somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রসঙ্গ: আস্তিকতা ও নাস্তিকতার সীমাবদ্ধতা ও এর উত্তরণ।

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'আস্তিকতা হচ্ছে মানুষের চিন্তা ও চেতনার স্বাধীনতাকে অবদমিত করে রাখার আদিম প্রয়াস'- পৃথিবীর সব নাস্তিকরাই হয়ত এ উদ্ধৃতির মাধ্যমে আস্তিকতার স্বরূপ চিহ্নিত করে থাকবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেকে নাস্তিক পরিচয় দিতে স্বস্তি বোধ করলেও আস্তিকতাকে এ পর্যায়ের অপবাদের শৃংখলে আবদ্ধ করতে উৎসাহী নই। এ বোধ উৎপন্ন হওয়ার কারণ খুব সম্ভবত আমার নাস্তিকতা এতোটা পরিপূর্ণ হয়নি অথবা আমি ততোটা ভাল নাস্তিক নই। একজন নাস্তিক আস্তিকতাকে যতটা অপবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করতে উৎসাহী হওক না কেন পৃথিবীর ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে ইতিহাসের পট পরিবর্তনে ধর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। এক একটা আইন বা মতবাদের প্রচলন ঘটে যুগের প্রয়োজনে। ধর্মগুলোর সঠিক মূল্যায়ন হবে যদি ধর্মের প্রবর্তনের সময়ের চালচলন বিবেচনা ধর্মগুলোর সমীক্ষা করা হয়। এ সমীক্ষা এটাই প্রমাণ করবে যে ধর্মগুলো যুগের প্রয়োজন মেটাতেই প্রবর্তিত হয়েছিল এবং সীমাবদ্ধতার পরেও যুগের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এ দাবী অবশ্যই ইতিহাসের আলোকে প্রতিষ্ঠিত, ধর্মপন্ডিতের মনগড়া বক্তব্য নয়। সমালোচকেরা হয়ত বলে থাকবেন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থেই এ ধর্মগুলোর প্রবর্তন করা হয়েছিল। অভিযোগটি একেবারে ভিত্তিহীন নয়। তবে আধুনীক যুগেও কি কেউ এটা প্রমাণ করতে পারবেন যে বর্তমানের আইনগুলোও কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য প্রবর্তিত হচ্ছে না?

একটা সময় ধর্ম অবশ্যই যুগের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, মানুষকে ইতিবাচক পথ নির্দেশনা দিয়েছিল। ধর্মীয় আইন, রীতি, নৈতিকতা অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে হলেও মানুষকে আলোকিত করেছিল। ধর্মের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে ধর্মীয় শক্তি শুধুমাত্র তলোয়ার বা পেশীর শক্তিতেই পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তার করেনি, নৈতিকতা বা জ্ঞানও সেখানে প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল। উদাহরনস্বরূপ, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার কোন পেশী শক্তির উস্কানীতে আসেনি। এসেছিল, বৌদ্ধের পরম শান্তি ও অমর বাণীর প্রতি মানুষের আকর্ষণে। তেমনি এশিয়া ও আফ্রিকাতে ইসলামের বিস্তার অথবা ইউরোপ বা ল্যাটিন আমেরিকাতে খ্রীস্ট ধর্মের বিস্তার এবং ধর্মীয় আইনের প্রভাব শুধুমাত্র উপনিবেশিক শাসনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি। অবশ্যই এটা ছিল সুফী, দরবেশ ও মিশনারীদের নিরহংকার ও জ্ঞান-গর্ভ প্রচেষ্টার ফল।

পৃথিবীর বাক পরিবর্তনকারী ধর্মগুলোকে এখন প্রগতি ও মত প্রকাশের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে কেন বিবেচনা করা হচ্ছে? কারা এর জন্য দায়ী? আমার বিবেচনায়, এর জন্য দায়ী নিঃসন্দেহে যারা এই ধর্মগুলোকে তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মহীরুহে পরিনত করেছিল তাদেরই উত্তর পুরুষরা। তাঁরা এটা বুঝলেও মানতে নারাজ যে, ধর্মগুলো প্রবর্তিত হয়েছিল বিশেষ যুগের চাহিদার প্রয়োজন। যেহেতু যুগের পরিবর্তন ঘটেছে তাই পরিবর্তিত সময়ের জন্য প্রয়োজন পরিবর্তন যাকে সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে সংস্কার। কিন্তু তথাকথিত এই ধর্মীয় নেতারা পরিবর্তন বা সংস্কারে বিশ্বাসী নয়। তাঁরা পুরাতনকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। এই আঁকড়ে ধরার প্রধান কারণ নিজের স্বত্ত্বাকে ধরে রাখা নয় বরং অযোগ্য ব্যক্তির ক্ষমতা আরোহনের প্রয়াস। তাঁরা খুব ভাল করেই জানে যে পরিবর্তনের ফলে যে নতুন জ্ঞানের উদ্ভব তাঁরা তা অর্জন করতে পারেনি কিংবা অর্জন করতে অক্ষম। এটাও বুঝে যে, এই জ্ঞানের সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ব্যতিত নেতৃত্ব দেয়া অসম্ভব। তাই সব অর্জনকেই তাঁরা ধর্মের গন্ডির মাঝে আবদ্ধ রাখতে চায়। তাঁরা বুঝাতে চায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি সব তাঁদের ধর্মপুস্তকের জ্ঞানকে আবর্তন করে ঘূর্ণায়মান হচ্ছে। তাদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত কর যেয়ে তারা বিজ্ঞান ও ধর্মকে মিলিয়ে নতুন একটা অবয়ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিষয়টা অনেকট সুকুমার রায়ের হাঁস ও সজারু মিলিয়ে হাসজারু বানানোর মতো ছেলে হাসানো ছড়ার মতনই। বছরের পর বছর কঠোর প্রচেষ্টার ফলে প্রাপ্ত কোন বৈজ্ঞানীক আবিস্কারকে তাঁরা তাঁদের ধর্মপুস্তকের বর্ণনার আলোকে আবিস্কৃত বলে ঘোষণা দিতে কুন্ঠাবোধ করেন না। ঠিক সেই মুহুর্তে যদি কোন ব্যক্তি 'ধর্মপুস্তকেই যদি এর বর্ণনা দেয়া থাকে তবে ধর্মীয় কোন নেতা এর আবিস্কারক হলেননা কেন?' এ জাতীয় প্রশ্ন করেন তবে তৎক্ষণাৎই তাঁকে মুরতাদ বলে ঘোষণা করা হয় এবং এ ঘোষণাকে সমর্থন করার মত লোকের অভাব হয় না।

'ধর্ম প্রগতি বিরোধী' এ বাক্যটির প্রচলনে তথাকথিত এই ধর্মীয় নেতারাই দায়ী। বিশেষ যুগে, বিশেষ কারণে প্রবর্তিত ধর্মের আইনগুলো 'ঐশী বাণী' এই মিথ প্রতিষ্ঠিত করে তাঁরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। তাঁদের এই স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টার কারণে ধর্ম আধুনীকতার বিরুদ্ধ শক্তিতে পরিনত হয়েছে। এই বিরোধের বেড়াজালে হারিয়ে যাচ্ছে ধর্মের মাধ্যমে কোন একসময়ে অর্জিত ঐতিহাসিক অর্জনগুলো। অথচ শুধু ইতিহাস বিবেচনায় নয় ধর্ম এখনও মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে পারেন যদি ধর্মীয় নেতারা যদি বাস্তবতা উপলব্ধি করে যুগের আলোকে এর পরিবর্তন তথা সংস্কার করেন। ধর্মে যে সমস্ত আইন-কানুন, রীতি-নীতি এ যুগে বেমানান বা অপ্রয়োজনীয় এগুলোকে পরিমার্জিত করে ধর্মকে বর্তমানের সামঞ্জস্য করতে পারেন। এতে করে নৈতিক শিক্ষার (যা সর্বযুগেই প্রযোজ্য) পাশাপাশি ধর্মের অন্যান্য আইন-কানুনগুলো পরিবর্তিত সমাজে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং যুগের কাংখিত লক্ষ্য অর্জনেও সহায়ক হবে এবং সর্বোপরি ধর্মীয় নেতারা এর মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনাকে হরণ না করে কিংবা কোনরকম জোর জবরদস্তি ব্যতিরেকেই সমাজে তাদের পুরাতন ইতিবাচক ভূমিকা বজায় রাখতে পারবেন।

মানুষের চিন্তা ও জ্ঞানের উৎকর্ষতার কারণে আস্তিকতার ঠিক বিপরীত মত হিসেবে নাস্তিকতার উদ্ভব হয়েছে। নাস্তিকরা নিজেদেরকে পরমত শ্রদ্ধাশীল, প্রগতিশীল ও আধুনীক চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক বলে দাবী করে থাকেন। বস্তুবাদীতা, মানুষের মানবিক চাহিদা পুরণ এবং বর্তমান সময়কে কেন্দ্র করেই তাঁদের আবর্তন। তবে এক্ষেত্রেও একটি সীমাবদ্ধতা আছে। একজন আস্তিক যেখানে পরকালে সুখের আশায় কিংবা শাস্তির ভয়ে ইহকালে নিজেকে খারাপ প্রবৃত্তি হতে সংযত রাখার চেষ্টা করেন, সেখানে একজন নাস্তিক কিসের ভয়ে নিজেকে সংযত করবেন? যেহেতু তিনি পরকাল বিশ্বাস করেন না এবং যেহেতু তাঁর কোন জবাবদিহিতা নেই সেহেতু তাঁর পক্ষে অন্যায় করা কিংবা স্বেচ্ছাচারী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আর এরূপ স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিটি যদি সমাজ বা রাষ্ট্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন তখনতো তার পরিনতি হবে আরো ভয়াবহ। এ ভয়াবহ অবস্থার উত্তরণ কেবল তখনই ঘটবে যখন নাস্তিকতাকেও একটি ধর্ম বা জীবনবোধ হিসেবে দেখা হবে। এ ধর্মের 'ঐশী বাণী' হবে নিজের বিবেকবোধ। বিবেকের বিশুদ্ধতা ছাড়া কোন ব্যক্তি নাস্তিক ধর্মের অধিকারী হতে পারবেন না। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধহীন ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ব্যক্তিকে স্রেফ ভোগবাদী বা স্বৈরাচারী হিসেবেই চিহ্নিত করা যেতে পারে।

ব্যক্তি হিসেবে আমার নিজস্ব একটা মত অবশ্যই আছে। তথাপি এ লেখাটিতে যথাসম্ভব নিরপেক্ষ থেকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে আস্তিকতা ও নাস্তিকতার সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সীমাবদ্ধতা আরও থাকতে পারে কিংবা কোন মতবাদ অনুযায়ী সীমাবদ্ধতার হেরফের হতে পারে। তবে সার্বিক বিবেচনায় আস্তিকতা ও নাস্তিকতা এই দুই মতবাদকেই বাস্তব হিসেবে মেনে নিয়ে এ দু'য়ের সীমাবদ্ধতাগুলোকে দূর করার ব্যাপারে সকলেরই ব্রতী হওয়া উচিত। আমি নিশ্চিত সকলেই স্বীকার করবেন যে সীমাবদ্ধতাগুলো দূর হওয়া সময়ের দাবী এবং পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় একান্তভাবে কাম্য।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ২:১৫
৩০টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×