা খেতে পারলে ভালো হতো। ব্যাগে পঞ্চাশ টাকার মাত্র একটা নোট আছে। যদিও এর মধ্যে কিছু খাওয়া যায়। কিন্তু আরো কয়েকজন সাথে থাকায় কিছুটা সংকোচ বোধ হোল। নাবিলা বলল,কি রে কিছু খাবি? অয়নী ইতস্তত বোধ করলো। একপ্রকার অস্বস্তি নিয়ে বলল, একটু পানি খেতাম। অয়নীর কথা শুনে নাবিলা অবাক হোল। বলল, পানিতো আমার কাছেও ছিল। বললেই পারতি। এত দূর না আসলেও হত। অয়নী খুব লজ্জা লাগে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,না রে, ঠান্ডা পানি খাবো। যা গরম পড়েছে। নাবিলা ব্যাগ থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে বলল, একটা পানি নিয়ে আয় আর সাথে দুটো ভেজিটেবল রোল নিয়ে আসিস। অয়নীর সংকোচ লাগে। ও টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,আমার কাছে আছে। তুইতো সবসময় খরচ করিস। নাবিলা জোড় করে ওর হাতে টাকা গুঁজে বলল, একই সাথে থাকি তাও এত সংকোচ? যা বলেছি কর। ঢং করিস না। আমার ঢং ভালো লাগে না।
ক্যাফেটেরিয়া থেকে এসে ওরা দেখলো ভার্সিটির বাস চলে গেছে। অবশ্য একটু দেরিও হয়েছে। অয়নী হতাশ চোখে নাবিলার দিকে তাকালো। নাবিলা বললো, এখন কি করবি? ঢং না ধরলেই পারতি। বাস মিস হতো না।
অয়নী বললো, চল নীলখেতের দিকে যাই। এরপর লেগুনায় গ্রীনরোড যাওয়া যাবে। আজ কপালটাই খারাপ। নাবিলা রাজি হোল। নিউমার্কেট আসতেই অয়নী বলল, এই দেখ না শাড়ি গুলো কী সুন্দর। আঁচল দেখ। শাদা শাড়ির ওপর ফুলের নকশা। পরলে যা মানাবে না। অয়নীর উচ্ছ্বাস দেখে নাবিলার বেশ ভালো লাগলো। কয়েকদিন পর পহেলা বৈশাখ। ঢাকা শহরের শৌখিন মেয়েরা শাড়ি কিনতে ব্যস্ত। দোকান গুলোতে মেয়েদের ভীড়। নাবিলা বলল, মানাবে দোস্ত। তুই যা সুন্দর। তোকে সবকিছুতেই মানাবে। এখন তাড়াতাড়ি চল। কাল ক্লাসটেস্ট আছে। অয়নীর আরো কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিল। নাবিলার কথায় চলে এল। লেগুনায় বসে নাবিলা ভাবলো,আহারে বেচারা। একটা সূতী শাড়ির কত ইচ্ছে। কতই বা দাম। আটশো থেকে একহাজার টাকা। হাতে টাকা থাকলে নাবিলাই অয়নীকে আজ শাড়িটা কিনে দিত। অয়নী নাবিলার চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,কি ভাবছিস? কারো প্রেমে ট্রেমে পড়ছিস নাকি?
নাবিলা মলিন হেসে বলল,নাহ রে। তেমন কিছু না।
তিন।
বিকেলে শাড়ির কথা ভেবে অয়নীর মন আবার খারাপ হোল। বর্ষবরণে সবাই শাড়ি পরবে আর অয়নী সবাইকে তাকিয়ে দেখবে। একগাদা শাড়ি পরা মেয়েদের মধ্যে ও কামিজ পরলে ওকে নিশ্চই খুব বেমানান দেখাবে। হয়তো মেয়েরা গা টেপাটেপি করবে। কেউ কেউ হাসবে। অয়নী এম্নিতেই বেশ সুন্দর। ক্লাসের মেয়েগুলো হিংসায় মরে যায়। মাকে আবার কি বলা যায়? নিজের মনের সাথে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে ও অবশেষে আবার বাসায় ফোন দিল। কিছুক্ষন আমতা আমতা করার পর মাকে বলল, আচ্ছা মা তোমার একটা শাড়ি ছিল না? ঐ যে ছোটবেলায় পরে বউ সাজতাম। তুমি কুঁচি করে পরিয়ে দিতে। ঐ শাড়িটা কি এখনো আছে?
অয়নীর কথা শুনে রাহেলা বেগমের মনের মধ্যে তুমুল ব্যাথার দামামা বেজে উঠলো। মেয়েটাকে একটা শাড়ি পাঠাতে পারলে ভালো হোত। এ মাসের বাড়ি ভাড়া বেড়েছে। নাহলে একটা নতুন শাড়ি পাঠানো যেত। কত ছোট একটা আব্দার করেছে বাপ মরা মেয়েটা। তাও তিনি রাখতে পারছেন না। কি অক্ষমতা মানুষের। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর তিনি বললেন, হ্যাঁ মা আছে। হয়তো আলমারি কিংবা ট্রাংকের এক কোনে। এতদিন পর এই শাড়ির কথা মনে পড়লো যে?
এম্নি মা। হঠাত্‍ মনে হোল তাই বললাম। আচ্ছা মা। না থাক।
কি বলবি? বলে ফেল? থেমে গেলি ক্যান?
বলছিলাম কি ঐ শাড়িটা যদি পাঠাতে। অন্তত এবারের মত পরা যেত। আগামিবার না হয় নতুন একটা কিনতাম।
রাহেলা বেগম বললেন, আচ্ছা মা। পাঠাবো। দেখি হাতে কিছু টাকা আসার কথা। যদি আসে তাহলে নতুনই একটা পাঠাবো। বরিশালে শাড়ির দাম কম।
মায়ের কথা শুনে অয়নীর প্রচন্ড খুশি হোল। এর মানে ওকে আর বর্ষবরণে কামিজ পরে থাকতে হবে না। নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে অয়নী খুশিতে কেঁদেই ফেলল। নাবিলা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কি হয়েছে? বলবিতো। অয়নী খুশি আর কান্নার মাঝামাঝি হাসি হেসে বলল, শাড়ি আসছে।
চার।
দ্বিধা আর সংশয় কাটিয়ে এক প্রকার আগ্রহ নিয়েই পার্সেলটা খুলল নাবিলা। অয়নীর মায়ের পাঠানো শাড়ি। নাবিলার অনুমান ঠিক হলো। পার্সেল খুলতেই একটা চিঠি পেল। মায়ের লেখা। একপ্রকার ঘোরের মাঝেই নাবিলা চিঠিটা পড়ে ফেলল। দাগটানা কাগজে অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা একটি চিঠি।
মা,
আদর নিস। ইচ্ছে ছিল তোকে নতুন একটা শাড়ি পাঠাবো। তোকে কথাও দিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাত্‍ করেই হাত খালি হয়ে গেল। তোর বড় বোনের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ফর্ম ফিলাপ চলছে। তোর শাড়ির টাকাটা ওর পেছনে খরচ হয়ে গেল। তোকে এই পুরনো শাড়ীটা পাঠাতাম না। তুই এমন ভাবে বললি না পাঠিয়েও পারলাম না। ট্রাংকের এক কোনায় পড়েছিল। আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর শাড়ি। তোর বাবা তখন ভালো বেতন পেত। অনেক পাগল টাইপ মানুষ ছিল। একপ্রকার প্রাগতৈহাসিক যুগের মানুষের মত আমাকে শাড়ি পরতে হত। শাড়ির আঁচলটা অনেক সুন্দর। প্রায়ই রাতে তোর বাবা হঠাত করে আমাকে এই শাড়ি পরতে বলতেন। সেবার তুই পেটে। একবার এই শাড়ি পরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পা স্লিপ করে পড়ে গেলাম। পেটে সামান্য চোট লাগলো। পরদিন ডাক্তারের কাছে চেক আপ করাতে গেলাম। সব ঠিক আছে জেনে তোর বাবা চিন্তা মুক্ত হলেন। এরপর থেকে এই শাড়ি পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। সেদিনের পর থেকে আর এই শাড়ি পরিনি। যাহোক। তুই সাবধানে পরিস। তোকে এই শাড়িতে ক্যামন লাগছে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। মানুষের সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। ভালো থাকিস।
তোর অক্ষম
মা
শাড়িটা ভালো করে পরখ করে দেখল নাবিলা। পুরনো আমলের শাড়ি। সিল্কের। জায়গায় জায়গায় ফেঁসে যাওয়ার চিহ্ন। সবচেয়ে বেশি সমস্যা আঁচলে। যদিও আঁচলটা খুব সুন্দর কিন্তু তিন চারটে ছিদ্র। ভালো করে পরলে অবশ্য বোঝা যাবে না। একটু ঢেকেঢুকে রাখলেই হবে। এই শাড়ি পেয়ে অয়নীর মন আরো খারাপ হবে। বেচারী আবার কাঁদবে। নীরবে। হয়তো পহেলা বৈশাখে বেরই হবে না। কিংবা এও হতে পারে রাগে অথবা অভিমানে অয়নী শাড়িটাকে কুটিকুটি করে কেটে ফেলবে। আঁচলের দিকে তাকিয়ে নাবিলার মনে হলো এর প্রতিটি পরতে পরতে গভীর মাতৃত্বের ছাপ। নাবিলার মা নেই। ছোটবেলায় মারা গেছে। আঁচলটাকে জড়িয়ে ধরে নাবিলা কিছুক্ষণ কাঁদলো। বুকের ভেতর শুন্যতার স্রোত বয়ে গেল। শুকানো ডিটারজেন্টের গন্ধ লেগে আছে শাড়িতে। মনে হচ্ছে অজস্র মায়া যেন সুতোর মত করেই বোনা হয়েছে আঁচলে। চোখের জলে আঁচলের একাংশ ভিজে গেছে। নাবিলা নিজেকে ঠিক করে নিল। অয়নী ফেরার আগে সবকিছু ঠিক করে ফেলতে হবে। হাতে সময় নেই। লকার থেকে নিজের শাড়িটা বের করল নাবিলা। গত মাসে নিউমার্কেট থেকে কেনা। ভর্তি পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন একটা টিউশনি করিয়েছিল। সেখান থেকে টাকা জমিয়েই শাড়িটা কেনা। বর্ষবরণে পরার জন্য। নাবিলা আহামরি সুন্দর না। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। এজন্যেই মিল করে এই শাড়ি কেনা। এখনো ভাঁজ খোলা হয়নি। কিছুক্ষন ভেবে নাবিলা নতুন শাড়ি টা পার্সেলের মধ্যে ঢুকালো। অয়নী এখন প্রচন্ড ঘোরের মাঝে আছে। এই ঘোর নতুন শাড়ি পরার। নিজের সৌন্দর্যকে আরেকটু জাগিয়ে তোলার কিংবা অনেক সাধারণের মাঝে নিজের অসাধারণত্ব টিকিয়ে রাখার। তাই ওর কাছে এই পুরনো সিল্কের শাড়ি, অপূর্ব আঁচলের মাঝে তিন চারটে ছিদ্র কিংবা অকৃত্রিম মাতৃত্ব কোনটারই দাম নেই। সব কিছু মূল্যহীন। যাঁর চলে যায় সেই হারানোর যন্ত্রনা উপলব্ধি করতে পারে। নাবিলা অয়নীর মায়ের চিঠিটা সরিয়ে ফেলল। নতুন শাড়িটা পার্সেলে ঢুকিয়ে কস্টেপ মেরে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনলো। শুধু একটা অগভীর দীর্ঘশ্বাস শেষ বিকেলের আকাশের সাথে মিশে অচেনা এক আবহ তৈরি করল। আকাশে মেঘ জমেছে। সম্ভবত বৃষ্টি হবে। নাবিলা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখের কোনে জমা অশ্রুর ফোঁটা তরলের পৃষ্ঠটান সূত্র মেনে আরো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বড় হচ্ছে। যেন একটু দমকা হাওয়া এলেই ঝরে পড়বে।
কাকভেজা হয়ে অয়নী বাসায় ফিরলো সন্ধ্যার কিছু পর। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে নাবিলার ঘুম ভাঙে। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই অয়নী বলল, আর বলিস না। ক্লাস শেষে চুড়ি কিনতে গিয়েই ঝামেলায় পড়লাম। পছন্দ করে কিনতেই পারছিলাম না। যা দেখি তাই পছন্দ হয়। এরমাঝে বৃষ্টি নামলো। এই বৈশাখের কাঠ ফাটা রোদের মাঝে বৃষ্টি নামার কোন মানে হয় বল?
নাবিলা বলল,ভেতরে আয়। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। এরপর সব শুনবো।
অয়নী ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,কাঁচের চুড়ি কিনলাম। বুঝছিস। শাড়ির সাথে মিলিয়ে পরতে হবে। এখন শুধু শাড়ির জন্যে অপেক্ষা। নাবিলা বলল, তোর একটা পার্সেল এসেছে। তুই যাওয়ার পরই পেলাম। টেবিলের ওপরে রাখা আছে। নাবিলার কথা শুনে অয়নী চমকে উঠল। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে পার্সেল খুলল। শাড়ি হাতে পেয়ে অয়নী আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। উচ্ছ্বাসের এক পর্যায়ে মাকে ফোন দিয়ে বলল, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মা। আই জাস্ট লাভ ইউ। রাহেলা বেগম কিছুই বুঝতে পারলেন না। শুধু মনে মনে ভাবলেন,আহারে বেচারী! পুরাতন একটা শাড়ি পেয়েই এত খুশি। নতুন শাড়ি পাঠালে না কত খুশি হত।
পাঁচ।
পহেলা বৈশাখের দিন অয়নী খুব সকালে ঘুম থেকে উঠল। গোসল করে শাড়ি পরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পরপর নাবিলা একই প্রশ্ন,এই আমাকে ক্যামন লাগছে বলতো? শাড়ি পরা ঠিক হয়েছে? আঁচলটা সুন্দর না? দ্যাখ দ্যাখ আঁচলে কি সুন্দর নকশা। আমার মায়ের চয়েজ আছে। এই কিছু বলছিস না যে।
নাবিলা আড়মোড়া ভেঙে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, তোকে অন্নেক সুন্দর লাগছেরে পাগলি। আমাকে আর একটু ঘুমোতে দে। প্লিজ। নাবিলার কথা শুনে অয়নী বলল, এই আর কত ঘুমাবি। ওঠ না। তাড়াতাড়ি রেডি হ। অয়নীর অত্যাচারে নাবিলা বিছানা ছেড়ে উঠল। গোসল করে পুরনো একটা কামিজ পরলো। এরপর অয়নীকে বললো,চল যাওয়া যাক। নাবিলাকে দেখে অয়নী অবাক হয়ে বলল,কিরে তুই শাড়ি পরবি না? নাবিলা মলিন কন্ঠে বলল, না রে। আমিতো তোর মত সুন্দর না। আর আমি সুন্দর করে শাড়ি পরতেও জানি না। রাস্তায় শাড়ি পরে বের হলে মনে হয় এই বুঝি খুলে পরবে। অয়নী কিছুক্ষণ ভেবে বলল,কিন্তু ব্যপারটা বেমানান হয়ে গেলো না। রাস্তায় দু’জন হাঁটছি। তুই পুরাতন কামিজ পরা আর আমি শাড়ি। লোকে কি বলবে? অয়নীর কথা শুনে নাবিলা হাসল। বলল,লোকের এত সময় কোথায় আমাদের দেখার?
তারপরও দোস্ত। তুই এক কাজ কর। বাসায় থেকে যা। বিকেলে না হয় আমরা ঘুরতে বের হবো। নাবিলা কিছুক্ষণ অয়নীর দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর খুব শান্ত গলায় বলল, সাবধানে যাস। আমার শরীরটাও ভালো লাগছে না। তোকে আগেই বলতাম।
নতুন শাড়ি পরার প্রবল আনন্দ কিংবা উচ্ছ্বাস যে কারণেই হোক নাবিলার কান্না ভেজা কন্ঠ অয়নীর কানে গেল না। শুধু আসি বলে অয়নী খুব দ্রুত নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। নাবিলা শুধু অয়নীর চলে যাওয়ার পথটির দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। মনে মনে ভাবল, কাউকে খুশি করার মত আনন্দ পৃথিবীতে হয়তো খুব কমই আছে।
অয়নী চলে যাওয়ার পর নাবিলা খুব সুন্দর করে সিল্কের শাড়িটা পরলো। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো ওর সমস্ত শরীর জুড়ে অদৃশ্য এক মমতা জড়িয়ে আছে। আঁচলের যে অংশে ছিদ্র সেই অংশ গুলো ভোরের আলো এসে পূর্ণ করার চেষ্টা করছে। নাবিলার আবারো কান্না এলো। এ কান্না আনন্দের। এক টুকরো আঁচলে খুঁজে পাওয়া এক চিলতে মাতৃত্বের। কোন মতে নিজেকে সংবরণ করলো ও। এ আঁচল ভালোবাসার আঁচল। অজস্র মমতা যেখানে লীন হয়ে আছে। এ আঁচল ভিজতে দেয়া যায় না।
গল্পগ্রন্থঃ কাচের কুয়াশা
প্রকাশকালঃগ্রন্থমেলা ২০১৪
মুক্তদেশ
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×