আক্ষেপ করবো কি ভাবে জানি না। সময়ের পরিক্রমায় কেটে গেল একটা বছর। রাষ্ট্রের চোখে আমরা রাষ্ট্রদ্রোহী আজো। পুলিশ হত্যা চেষ্টার মিথ্যা মামলা (৩০৭)। আইনি ভাষায় আমাদের মামলার নাম রাষ্ট্র বনাম লিটন নন্দি গণ।
আমাদের ভুল ছিল একবুক সাসহ নিয়ে পচা-গলা, নষ্ট ও পথভ্রষ্ট সমাজের অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতি আপোষ না করে জং খাওয়া এই ইস্পাত শৃঙ্খল ভাঙ্গার দৃঢ় প্রত্যয়ের মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। ঘটনাটা ঘটে, গেল বছরের ২৬শে মে। হুম, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনের ন্যায় বিচারের প্রতীকী পুনঃস্থাপনের দাবিতে ঐদিন আমরা সমাবেত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে প্রতিবাদী মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম কোর্ট প্রাঙ্গনের দিকে। কারণ অবিদিত নয় হয়তো কারো কাছে। ক্ষমতালিপ্সু সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য হেফাজতের সাম্প্রদায়িক অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত করে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার বিরুদ্ধে আতাত করে কোর্ট প্রাঙ্গণের ন্যায় বিচারের প্রতীকী অপসরণ করে। যা ছিল শিল্প সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনার বিরুদ্ধে এক নগ্ন আঘাত। শুধু তাই করে হেফাজত ক্ষান্ত হয়নি। ওই দিনেরই বিকেলে (২৬শে মে) তারা আবার ঘোষণা দেয়, দেশে কোন মূর্তি থাকতে পারবে না।
এমন কোন ঘোষণা যে তারা করবে, তা আমাদের আগে থেকেই জানা ছিল। সরকার প্রধান যে অদূরদর্শী, তা মোটেই নয়। মুলত হচ্ছে ক্ষমতা লিপ্সা। যতটা মনে পড়ে ঘটনার সময়টা, মিছিল নিয়ে আমরা সুম্প্রিম কোর্টের দিকে যাচ্ছিলাম। স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ মুখরিত। শিশু একাডেমীর সামনে যেতেই দেখি শিক্ষা চত্বরের সামনে ব্যারিকেড বাধা। সম্ভত ঋদ্ধ দা (ঋদ্ধ অনিন্দ্য, সহ-সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা মহানগর সংসদ) আমার বাম পাশে ছিল। মিছিল থেকে আমার কয়েকজন বের হয়ে সামনে গেলাম। কিন্তু ব্যারিকেড অবধি যাওয়ার আগেই পুলিশ আমাদের দিকে তাক করে টিয়ারসেল আর জলকামান নিক্ষেপ করতে শুরু করলো। টিয়ারসেলের ঝাঁজালো গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছিল (মুক্ত মেরুতে সরকার শ্বাস নিতেই বা কবে দিয়েছে!) চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। জল কামানের লাল জলে স্নাত হয়ে টিয়ারসেল থেকে বাঁচার জন্য গাছের পেছনে আশ্রয় নিয়েছিলাম কয়েক জন। মিছিল ছত্র ভঙ্গ হয়ে পড়লো। সামনের দুটো রো'তে যারা ছিলাম, তারা নড়িনি সামনে থেকে। শতাধিক আহত হয়। দেখলাম কারো একজনের পায়ে হঠাৎ করে পুলিশ টিয়ারসেল মেরে দিলো। উনি রাস্তায় পড়ে গেল। সম্ভবত তপন দা ছিল সেটা। টিয়ারসেলের কারণে চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না। চশমাটাও লাল জলে লাল জলে ভেজা। লিটন দা (লিটন নন্দি) আর মরশেদ ভাই (মরশেদ হালিম) এক সাথে এরেস্ট হল। কিছুক্ষণ পরে আরিফ ভাইয়াও (আরিফ নূর)।
একটা সময় বাসদের মনিকা দি চিৎকার করে বলতে শুরু করলো পুলিশদের উদ্দেশ্য করে, "কি? কি?" পাশে থেকে সবাই স্লোগান শুরু করলো পুনরায়। তখন আবার টিয়ারসেল আর জলকামানের জল। স্পষ্ট মনে আছে, একজন পুলিশ বলছিল, "ওদের (মেয়েদের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে) বক্ষ বরাবর জলকামান মারো। তা না হলে যাবে না।" সত্যি যেতাম না আমরা। অনবরত টিয়ারসেল তখনো ছুড়ে যাচ্ছিলো পুলিশ। তখন আমি সামনে এগিয়ে ব্যারিকেড লাফিয়ে অতিক্রম করে পুলিশের বন্দুকের নল ধরে বুকে ঠেকিয়ে বললাম,"কত গুলি আপনাদের? We are ready to die. Come on shoot me. Shoot me, I said shoot me." আর কিছু শুনল না। শুট ও করলো না। প্রিজন ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল।
রাষ্ট্র আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিলো। জেলের মাঝে তো আরও অনেক কষ্টের গল্প রয়েছে। তবে জেলে একটা সুষ্ঠু শৃঙ্খল আছে, বাইরে তা নেই। তিন দিন পরে কারামুক্তি পাই তো বটে, মামলা নিষ্পত্তির এই অবধি রাষ্ট্র কোন ভূমিকা পালন করেনি। চার্জশীট অবধি আসেনি এখনো। এখন প্রতিদিন সহ্য করতে হচ্ছে মানসিক নির্যাতন। হত্যা চেষ্টার মিথ্যা মামলার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি। জীবনের মোড় আর উদ্দেশ্য দুটোই বদলে গেছে। তবে আমি তা ইতিবাচক ভাবেই দেখি। রাষ্ট্রের টনক নড়েছিল ঐদিন। তাই তো ভাস্কর্যটাকে আমরা বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি।
পরিশেষে কথা,
"নীলিমায় সূর্যাস্ত হয়ে আসে কালো রাত,
পুব গগণে রবির আলোয় আসে নব প্রভাত!!"
--রাফিন জয়
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৫